ইউরোপের ১৫০ দিন -সৈয়দা তাসলিমা আক্তার

19 Jun 2023, 01:19 PM ভ্রমন শেয়ার:
ইউরোপের ১৫০ দিন -সৈয়দা তাসলিমা আক্তার

[পূর্ব প্রকাশিতের পর]


সেই কখন থেকে মালমো সেতুর কথা বলে চলেছি, নিশ্চয়ই পাঠক এতক্ষণে বিরক্ত হয়ে পড়েছেন ; কী এমন জিনিস একটা সেতুই তো তাই নিয়ে এত আদিখ্যেতা কেন ? আমারও প্রথমে তাই মনে হয়েছিল, তারপর যখন এ সম্পর্কে জানার চেষ্টা করলাম এবং জানলাম তখন আমিও অভিভূত। সে গল্পে পরে আসছি, কীভাবে মালমো নিয়ে আমার আগ্রহের সূচনা আগে সে-কথা বলে নিই, আমি যখন ডেনমার্ক যাব বলে পরিকল্পনা করলাম তা শুনে আমার ভাতিজা ইরফান বলল, আমি যেন মালমো সেতুতে যাই। ইরফানকে এ নিয়ে আর প্রশ্ন করা হয়নি, তবে সেই একই কথা বলল আমার কলিগ ফারজানা তখন জানতে চাইলাম এর বিশেষত্ব কী-? ফারজানা যতটুকু জানালো এটি এমন একটি সেতু যার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ সমুদ্রের মাঝে ডুবন্ত অর্থাৎ সমুদ্রের তলদেশ দিয়ে চলে গেছে, যারা এই সেতু দিয়ে চলাচল করে তারা অতল সমুদ্রের বিস্ময়কর রূপ দেখতে পায় বেশ একটা এক্সাইটিং ব্যাপার। ফারজানার কথায় কৌতূহলী হয়ে ইন্টারনেটের শরণাপন্ন হলাম। গুগোল মামাকে প্রশ্ন করে যা জানলাম, তা হলো মালমো হচ্ছে সুইডেনের সীমান্তবর্তী একটি উপকূলীয় শহর, সেখান থেকে সরাসরি ডেনমার্কের কোপেনহেগেন অবদি যে সংযোগ সেতু সেটি মালমো সেতু নামে পরিচিত। আদতে এ সেতুটির নাম the resund bridge ইংরেজিতে একে সাউন্ড ব্রিজও বলা হয়। সেতুটি একাধারে সড়ক ও রেল পথের সমন্বয়ে গঠিত। সম্ভবত ইউরোপের দীর্ঘতম সড়ক সেতুও এটি। মোট ৮ কি.মি. দীর্ঘ সেতুর ৪ কি.মি. দৃশ্যমান আর বাকি ৪ কি.মি. পানির তলায়, পানির উপর থেকে এর অস্তিত্ব আন্দাজ করা কঠিন, যেন সেতুটি হঠাৎই পথ চলতে চলতে সাগরজলে মুখ লুকালো। মূলত এখান থেকেই মালমো নিয়ে আমার আগ্রহ তৈরি হয়। তাই কোপেনহেগেন যাওয়ার পর মনে মনে এই ইচ্ছে লালন করে যাচ্ছি, সাথে সময় ও সুযোগের অপেক্ষায় ছিলাম। শেষ পর্যন্ত অবশ্য সুপ্ত বাসনা সুপ্তই থেকে গেল কেননা সময় আর সুযোগের মেলবন্ধন ঘটেনি।

আগেই বলেছি নভেম্বরের মাঝামাঝি এই সময়ে এসে দিনের পরিসর এতই কমে যায় যে সকাল না হতেই যেন সন্ধে হয়ে যায়, তাই সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে দিনের আলোতে মালমো যাওয়া এবং আসা একটুু অনিশ্চিতই হয়ে গেল তার ওপর হঠাৎই আকাশের রং বদলÑ এসব বিবেচনায় এবারের মতো মালমো যাওয়ার পরিকল্পনা মুলতবিই রইল ; তাই বলে চোখের দেখাও হবে নাÑ চোখের দেখা দেখতেই আমাগার স্ট্রান্ডপার্কে আসা। এ পার্ক সম্পর্কে আগেই বলেছি তাই পার্কের সৌন্দর্য বর্ণনায় আর না যাই বরং যে উদ্দেশ্যে এখানে আসা এবং তার পরিণতি কী হলো তাই বলি। আকাশ অনেক্ষণ থেকেই গোমড়ামুখো হয়ে আছে, জানি না কার ওপর তার এত রাগ জমেছিল, তবে ভীষণ রেগে ছিল এটা নিশ্চিত, কেননা অভিমান হলে বর্ষণ হতো তা হয়নি, হয়েছে প্রলয়ঘূর্ণি। বাতাসের দাপট এতটাই ছিল মনে হচ্ছিল যেন আমাদেরও উড়িয়ে নেবে। আমরা তখন খোলা চত্বরে একপাশে গভীর কালো বাল্টিক অন্য দিকে বিস্তীর্ণ খোলা প্রান্তর। কাছেপিঠে মাথা গুজবার তেমন কোনো ঠাঁই ছিল না। একটুু ভয় হচ্ছিল সন্দেহ নেই, তবে সামলে উঠেছিলাম আর কপাল ভালো বাতাসও তার রাগ অল্প সময়ের মধ্যেই সামলে নিয়েছিল। নিশ্চয়ই এতক্ষণে বুঝে গেছেন মেঘকালো সময়ে সুদূরে থাকা মালমো সেতু কতটা দৃষ্টিগোচর হয়েছিল। তবে সময়টা কিন্তু খারাপ কাটেনি, বাতাস থেমে গেছে তবে রেশ রয়ে গেছে আর এমনিতেই সমুদ্রের ধারে বাতাস কিছুটা অগোছালো হয় ; আমরা সেই এলোমেলো অগোছালো বাতাসে হেঁটে বেড়ালাম। সমুদ্রের তীর কোথাও কোথাও পাথরের চাঁই দিয়ে বেঁধে দেওয়া, তার পাশ ঘেঁষে পায়ে চলার জন্য কাঠের পাটাতন মনে হয় যেন পথটি সমুদ্রের মাঝে গিয়ে শেষ হয়েছে। বলেছিলাম বোধকরি বাবুর সাথে আমার প্রায় পনের কি ষোল বছর পর দেখা। বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই পুরনো সময়ের জাবর কেটে কেটেই আমরা হাঁটতে হাঁটেতে পাটাতন ধরে শেষ মাথা অবধি চলে গেলাম, তারপর কিছু সময় চুপচাপ সমুদ্রের আলাপন শুনে ফিরে এলাম বন্ধু বাবুর প্রবাস নীড়ে।

আজ কোপেনহেগেনে আমার রাত-দিনের শেষ, কাল সকাল ৯.৩০-এর ফ্লাইটে আমি বার্গেন ফিরে যাব, তাই এই রাত্রে বাবু আর অ্যানী মিলে বেশ ভালো রকমের ভোজের আয়োজনে ব্যস্ত। সেই ফাঁকে আমি তাদের কন্যা আদিবার সাথে গল্প করে সময় কাটালাম, শুরুতে আদিবার সঙ্গে আমার অতটা সখ্য না হলেও এখন কিন্তু তার সঙ্গে ভাব জমে গেছে। গল্প হচ্ছিল আদিবার স্কুল, বন্ধু আর পছন্দ নিয়ে, এরই মধ্যে ডিনার প্রস্তুত করে অ্যানী তাড়া দিচ্ছিল তাই আমরাও সবাই খেতে বসে গেলাম। খাওয়ার পর চলল এক প্রস্থ আড্ডা। আজ যেন আর আড্ডা শেষ হতেই চায় না, শেষবেলা বলেই হয়ত। সময়ের নিয়ম মেনে একসময় সবাই ঘুমুতে গেলাম। কেননা বিমানবন্দর বাবুর বাড়ি থেকে ঘণ্টা খানেকের পথ আর কিছুটা সময় হাতে রেখেই বিমানবন্দরে যাওয়া ভালো তাই যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়তে চেষ্টা করলাম সকাল সকাল উঠব বলে।

সকাল সকাল উঠে সকাল সকাল বের হওয়ার সর্বোচ্চ চেষ্টা থাকা সত্ত্বেও কেমন করে যেন ঘড়ির কাঁটা ৭.০০টা ছাড়িয়ে গেছে। এটা শহরের সবচেয়ে ব্যস্ত সময়, যে বাহনেই যাওয়া হোক না কেন সময় একদম টায়টায় হয়ে যাচ্ছে। প্রথমে গাড়িতে যাওয়ার পরিকল্পনা থাকলেও জ্যামের কথা চিন্তা করে ট্রামেই যাওয়া ঠিক হবে বলে আমরা ট্রামের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লাম। আমরা বলতে আমি, অ্যানী আর বাবু, আদিবা ইতোমধ্যে তার স্কুলে চলে গেছে। যাই হোক, সকাল সাড়ে সাতটা নাগাদ ট্রাম স্টেশনে যাত্রীদের যে প্রচ- ভীড় তা দেখে আমার ঈদ যাত্রায় কমলাপুর স্টেশনের ভীড়ের কথা মনে পড়ে গেল, সেইসঙ্গে আরো যে কথাটি মনে হলো দিনের অন্য সময় তো এ শহর একদমই নীরব ছিমছাম, পথেÑঘাটে লোকজনের আনা-গোনাও খুব বেশি না ; হঠাৎ সাত সকালে এত মানুষ এলোই-বা কোথা হতে ? স্টেশনে পৌঁছে আমরা একটা ট্রাম মিস করলাম। বলা ভালো ভীড় ঠেলে উঠতে পারলাম না, তবে পরেরটা কোনোমতেই মিস করা যাবে না। কেননা ফ্লাইট ধরতে হবে। ভাগ্য ভালো পরের ট্রামে উঠতে পারলাম যদিও অবস্থা চিড়েচ্যাপ্টা। সকাল নয়টার কাছাকাছি সময়ে আমরা বিমানবন্দরে পৌঁছে গেলাম ; হাতে খুব একটা সময় না থাকায় বাবু আর অ্যানীর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নিরাপত্তা তল্লাশির পথ ধরলাম, যদিও বিমানবন্দরে বহিরাগতদের যতটুকু যাওয়ার অনুমতি আছে তার পুরোটাই বাবু আমার সাথে এসেছে। আমি নিরাপত্তা আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে পেছনে তাকিয়ে তখনো বাবুকে দেখতে পেলাম, হাত নেড়ে বাবুকে বিদায় দিয়ে যখন ফ্লাইটের গেটে যাচ্ছিলাম তখন খুব আপনজনদের ছেড়ে যাওয়া কষ্টের অনুভূতিতে মনটা আচ্ছন্ন হয়েছিল।


কোপেনহেগেন থেকে বার্গেন, আবার সেই গতানুগতিকতায় ফেরা। আসলে শীতের তীব্রতা শুরু হতেই বার্গেন আমার কাছে একঘেঁয়ে হয়ে উঠেছে। এমনিতেই তো ইউরোপে রোদ সোনার হরিণ। অক্টোবরের পর থেকে এ যেন বাস্তবিকই অধরা হয়ে উঠেছে। সারাক্ষণই যেন একটা মন খারাপের আবহাওয়া। এরই মাঝে চলছে সপ্তাহের তিনদিনের নিয়মিত ক্লাস। তাই ক্লাসে যাওয়া-আসা আর মাঝে-মাঝে প্রয়োজনীয় কেনাকাটা করা ছাড়া খুব একটা বাইরে যাওয়া হয় না। এদিকে পরীক্ষাও খুব কাছে, অ্যাসাইনমেন্ট যেগুলো চূড়ান্ত হয়েছে সেগুলো উপস্থাপনের তারিখও হয়ে গেছে তাই পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ততা বেড়ে গেলেও বিকেলগুলো যেন খুব অলস আর বিষণœ হয়ে আসে। ক্লাসে উপস্থাপনের ঝামেলা চুকলে একদিন আকাশের মন খারাপকে অগ্রাহ্য করে আমি আর ফারজানা বেরিয়ে পড়লাম, কোনো নির্দিষ্ট গন্তব্যে নয়, যে দিকে ভালো লাগে সেদিকে যাব এমন মনোভাব নিয়ে। বার্গেনে থাকতে এরকম আমরা প্রায়ই করতাম ; লাইট ট্রেনে চড়ে যেকোনো একটা স্টেশনে নেমে পড়তাম তারপর সেখান থেকে কোনো একটা বাসে চড়ে আবার কোথাও চলে যেতাম। এটা এমনি কোনো অজানায় যাওয়া। আমরা একটা বাসে উঠে বসেছি, যদিও আকাশ মেঘলা তবে এখনো বৃষ্টি শুরু হয়নি। বাস যেন সত্যিই কোনো অজানায় ছুটে যাচ্ছে, মনে হলো যেন আমরা শহর ছাড়িয়ে গেলাম, একসময় বাস থামলো, আর যাবে না আপাতত, এটাই তার চূড়ান্ত গন্তব্যÑ অগত্যা আমরাও নেমে পড়লাম। 

[চলবে]