হৃৎমঞ্চের ‘রিমান্ড’

19 Jun 2023, 01:31 PM রঙ্গশালা শেয়ার:
হৃৎমঞ্চের ‘রিমান্ড’

নামকরা একজন লেখক কিছু স্বপ্নবাজ মানুষের আত্মহত্যার উষ্কানিদাতা এমন অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে সেই লেখককে আটক করে রিমান্ডে আনা হয়। রিমান্ডে লেখককে জেরা করার দায়িত্ব দেওয়া হয় তরুণ ও জেদী একজন মহিলা গোয়েন্দা অফিসারকে। রিমান্ড ঘরে অফিসার তার প্রশ্নবাণে জর্জরিত করে লেখকের কাছ থেকে উদ্ধার করতে চান ঘটনার মোটিফ। লেখককে ভয় দেখিয়ে, শাসিয়ে, অনুরোধ করে যতই চেষ্টা চালান না কেন গোয়েন্দা অফিসার, লেখক বরাবরই থাকেন অবিচলিত ও হেয়ালিপূর্ণ। তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ সত্য নয় বলে তিনি দাবি করতে থাকেন এবং অফিসারের অভিযোগ খ-াতে থাকেন নিজের মতো নানা যুক্তি ও দার্শনিক কথামালা দিয়ে। কিন্তু গোয়েন্দা অফিসারকে সেসব কথায় বা কবিতার কোটেশনে টলাতে পারেন না। এভাবে জেরা ও পালটা যুক্তি-তক্কের মধ্য দিয়ে জানতে পারা যায়, এই লেখকের এমন সম্মোহনী শক্তির কথা, যে তার নিজস্ব দর্শন ও যুক্তি দিয়ে মানুষের মনোজগতে প্রভাব ফেলে আসছিলেন দীর্ঘদিন ধরে, যার ফলে জীবনবিমুখ হয়ে আত্মহননের পথ বেছে নেয় অনেক তরুণ-তরুণী, যুবা। কিন্তু লেখক এই দায় অস্বীকার করার ক্ষেত্রে থাকেন অবিচল। তার দর্শন মতে, মানুষের জীবন হলো তার বাবা-মায়ের অসাবধানতার ফলÑ একটি ভুল থেকে সেই জন্মের সূত্রপাত। কাজেই মানুষ মূলত তার জনক-জননীর আনন্দের উপজাত মাত্র। সেই হিসেবে, মানুষ কেবল প্রকৃতির একটা অংশ শুধু। এখানে ভালোবাসা-বাসি, প্রেম বা দায়বদ্ধতার কোনো স্থান থাকা উচিত নয়। সে ভালোবাসবে শুধু তার নিজেকে এবং প্রকৃতিকে। অন্য মানুষেরা কেবল তার মনোরঞ্জনের জন্যই হবে ব্যবহৃত।

এমন উদ্ভট দার্শনিকতা গোয়েন্দা অফিসারকে আরো ক্ষিপ্ত করে তোলে। গোয়েন্দা অফিসার লেখকের দার্শনিকতাকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে তাকে তার অপরাধ স্বীকার করতে অনুরোধ করে যেতে থাকে। গোয়েন্দা অফিসার একসময় মানসিকভাবে আবেগতাড়িত হয়ে পড়ে। বুদ্ধিমান লেখক বুঝে ফেলেন যে অফিসার কেবল চাকরি বা দায়িত্ব পালনের জন্য এ জেরা করছে না বরং তার ব্যক্তিগত কোনো আবেগ অনুভূতিও এর সঙ্গে নিশ্চয়ই জড়িত। অফিসারের অজান্তেই লেখক অফিসারকে উল্টো পর্যবেক্ষণ করতে থাকে- কোন কথায় অফিসারের কোন প্রতিক্রিয়া হয়, কোন ক্ষণে তার গলা কেঁপে উঠছে, কী তার কথার সাবটেক্সট। তথাপি জেরা চলতে থাকে অবিরাম। এভাবে জেরা-যুদ্ধের একপর্যায়ে প্রকাশ হতে থাকে লেখকের জন্ম ইতিহাস ও তার অতীত জীবনের নানা কু-ঘটনার রেফারেন্স। এসব ঘটনার সাথে গোয়েন্দা অফিসারের আদৌ কি ব্যক্তিগত কোনো সংশ্লিষ্টতা ছিল বা আছে ? এর উত্তর মিলনায়তনেই দর্শককে খুঁজে পেতে হবে। আর দেখতে হবে নাটক ‘রিমান্ড’। নাটকে লেখকের ভূমিকায় আছেন যশস্বী অভিনেতা আসাদুজ্জামান নূর- যাঁর নামই যথেষ্ট দর্শককে এই নাটকের প্রতি আগ্রহী করে তুলতে। গোয়েন্দা অফিসারের চরিত্রে অভিনয় করেন তরুণ, প্রতিশ্রুতিশীল অভিনেত্রী জ্যোতি সিনহা। পার্শ্বচরিত্র হিসেবে মঞ্চে আরো কিছু চরিত্রের আনাগোনা ছিল প্রায় পুরোটা সময় জুড়েই। নাটকটি রচনা ও নির্দেশনা দিয়েছেন তরুণ নাট্যনির্দেশক ও লেখক শুভাশিস সিনহা।

‘রিমান্ড’ মূলত সংলাপ নির্ভর একটি নাট্যপ্রযোজনা। সেইসঙ্গে কোরিওগ্রাফি বিবর্জিত এবং আবহসংগীত বাহুল্যমুক্ত। কেবল সংলাপ দিয়ে একটি নাটকে দর্শককে আকৃষ্ট করে রাখার কাজটি ঝুঁকিপূর্ণ হলেও শুভাশিস সিনহা সার্থক হয়েছেন শতভাগ। আসাদুজ্জামান নূরের অভিনয় নিয়ে বলার কিছু থাকে নাÑ তিনি ঢাকার মঞ্চের এক প্রবাদপুরুষসম। তথাপি, মহড়া কম হওয়া বা অন্য কোনো কারণে সংলাপ ওভারল্যাপ হওয়ার মতো ঘটনা মামুলি ত্রুটি বলেই বিবেচিত। অন্য ছোটো চরিত্রগুলোর প্রবেশ-প্রস্থানের টাইমিং আরেকটু যথাযথ হতে পারত এই প্রদর্শনীতে। নতুন নাটক, উপরন্তু অনেক দিন বিরতিতে তৃতীয় প্রদর্শনী- আরো কয়েকটি প্রদর্শনী হয়ে গেলে পরে নাটক আরো প্রস্ফুটিত হয়ে উঠবে বলে আশা করা যায়। জ্যোতি সিনহার সংলাপের স্পষ্টতা, সংলাপ প্রক্ষেপণের গতি ও প্রজেকশন খুব সুন্দর লেগেছে। তবে তার চরিত্রটি নিয়ে আরেকটু কিছু যদি খেলতে পারেন তিনি, চরিত্রের কিছু ডাইমেনশন যদি যোগ করা যায়, তবে চরিত্রটিকে আরো জীবন্ত বা মানবিক হয়ে প্রকাশিত হবে। পার্শ্বচরিত্রগুলো নাটকে কমিক রিলিফ হিসেবে ভালো কাজ করেছে। মোটের উপর নাটকটি দেখার অভিজ্ঞতা ছিল খুব চমৎকার এবং দর্শক এই নাট্যাভিজ্ঞতায় নতুনত্বের স্বাদ যে পেয়েছে, তা নির্বিশেষে বলা যায়। রিমান্ড ছিল নাগরিক নাট্যসম্প্রদায় ও মঙ্গলদীপ ফাউন্ডেশন প্রণোদিত হৃৎমঞ্চ রেপার্টরির একটি প্রযোজনা। ‘রিমান্ড’ হচ্ছে হৃৎমঞ্চের তৃতীয় প্রযোজনা। 

লেখা : ধৃমতী ইশানা