প্রথম সংবাদ পাঠের অভিজ্ঞতা স্বপ্নের মতো -শামীম আরা মুন্নী

19 Jun 2023, 01:47 PM সংবাদ উপস্থাপক শেয়ার:
প্রথম সংবাদ পাঠের অভিজ্ঞতা স্বপ্নের মতো  -শামীম আরা মুন্নী

টিভি সংবাদ উপস্থাপনার ক্ষেত্রে স্পষ্ট উচ্চারণ, সুন্দর বাচনভঙ্গি এবং দর্শকপ্রিয়তা বা জনপ্রিয়তার মাপকাঠিতে হাতে গোণা যেক’জন সংবাদ উপস্থাপক এগিয়ে আছেন তাদের মধ্যে একাত্তর টিভির সিনিয়র সংবাদ উপস্থাপক শামীম আরা মুন্নী অন্যতম। প্রায় দুই যুগ ধরে বেতার-টেলিভিশনে অনুষ্ঠান এবং সংবাদ উপস্থাপনার সঙ্গে জড়িত টাঙ্গাইলের মেয়ে শামীম আরা মুন্নী। সরকারি চাকরিজীবী বাবা-মায়ের সন্তান মুন্নী ছেলেবেলায় নাচ শিখেছেন। তার হওয়ার কথা ছিল নৃত্যশিল্পী। কিন্তু হয়ে গেলেন উপস্থাপক। এছাড়া তার গানের গলাও বেশ চমৎকার। গান দারুণ ভালোবাসেন তিনি। বহুমুখী প্রতিভার এই সংবাদ উপস্থাপককে নিয়ে এবারের প্রতিবেদন...

টাঙ্গাইলের মেয়ে শামীম আরা মুন্নী ছেলেবেলায় স্থানীয় শিশু একাডেমিতে নাচ শিখেছেন। ইচ্ছে ছিল অনেক বড়ো নৃত্যশিল্পী হওয়ার। পারিবারিক বাধার কারণে সরকারি চাকরিজীবী বাবা-মায়ের সন্তান মুন্নীর নৃত্যশিল্পী হওয়ার ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও তা হতে পারেননি। হয়েছেন একজন উপস্থাপক। দুই যুগ ধরে বেতার এবং টেলিভিশনে সাফল্যের সঙ্গে অনুষ্ঠান এবং সংবাদ উপস্থাপনা করে চলেছেন। নাচ এবং সংবাদ উপস্থাপনার পাশাপাশি তিনি ভালো গানও করেন। তিনি বিটিভির তালিকাভুক্ত শিল্পী। বিটিভির গীতবিতান অনুষ্ঠানে নিয়মিত রবীন্দ্রসংগীত পরিবেশন করেন। মুন্নী ২০০৮ খ্রিষ্টাব্দে এটিএন বাংলার গানের রিয়েলিটি শো ‘এটিএন ফ্যামিলি স্টার’ চ্যাম্পিয়ন হন। সেখানে রুনা লায়লার একটি গান গেয়েছিলেন তিনি।

সংবাদ উপস্থাপনার সঙ্গে যুক্ত হলেন কীভাবে জানতে চাইলে বলেন, ‘আমি ইত্তেফাকে সংবাদ উপস্থাপনার ওপর একটি কোর্সের বিজ্ঞাপন দেখতে পাই। সেটা ১৯৯৭ খ্রিষ্টাব্দের কথা। সেটি দেখেই কোর্সে ভর্তি হয়ে গেলাম। প্রথমে ভয়ে ভয়ে ছিলাম। স্যারেরা যেভাবে বলতেন শুধু শুনতাম। তারপর আস্তে আস্তে ভয় কেটে যায়। আমি মনোযোগ দিয়ে ক্লাশ করতে থাকি। সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হলো সেই কোর্সে ২৬ জনের মধ্যে আমি প্রথম হই। তখন আমার আত্মবিশ্বাস আরো বহুগুণে বেড়ে যায়। সেই আত্মবিশ্বাস থেকেই আমি বাংলাদেশ বেতারে অডিশন দিই। সেখানে ১৪২ জনের মধ্যে আমিসহ ২জন সুযোগ পাই। তারপর ধাপে ধাপে সিঁড়ি ভাঙতে শুরু করি। একসময় ভাবলাম, বেতারে যখন সুযোগ পেলাম এবার টিভিতে চেষ্টা করি। তারপর বিটিভিতে অডিশন দিলাম। অডিশন দেওয়ার পর যখন রেজাল্টের অপেক্ষা করছিলাম তখন এটিএনে নিউজ চালু হয়ে যায়। এর আগে আমি এটিএন বাংলার তিব্বত ‘তারার দেশে’ নামে চলচ্চিত্র নির্মাণ এবং তথ্যভিত্তিক একটি ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করতাম। ম্যাগাজিনের অনেকগুলো পর্ব আমি উপস্থাপনা করেছি। যার কারণে ক্যামেরা ভীতি আমার কেটে যায়। এরপর এটিএনের চেয়ারম্যান স্যারের সঙ্গে কথা বলার জন্য আমি রিসিপশনে ফোন দিই। ফোনে তার সঙ্গে সংবাদ উপস্থাপক হওয়ার ইচ্ছের কথা জানাই। স্যার বললেন, কালকে চলে আসেন। আমি পরদিন গেলাম। আমি যেদিন গেলাম সেইদিনই আমার কোনো অডিশন ছাড়াই চাকরি হয়ে যায়। আমাকে অবাক করে দিয়ে উনি বলেন, আজকেই আপনি সন্ধ্যা ৭টার খবর পড়বেন। এটা সম্ভব হয়েছে আমি এর আগে এটিএনে অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করেছি, সেই কারণে। এছাড়া বেতারে খবর পড়ি, এটাও আমার জন্য প্লাস পয়েন্ট। আসলে প্রথম দিন আমার খবর পড়া হয়নি। কারণ ছিল আমি সেদিন নীল শাড়ি পরে গিয়েছিলাম। নীল শাড়ি পরে যাওয়ার কারণে পিছনের ক্রমার কালারটা খেয়ে দিচ্ছিল। এই কারণে সেদিন আর খবর পড়তে পারিনি। পরের দিন থেকে খবর পড়তে শুরু করলাম। এর মধ্যে মাঝখানে বিবিসি বাংলায় পাঁচ বছর খবর পড়েছি। এখন তো বিবিসিতে খবর প্রচার হয় না সেজন্য পড়া হয় না। বিবিসি ছিল আমার ভালো লাগার একটা জায়গা। বিবিসির স্টুডিও সেটআপ আধারণ। এখানে চাকরি করে খুব গর্ব অনুভব করতাম। এখানে সম্মান ও সম্মানী দুটোই ভালো ছিল।’

শামীম আরা মুন্নী সংবাদ পাঠ শুরু করেন ১৯৯৮ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশ বেতারের ঢাকা কেন্দ্রের সংবাদ পাঠের মধ্যে দিয়ে। ২০১২ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত বেতারে খবর পড়েছেন। এরপর ২০১৩ থেকে ২০১৭ পর্যন্ত বিবিসি বাংলায় খবর পড়েছেন। ২০০১ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশ টেলিভিশনে সংবাদ উপস্থাপক হিসেবে তালিকাভুক্ত হন। সেখানে যোগদান না করে ওই বছরই এটিএন বাংলায় যোগ দেন। ১৯৯৮ থেকে ২০০১ টানা চার বছর বাংলাদেশ টেলিভিশনের বিভিন্ন অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করেছেন তিনি। বিটিভিতে অনুষ্ঠান উপস্থাপক হিসেবে অডিশন দিয়ে প্রথম হয়েছিলেন। ‘ছায়াছন্দ’, ‘গীতিবিচিত্রা’, ‘মালঞ্চ’, ‘বিনোদন’ ছাড়াও ঈদের বিভিন্ন অনুষ্ঠান, ইসলামি অনুষ্ঠানসহ সব ধরনের অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করেছেন তিনি।

শামীম আরা মুন্নী ২০০১ থেকে ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত এটিএন বাংলায় সিনিয়র সংবাদ উপস্থাপক হিসেবে কাজ করেছেন। বর্তমানে একই পদে একাত্তর টিভিতে কাজ করছেন।

ছেলেবেলায় নাচ শিখতে শিখতে গানের প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠেন মুন্নী। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমি যখন নাচ শিখতাম তখন গানের সঙ্গে আমাকে নাচতে হতো। তখন থেকে গানের সঙ্গে সখ্য। নাচ শিখতে গিয়ে আমাকে বিভিন্ন ধরনের গানের সঙ্গে নাচতে হয়েছে। সেইসময় থেকেই গানের সুর, তাল-লয়ের সঙ্গে আমার পরিচিতি বাড়তে থাকে। বড়ো হয়ে গানের প্রতি আগ্রহ আরো বেড়ে যায়।’

শামীম আরা মুন্নী ২০০৮ খ্রিষ্টাব্দে এটিএন বাংলার গানের রিয়েলিটি শো ‘ফ্যামিলি স্টার’-এ অংশগ্রহণ করে প্রথম হন। সেখান থেকেই শিল্পী হিসেবে তিনি পরিচিতি পান। অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়ার সময়ে প্রয়াত সংগীতশিল্পী লাকী আকন্দ তাকে বেশ উৎসাহ, অনুপ্রেরণা এবং সাহস জুগিয়েছেন। সেই থেকেই গানের প্রতি একটা ভালোবাসা জন্ম নেয় তার ভেতর। তখন থেকেই সংগীতাঙ্গনে সরব হয়ে ওঠেন। তিনি ছায়ানটেও কিছুদিন গান শিখেছেন। এর বাইরে লাকী আকন্দ, ফাহমিদা নবী, মিতা হক, রিপন খানের কাছে গান শিখেছেন। তিনি ফাহমিদা নবীর সঙ্গে ‘কারিগরী’ নামে একটি মিক্সড অ্যালবামে গান গেয়েছেন। বিটিভি, এটিএন বাংলা, এটিএন নিউজ, বিজয় টিভিতে গানের অনুষ্ঠান করেছেন। এছাড়া রিপন খানের সুরে ‘মা’ নামে অসাধারণ একটি গান গেয়েছেন তিনি। গানটি তার মাকে উৎসর্গ করেছেন। মুন্নী কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ ডজন খানেক পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন।

প্রথম সংবাদ পাঠের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে জানতে চাইলে বলেন, ‘আমার প্রথম সংবাদ পাঠের অভিজ্ঞতা স্বপ্নের মতো। স্বপ্ন যখন বাস্তবে পরিণত হয় সেরকম আর কী। তখনকার অনুভূতির কথা আমি আপনাকে বলে বোঝাতে পারবো না। তবে আমি যেহেতু টিভিতে বিভিন্ন অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করতাম এবং সংবাদ উপস্থাপনার ওপর কোর্স কমপ্লিট করে এই পেশায় এসেছি তাই আমার ক্যামেরা ভীতি, উচ্চারণ এগুলোতে কোনো সমস্যা ছিল না। কারণ এইসব ট্রেনিং আমি আগেই নিয়েছি।’

মুন্নী গান এবং উপস্থাপনার বাইরে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব জার্নালিজম অ্যান্ড ইলেকট্রনিক মিডিয়া [বিজেম]-এ সংবাদ পাঠের উপর প্রশিক্ষণ দিয়ে আসছেন। এছাড়া ‘মুন্নীস’ কালেকশন নামের একটি অনলাইন ব্যবসা পরিচালনা করেন। এটা মেয়েদের জন্য শাড়ি, গয়না, থ্রিপিসের অনলাইন ব্যবসা। অবসরে তিনি এখানেই সময় দেন। তার প্রিয় খাবার একদম দেশি, ঘরে রান্না করা সব খাবার। রংধনুর সাতটি রংই তার প্রিয়। আর প্রিয় ঋতু শরৎকাল। 

লেখা : শহিদুল ইসলাম এমেল