মৃণাল সেন একটা প্রজন্মের রাগ ও ঘৃণা ছেপে দিয়েছিলেন তাঁর ছায়াছবিতে মনোজিৎকুমার দাস

21 Jun 2023, 12:58 PM শ্রদ্ধাঞ্জলি শেয়ার:
মৃণাল সেন একটা প্রজন্মের রাগ ও ঘৃণা ছেপে  দিয়েছিলেন তাঁর ছায়াছবিতে  মনোজিৎকুমার দাস

উপমহাদেশের কালজয়ী চলচ্চিত্রকার মৃণাল সেনের জন্মশতবর্ষ ছিল এ বছর ১৪ মে। মৃণাল সেন ১৯২৩ খ্রিষ্টাব্দের ১৪ মে বাংলাদেশের ফরিদপুরে জন্মগ্রহণ করেন। তার স্কুল ও কলেজ জীবন কাটে ফরিদপুরে। তারপর তিনি কলকাতার স্কটিশ চার্চ কলেজ ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষা লাভ করেন। ফরিদপুরেই তার প্রথম চলচ্চিত্র দেখা এবং চলচ্চিত্রের প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠা। ১৯৫৫ খ্রিষ্টাব্দে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘রাতভর’ ছবি দিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ শুরু করলেও ১৯৬০ খ্রিষ্টাব্দে নির্মিত তৃতীয় ছবি ‘বাইশে শ্রাবণ’-ই মৃণাল সেনকে প্রথম জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিচিতি এনে দেয়। ১৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘ভুবন সোম’ তাকে একই সঙ্গে প্রচুর প্রশংসা ও জনপ্রিয়তা এনে দেয়। ‘ক্যালকাটা ৭১’, ‘ইন্টারভিউ’ ও ‘পদাতিক’ তার কলকাতা ট্রিলজির তিনটি ছবি। এরপর একে একে নির্মাণ করেন ‘কোরাস’, ‘ওকা উরি কথা’, ‘একদিন প্রতিদিন’, ‘আকালের সন্ধানে’, ‘খারিজ’, ‘খ-হর’, ‘জেনেসিস’, ‘একদিন আচানক’, ‘মহাপৃথিবী’, ‘অন্তরীণ’, ‘আমার ভুবন’সহ মুগ্ধ করা সব ছবি। তিনি নির্মাণ করেছেন ২৭টি পূর্ণদৈর্ঘ্য, ১৪টি স্বল্পদৈর্ঘ্য ও ৪টি প্রামাণ্যচিত্র। বামপন্থী ভাবধারায় বিশ্বাসী মৃণাল সেন তার ছবিতে দারিদ্র্যপীড়িত মানুষের জীবনকে তুলে ধরেছেন পরম মমতায়। নারী তার ছবিতে এসেছে শুধু নারী হিসেবে নয়, পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে। বাংলাদেশে জন্ম নেওয়া ও এদেশের আলো বাতাসে বেড়ে ওঠা এই মহান চলচ্চিত্রকারের জন্মশতবর্ষে তার প্রতি আমাদের বিন¤্র শ্রদ্ধা...

মৃণাল সেনের ছবিতে দারিদ্র্যের করাল রূপটা দেখি আমরা। এ দারিদ্র্য সর্বগুণবিনাশী ‘ওকা উরি কথা’, ‘কলকাতা ৭১’, ‘আকালের সন্ধানে’। দারিদ্র্যই যেন ভিলেন, যা মানুষের সব মানবিক সম্ভাবনাগুলোকে কুরে কুরে নষ্ট করে দেয়। গল্প বলার রীতির ক্ষেত্রে বাংলা সিনেমার যে ঐতিহ্য বলবৎ ছিল বা এখনো রয়েছে, সে রকম একরৈখিক বয়ানে গল্প বলার সিনেমা বানাতে চাননি মৃণাল সেন। পরিবর্তন চেয়েছেন কেবল বিষয়বস্তুতে নয়, প্রকরণের দিক থেকেও। ভাঙতে চেয়েছেন গল্প বলার প্রচলিত বয়ানকে, যা বিশ্ব চলচ্চিত্রে সেই ফরাসি নিউ ওয়েভ থেকেই প্রচলিত, কিন্তু বাংলা চলচ্চিত্রে ছিল অনেকটাই নতুন। তাই কেবল বিষয়বস্তু নয়, বিষয়টাকে কীভাবে তুলে ধরা, ফ্রিজ শট, মাস্কিং, কখনো একাধিক ফ্লাশব্যাক, নেপথ্যে ধারাভাষ্য, অ্যানিমেশন অথবা নিউজ পেপার কাটিং দেখিয়ে একধরনের কোলাজ চলচ্চিত্র যেন নির্মাণ করে গেছেন মৃণাল সেন ।

১৯৫৫ খ্রিষ্টাব্দে মৃণাল সেনের প্রথম পরিচালিত ছবি ‘রাতভর’ মুক্তি পায়। এ ছবিটি বেশি সাফল্য পায়নি। তার দ্বিতীয় ছবি ‘নীল আকাশের নিচে’ তাকে স্থানীয় পরিচিতি এনে দেয়। তার তৃতীয় ছবি ‘বাইশে শ্রাবণ’ থেকে তিনি আন্তর্জাতিক পরিচিতি পান। ১৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দে তার পরিচালিত ছবি ‘ভুবন সোম’ মুক্তি পায়।

কিংবদন্তিতুল্য চলচ্চিত্র পরিচালক মৃণাল সেন। তিনি চিত্রনাট্যকার ও লেখক। সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে এক বন্ধনীতে উচ্চারিত হয় তার নামও।

১৯২৩ খ্রিষ্টাব্দের ১৪ মে বাংলাদেশের ফরিদপুরে জন্ম মৃণাল সেনের। ফরিদপুরে থাকাকালীন তিনি সেখানেই উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষা সম্পন্ন করেন। ফরিদপুরের রাজেন্দ্র কলেজে পড়াশোনা শেষ করে তিনি কলকাতায় চলে যান। পদার্থবিদ্যা নিয়ে স্কটিশ চার্চ কলেজে পড়াশোনা করেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন।

চল্লিশের দশকে তিনি সমাজবাদী সংস্থা ইন্ডিয়ান পিপলস থিয়েটার অ্যাসোসিয়েশনের সঙ্গে যুক্ত হন এবং এর মাধ্যমে তিনি সমমনা মানুষদের কাছাকাছি আসেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা শেষ করে তিনি সাংবাদিক, ওষুধ বিপণনকারী এবং চলচ্চিত্রে শব্দকুশলী হিসেবেও কাজ করেন। আজীবন বামপন্থায় বিশ্বাসী মৃণাল সেন কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়ার সাংস্কৃতিক কাজকর্মের সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। কিন্তু কখনো পার্টির সদস্য হননি। পরে রাষ্ট্রপতির মনোনীত সদস্য হিসেবে মৃণাল সেন ভারতের পার্লামেন্টেও গেছেন।

আবার তার নির্মিত ছবির কথায় আসা যাক। ১৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দে তার পরিচালিত ছবি ‘ভুবন সোম’ মুক্তি পায়। এই ছবিতে বিখ্যাত অভিনেতা উৎপল দত্ত অভিনয় করেছিলেন। এই ছবিটি অনেকের মতে মৃণাল সেনের শ্রেষ্ঠ ছবি। তার কলকাতা ট্রিলোজি অর্থাৎ ইন্টারভিউ [১৯৭১], কলকাতা ৭১ [১৯৭২] এবং পদাতিক [১৯৭৩] ছবি তিনটির মাধ্যমে তিনি তৎকালীন কলকাতার অস্থির অবস্থাকে তুলে ধরেছিলেন।

আর ‘কলকাতা ৭১’-এর তিনটি পর্বেই রয়েছে বঞ্চিত ব্যক্তিদের বেঁচে থাকার লড়াই ও দ্বন্দ্ব, যেখানে কুড়ি বছরের প্রতিবাদী এক তরুণকে গুলি করে হত্যা করা হয়। সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থাকে এ রকম এক দৃষ্টিতে দেখা মৃণাল সেনের পক্ষে স্বাভাবিকই ছিল। কারণ, তিনি জীবন শুরুই করেছিলেন একজন মার্ক্সবাদী হিসেবে ।

মার্ক্সীয় দ্বান্দ্বিকতার তত্ত্ব, সেই থিসিস-অ্যান্টিথিসিস আর সিনথেসিসের এক প্রাথমিক পাঠ দেখি ‘জেনেসিস’ ছবিতে, যেখানে এক বিরান প্রান্তরে এক কৃষক, এক তাঁতি এবং এক রমণীর প্রতি তাদের অধিকারবোধে জেগে ওঠে ব্যক্তিগত সম্পত্তির ধারণা, ‘ভাগ কর ও শাসন কর’-এর চিরন্তন সেই নীতির প্রকাশ। ‘একদিন প্রতিদিন’ হচ্ছে ‘ভুবন সোম-এর মতোই মৃণাল সেনের আরেকবার মোড় ফেরা। ফিরে এলেন তিনি বাঙালি মধ্যবিত্তের কাছে ; বরং বলা চলে বাঙালি মধ্যবিত্তের মূল্যবোধের সংকটের কাছে। বাড়ির তরুণী মেয়েটি রাতে বাড়ি ফিরে এল না। টান টান চিত্রনাট্য, গীতা সেন- শ্রীলা মজুমদারের দৃষ্টিকাড়া অভিনয় ও সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম মানব-অনুভূতিগুলো তুলে ধরে মৃণাল সেন আমাদের মধ্যবিত্ত অস্তিত্বের পাশেই যে মুখ ব্যাদান করা এক বিশাল অন্ধকার খাদ রয়েছে, তার মুখোমুখি করলেন। মেয়েটি সারারাত বাড়ি ফেরেনি। কোথায় ছিল সে ? মৃণাল সেন বলেননি। কেবল আমাদের মধ্যবিত্তদের সম্মানের নিরাপত্তার প্রতি এক বিরাট প্রশ্ন ছুড়ে মেরেছেন। বিষয়টি আরো সূক্ষ্মতায় ফুটেছে ‘খারিজ’-এ। অর্থনীতির নোংরা সুতাগুলোর আড়ালে মধ্যবিত্তের দ্বিচারিতা যেন আরো নগ্নভাবে তুলে ধরলেন মৃণাল সেন ; বরং যে মর্যাদাবোধ নিয়ে মৃত কাজের ছেলেটির গ্রাম থেকে আসা বাবা বিদায় নিল, তা যেন মধ্যবিত্তের সব ঠুনকো মর্যাদাবোধকেই এক প্রচ- চপেটাঘাত করে গেল। লন্ডনের গার্ডিয়ান লেকচারে সত্যজিৎ রায় এক প্রশ্নের উত্তরে বলেছিলেন, ‘মৃণাল সেন হিটস সেফ টার্গেটস।’ বাঙালি মধ্যবিত্তদের নিয়ে মৃণাল সেন কিন্তু এসব ছবিতে খুব সফলভাবেই তাঁর টার্গেটগুলোর বিবেককে চাবুক মারতে সক্ষম হয়েছেন।’

কোনো কোনো ছবিতে মধ্যবিত্ত অস্তিত্বের আরো গভীরে চলে যান মৃণাল সেন, প্রায় আস্তিত্বিক স্তরে। ‘একদিন আচানক’-এ নিরুদ্দেশ হওয়া অধ্যাপকের মেয়েটি ওই যে বলেছিল, ‘বাবা বুঝতে পেরেছিল, বাবা খুব সাধারণ। আর সাধারণ হিসেবে সারাজীবন কাটানো খুব কষ্টকর। বাবা আর ফিরবে না।’ মৃণাল সেন যেন বারবারই মধ্যবিত্তকে তাদের লোভ, উচ্চাকাক্সক্ষা ও উচ্চম্মন্যতার ঠুনকোপনা সম্পর্কে সচেতন করতে চাইছেন, এসব ছেড়ে তাদের সমাজ বদলানোর বিষয়ে সচেতন করতে চাইছেন, লড়াইয়ে উদ্বুদ্ধ করতে চাইছেন। আঙ্গিক নিয়ে এক বড়ো নিরীক্ষা করেছেন মৃণাল সেন অনেক ছবিতেই। বিশেষ করে ‘আকালের সন্ধানে’তে। গল্প বলার এ এক ভিন্নধর্মী বয়ান ‘আ ফিল্ম উইদিন আ ফিল্ম’। বিষয়টাও ওর প্রিয় এক বিষয় পঞ্চাশের মন্বন্তর এবং বাংলার জনজীবনে এ মন্বন্তরের প্রতিঘাত। সেদিক থেকে তাঁর সবচেয়ে অমৃণালীয় ছবি হচ্ছে ‘খ-হর’। শ্রেণির সংঘাত নেই, দারিদ্র্যের নির্মমতা নেই, বড়ো কোনো দ্বন্দ্বও নেই। তবে সবচেয়ে বিষণœ এক ছবি। এক ভগ্নস্তূপে এক বিষাদময়ী নারীর এক করুণ জীবনগাথা। গভীরভাবে মানবিক এক ছবি। ঠিক প্রত্যক্ষ রাজনীতি নয়, মহাকালই যেন ছবির বিষয়, মৃণাল সেনের শেষের দিককার ওই ছবিটি ‘মহাপৃথিবী’।

সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে পড়ছে, বদলে যাচ্ছে পূর্ব ইউরোপ। বাড়ির ছেলেটি নকশাল আন্দোলনে মৃত। ছেলেটি, ছেলেটির মা, পরিবারটি, গোটা এক প্রজন্মই তো বিশ্বাস করেছিল সমাজতন্ত্রে, আত্মহত্যার ডায়েরিতে মায়ের অভিমান, ‘বুলু, তোরা কি সব মিথ্যে হয়ে যাবি ?’ এ তো শুধু এক মায়ের প্রশ্ন নয়, শোষণহীন এক সমাজের স্বপ্ন দেখা কয়েক প্রজন্মেরই জিজ্ঞাসা ও অভিমান। ‘র‌্যাডিক্যাল’, ‘মার্ক্সবাদী’, ‘ডকট্রিনের’ এরকম নানা বিশেষণই মৃণাল সেন পেয়েছেন তাঁর জীবদ্দশায়। সেসব হয়তো আংশিক সত্যও।

মধ্যবিত্ত সমাজের নীতিবোধকে মৃণাল সেন তুলে ধরেন তার খুবই প্রশংসিত দুটি ছবি ‘একদিন প্রতিদিন’ [১৯৭৯] এবং ‘খারিজ’ [১৯৮২]-এর মাধ্যমে। ‘খারিজ’ ১৯৮৩ খ্রিষ্টাব্দের কান আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে বিশেষ জুরি পুরস্কার পেয়েছিল। ১৯৮০ খ্রিষ্টাব্দের চলচ্চিত্র ‘আকালের সন্ধানে’। এ ছবিতে দেখান হয়েছিল একটি চলচ্চিত্র কলাকুশলী দলের একটি গ্রামে গিয়ে ১৯৪৩ খ্রিষ্টাব্দের দুর্ভিক্ষের ওপর চলচ্চিত্র তৈরির গল্প। কীভাবে ১৯৪৩-এর দুর্ভিক্ষের কাল্পনিক কাহিনি মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় সেই গ্রামের সাধারণ মানুষদের সঙ্গেÑ সেটাই ছিল এ চলচ্চিত্রের সারমর্ম। ‘আকালের সন্ধানে’ ১৯৮১ খ্রিষ্টাব্দের বার্লিন আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে বিশেষ জুরি পুরস্কার হিসেবে রুপার ভালুক জয় করেন তিনি। মৃণাল সেনের পরবর্তীকালের ছবির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘মহাপৃথিবী’ [১৯৯২] এবং ‘অন্তরীণ’ [১৯৯৪]। তার শেষ ছবি ‘আমার ভুবন’ মুক্তি পায় ২০০২ খ্রিষ্টাব্দে। তার পরিচালিত অন্য ছবিগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘পুনশ্চ’ [১৯৬১], ‘অবশেষে’ [১৯৬৩], ‘প্রতিনিধি’ [১৯৬৪], ‘আকাশ কুসুম’ [১৯৬৫], ‘এক আধুরি কাহানী’ [১৯৭১], ‘কোরাস’ [১৯৭৪], ‘মৃগয়া’ [১৯৭৬], ‘পরশুরাম’ [১৯৭৮], ‘চালচিত্র’ [১৯৮১], ‘খ-হর’ [১৯৮৩]।

মৃণাল সেন বাংলা ভাষা ছাড়াও হিন্দি, উড়িয়া ও তেলেগু ভাষায় চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন। ১৯৬৬ খ্রিষ্টাব্দে উড়িয়া ভাষায় নির্মাণ করেন ‘মাটির মানিশ’, যা কালীন্দিচরণ পাণিগ্রাহীর গল্প অবলম্বনে নির্মিত হয়। ১৯৬৯-এ বনফুলের কাহিনি অবলম্বনে হিন্দি ভাষায় নির্মাণ করে ‘ভুবন সোম’। ১৯৭৭ খ্রিষ্টাব্দে প্রেম চন্দের গল্প অবলম্বনে তেলেগু ভাষায় নির্মাণ করেন ‘ওকা ওরি কথা’। ১৯৮৫ খ্রিষ্টাব্দে নির্মাণ করেন ‘জেনেসিস’Ñ যা হিন্দি, ফরাসি ও ইংরেজি তিনটি ভাষায় তৈরি হয়।

মৃণাল সেনের সিনেমা হচ্ছে সিনেমা অব আইডিয়াজ, গল্পটা মূল নয়। গল্পের পেছনে মৃণাল সেনের বক্তব্যটাই প্রধান। একটার পর একটা ছবিতে মৃণাল সেন আমাদের যে পাথুরে বাস্তবতার কাছে এনে দাঁড় করান, সেখানে এই সত্যটাই মূল, যে সমাজ শ্রেণিবিভক্ত। মুন্সী প্রেমচান্দের ‘কাফন’ গল্পটির ভিন্ন এক দৃশ্যায়ন করলেন মৃণাল সেন তেলেগু ভাষায় ‘ওকা উরি কথা’। হতদরিদ্র চরিত্রটি বিশ্বাস করে শ্রম বৃথা, কারণ তা সম্পদশালীদের সম্পদ বৃদ্ধি করে মাত্র। তাঁর প্রথম রঙিন ছবি ‘মৃগয়া’তে দেখালেন সাঁওতাল বিদ্রোহের ইঙ্গিত ও কারণ। দেখালেন কীভাবে আদিবাসীদের সারল্যকে শোষণ করে ধুরন্ধর নাগরিক সভ্যতা।

১৯৯৩ খ্রিষ্টাব্দে বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাকে সম্মানসূচক ডিলিট পদকে ভূষিত করে। ১৯৯৬ ও ১৯৯৯ খ্রিষ্টাব্দে যথাক্রমে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় ও রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় তাকে একই সম্মান জানান। পদ্মভূষণ, দাদাসাহেব ফালকেসহ নানাবিধ পুরস্কার রয়েছে পরিচালক মৃণাল সেনের ঝুলিতে। ২০০০ খ্রিষ্টাব্দে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন তাকে গার্ড অব ফ্রেন্ডশিপ সম্মানে ভূষিত করেন।

সবার ওপরে মৃণাল সেন একজন সৃজনশীল শিল্পী, একজন রাগী শিল্পী, যিনি দর্শকদের দিকে তীক্ষè প্রশ্ন ছুড়ে দিতে ভালোবাসেন ‘ইন্টারভিউ’, ‘কলকাতা ৭১’, ‘একদিন প্রতিদিন’, ‘খারিজ’। আর সচেষ্ট থাকেন দর্শকের আত্মসন্তুষ্টিকে ভেঙে দিয়ে তাদের মানবিক বিবেকবোধকে জাগ্রত করতে। মৃণাল সেনকে চলচ্চিত্রের ইতিহাসে তাই সব সময়ই স্মরণ করা হবে। বাঙালি মধ্যবিত্তদের নিয়ে মৃণাল সেন কিন্তু এসব ছবিতে খুব সফলভাবেই তাঁঁর টার্গেটগুলোর বিবেককে চাবুক মারতে সক্ষম হয়েছেন। কোনো কোনো ছবিতে মধ্যবিত্ত অস্তিত্বের আরো গভীরে চলে যান মৃণাল সেন, প্রায় আস্তিত্বিক স্তরে।

স্মরণ করা হবে সিনেমাশিল্প মাধ্যমটির ওপর সুদক্ষ দখলের একজন নির্মাতা হিসেবে, যিনি সিনেমার আঙ্গিক নিয়ে নিরীক্ষা করতে ভালোবাসতেন, ভালোবাসতেন আমাদের বিবেক ও সমাজের কাছে সদাই কিছু তির্যক মন্তব্য ছুড়ে দিতে। আর আমাদের দুই পারের বাঙালিদের কাছেই মৃণাল সেন এমন একজন প্রিয় শিল্পী হিসেবে রয়ে যাবেন, যিনি যত দিন খেলেছেন, উইকেটের চারিধারে পিটিয়ে খেলেছেন, সব ধরনের শট খেলতে জানতেন। দুঃখজনকভাবে নব্বইয়ের ঘরে তিনি আটকে গেলেন। শতায়ু হতে পারলেন না। এ আক্ষেপ তো আমাদের আজীবন রয়েই যাবে !

তার চলে যাওয়া : ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দের ৩০ ডিসেম্বর এ কিংবদন্তিতুল্য চলচ্চিত্রকার পরপারে পাড়ি জমান। বেশ কিছুদিন ধরে তিনি বার্ধক্যজনিত রোগে ভুগছিলেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৯৫ বছর।

বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত ‘মৃণাল সেন জন্ম শতবার্ষিকী’ স্মরণিকা থেকে সংকলিত 


মৃণাল সেনের সৃষ্টিকর্ম

পূর্ণদৈর্ঘ্য কাহিনিচিত্র [২৮টি]

১. রাতভোর- ১৯৫৫। ২. নীল আকাশের নীচে - ১৯৫৯। ৩. বাইশে শ্রাবণ- ১৯৬০। ৪. পুনশ্চ- ১৯৬১। ৫. অবশেষে - ১৯৬৩। ৬. প্রতিনিধি - ১৯৬৪। ৭. আকাশ কুসুম - ১৯৬৫। ৮. মাটির মনীষ [ওরিয়া] - ১৯৬৬। ৯. ভুবন সোম - ১৯৬৯। ১০. ইন্টারভিউ - ১৯৭০। ১১. এক আধুরি কাহানি [হিন্দি] - ১৯৭১। ১২. ক্যালকাটা ৭১ - ১৯৭২। ১৩. পদাতিক - ১৯৭৩। ১৪. কোরাস - ১৯৭৪। ১৫. মৃগয়া [হিন্দি] - ১৯৭৫। ১৬. ওকা উরি কথা [তেলেগু] - ১৯৭৭। ১৭. একদিন প্রতিদিন - ১৯৮০। ১৮. পরশুরাম - ১৯৮০। ১৯. আকালের সন্ধানে - ১৯৮২। ২০. চালচিত্র - ১৯৮১। ২১. খারিজ - ১৯৮২। ২২. খ-হর [হিন্দি] - ১৯৮৩। ২৩. জেনেসিস [হিন্দি, ফরাসি ও ইংরেজি] - ১৯৮৬। ২৪. একদিন আচানক [হিন্দি] - ১৯৮৯। ২৫. মহাপৃথিবী - ১৯৯১। ২৬. অন্তরীণ - ১৯৯৩। ২৭. আমার ভুবন - ২০০২।


স্বল্পদৈর্ঘ্য চিত্র/ টিভি চলচ্চিত্র [১৫টি]

১. ইচ্ছাপূরণ - ১৯৭০। ২. তসবির আপনি আপনি - ১৯৮৪ [টিভি চলচ্চিত্র]। ৩. টিভি ধারাবাহিক ১৩ টি - দশ সাল বাদ, আজনবি, সওয়াল, সালগির, দো বহেন, আজকাল, রবিবার, আয়না, সোমবারা, কভি দূর কভি পাস, অপরাজিত, সয়ম্ভর, জিৎ - ১৯৮৬-৮৭।


তথ্যচিত্র [৪টি]

১. মুভিং পাস্পেক্টিভ [ইংরেজি] - ১৯৬৪। ২. ত্রিপুরা প্রসঙ্গ - ১৯৬৪। ৩. সিটি লাইভ, ক্যালক্যাটা মাই এলডোরাডো [ইংরেজি] - ১৯৯০। ৪. অ্যান্ড দ্য শো গোজ অন [ইংরেজি] - ১৯৯৬।


চিত্রনাট্য [অন্যের পরিচালনায়]

১. রাজধানী থেকে - ১৯৫৮। ২. কানামাছি - ১৯৬১।

৩. জোরাদীঘির চৌধুরী পরিবার - ১৯৬৬।

৪. কাচ কাটা হীরে - ১৯৬৬।


প্রকাশিত গ্রন্থ

১. চীট [অনুবাদ, মূল - ক্যারেল চ্যাপেক] - ১৯৪৬। ২. চার্লি চ্যাপলিন - ১৯৫৩। ৩. আমি ও চলচ্চিত্র - ১৯৭২। ৪. চলচ্চিত্র : ভূত বর্তমান ভবিষ্যৎ - ১৯৭৭ । ৫. ভিউজ অন সিনেমা - ১৯৭৭। ৬. সিনেমা, আধুনিকতা - ১৯৯২। ৭. মন্তাজ : লাইফ পলেটিক্স সিনেমা - ২০০২। ৮. অলয়েজ বিয়িং বর্ণ - এ মেমোয়ার - ২০০৪।


প্রকাশিত চিত্রনাট্য

১. দ্য রুইন্স [১৯৮৪, ইংরেজি, সীগাল বুক্স] । ২. অকালের সন্ধানে [১৯৮২, বিভব]। ৩. ইন সার্চ অব ফেমিন [১৯৮৫, ইংরেজি, সিগাল বুকস] । ৪. অন্তরীণ [১৯৯৭, বিতর্ক]। ৫. দ্য অ্যাবসেন্স ট্রিলজি [১৯৯৯, সিগাল বুক্স]। ৬. চিত্রনাট্য [২০০৪, পুনশ্চ]। ৭. আমার ভুবন [২০০৪, দেজ পাবলিশিং]।