চিরনিদ্রায় অভিনেতা ফারুক

21 Jun 2023, 01:22 PM শ্রদ্ধাঞ্জলি শেয়ার:
চিরনিদ্রায় অভিনেতা  ফারুক

বাংলা চলচ্চিত্রের ‘মিয়া ভাই’ খ্যাত অভিনেতা বীর মুক্তিযোদ্ধা আকবর হোসেন পাঠান [ফারুক] ১৫ মে, ২০২৩ সোমবার সকালে সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য ২০২১ খ্রিষ্টাব্দের মার্চ মাসে সিঙ্গাপুরে যান তিনি। পরীক্ষায় তার রক্তে সংক্রমণ ধরা পড়ে। এরপর থেকেই শারীরিকভাবে অসুস্থতা অনুভব করছিলেন তিনি।

চিকিৎসকের পরামর্শে তখন দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি করা হয় তাকে। তখন থেকেই সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে শুরু করেন তিনি। সেখানে দুই বছর চিকিৎসাধীন ছিলেন তিনি। ১৬ মে, মঙ্গলবার সকাল ৭টা ৫০ মিনিটে সিঙ্গাপুর থেকে একটি ফ্লাইটে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে তার মরদেহ আসে। সেখান থেকে নেওয়া হয় তার উত্তরার বাসভবনে। এরপর সকাল ১১টা ৫০ মিনিটে নেওয়া হয় কেন্দ্রীয় শহিদমিনারে।

দুই বছরেরও বেশি সময় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন তিনি। চলতি বছর কিছুটা সেরেও উঠছিলেন, কথা ছিল দেশে ফেরার। কিন্তু নিয়তি আর ফিরতেই দিল না তাকে। ফিরেছে তার নিথর দেহ। ঢাকাই সিনেমার অভিনেতা ফারুকের মৃত্যুতে শোকের ছায়া নেমে এসেছে চলচ্চিত্রপাড়াসহ গোটা শোবিজ জগতে।

১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দের ১৮ আগস্ট ঢাকার অদূরে মানিকগঞ্জ জেলার ঘিওরে জন্ম তার। বেড়ে উঠেছেন পুরান ঢাকার অলিগলিতে। বাবা আজগার হোসেন পাঠানের পাঁচ মেয়ে ও দুই ছেলের মধ্যে ফারুক ছিলেন সবার ছোটো ও সবচেয়ে ডানপিটে।

ছাত্রজীবনেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও পাড়া-মহল্লায় নাটকে অভিনয় করতেন ফারুক। সিনেমা অঙ্গনে প্রবেশ করেন ‘জলছবি’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে। প্রথম সিনেমাতেই তার বিপরীতে অভিনয় করেছিলেন বাংলা চলচ্চিত্রের মিষ্টি মেয়েখ্যাত কবরী। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে। উপহার দিয়েছেন একের পর এক জনপ্রিয় সিনেমা। তবে সবচেয়ে জনপ্রিয় জুটি গড়েছিলেন ববিতার সাথে।

ফারুকের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে জনপ্রিয় অভিনেত্রী ববিতা বলেন, আমরা একসঙ্গে অনেক ছবিতে কাজ করেছি। ফারুক ভাইয়ের সঙ্গে আমার প্রথম সিনেমা ছিল ‘আলোর মিছিল’। ছবিটি সুপার ডুপার হিট হয়েছিল। আমার মনে হয়, আমি ফারুক ভাইয়ের সঙ্গে ৩০-৪০টি ছবিতে কাজ করেছি।

তিনি কাজ করেছেন বাংলাদেশের পরিচালক খান আতাউর রহমান, নারায়ণ ঘোষ, স্বপন ঘোষ, আজিজুর রহমান, আমজাদ হোসেনসহ গুণী পরিচালকদের সঙ্গে। তাদের হাত ধরেই উপহার দিয়েছেন একের পর এক কালজয়ী সিনেমা। প্রায় ১০০ সিনেমায় অভিনয় করেছেন তিনি। যার মধ্যে বেশিরভাগই দর্শকের মন জয় করেছে।

অভিনয়ে বিশেষ অবদান রাখায় প্রথম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান ১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দে নারায়ণ ঘোষ মিতা পরিচালিত ‘লাঠিয়াল’ সিনেমায় অভিনয়ের জন্য। চলচ্চিত্রে সামগ্রিক অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার আজীবন সম্মাননা প্রদান করেন তাকে। এছাড়া বাচসাস’সহ অগণিত গুরুত্বপূর্ণ সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন তিনি।

বীর মুক্তিযোদ্ধা ও শক্তিমান অভিনেতা সোহেল রানা বলেন, ফারুক আমার খুব কাছের ছিল। একের পর এক সিনেমায় নিজের প্রতিভা যেভাবে দেখিয়েছে গ্রামের প্রতিবাদী যুবকের চরিত্র নিয়ে ফারুক যেভাবে বাংলাদেশের মানুষের অন্তরে ঢুকে গেছে তা অবিস্মরণীয়। আরেকটা ফারুককে পেতে আমাদের হয়ত আরো অনেকদিন অপেক্ষা করতে হবে।

ফারুকের আরেক সহশিল্পী জনপ্রিয় নায়িকা রোজিনা স্মৃতিচারণ করে বলেন, আমি ভাবতেও পারছি না যে উনি আর নেই। ভাষা হারিয়ে ফেলেছি। বাংলা চলচ্চিত্রের একজন প্রবাদপ্রতিম শিল্পী ও একজন বড়োমাপের মানুষকে হারালাম। একজন অভিভাবককে হারালাম। এই শূন্যস্থান পূরণ হওয়ার মতো নয়। তিনি হয়ত আর নেই তবে তার কর্ম চিরকাল বেঁচে থাকবে বাংলার মানুষের মনে।

ফারুকের মরদেহ শহিদমিনারে রাখা হয়। শহিদমিনারে শুরুতে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের পক্ষে লে. কর্নেল সৈয়দ মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান। এরপর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষে শ্রদ্ধা জানান তার সামরিক সচিব মেজর জেনারেল কবীর আহাম্মদ। স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীর পক্ষে শ্রদ্ধা জানান সংসদ সচিবালয়ের সার্জেন্ট অ্যাট আর্মস এম এম নাঈম রহমান। আওয়ামী লীগের পক্ষে দলটির সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের নেতৃত্বে দলের নেতারা ফারুকের মরদেহে শ্রদ্ধা জানান। এছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মো. আখতারুজ্জামান, মহানগর আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোট, গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনসহ নানা রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক সংগঠনের পক্ষ থেকে ফারুককে শ্রদ্ধা জানানো হয়।

অভিনয়শিল্পীদের মধ্যে শ্রদ্ধা জানাতে শহিদমিনারে উপস্থিত ছিলেন ইলিয়াস কাঞ্চন, ফেরদৌস, মিশা সওদাগর, নিপুণ, জায়েদ খানসহ আরো অনেকে।

শহিদমিনারের আনুষ্ঠানিকতা শেষে ফারুকের মরদেহ নেওয়া হয় তার দীর্ঘদিনের কর্মস্থল এফডিসিতে। সেখানে দ্বিতীয় জানাজা [সিঙ্গাপুরে প্রথম জানাজা অনুষ্ঠিত হয়] শেষে তাকে শেষবারের মতো বিদায় জানান সহকর্মী শিল্পী, নির্মাতা, প্রযোজক ও কলাকুশলীরা। এরপর চ্যানেল আই প্রাঙ্গণে ফারুকের তৃতীয় নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়।

বিকালে গুলশানের আজাদ মসজিদে তার আরো একটি জানাজা শেষে মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় ফারুকের গ্রামের বাড়ি গাজীপুরের কালীগঞ্জে। গাজীপুরের কালীগঞ্জের সোম টিওরী কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ সংলগ্ন ঈদগাহ ময়দানে তার সবশেষ জানাজা অনুষ্ঠিত হলে পারিবারিক কবরস্থানে বাবার কবরের পাশে সমাহিত করা হয় ফারুককে। এ সময় রাজনৈতিক ব্যক্তি, বীর মুক্তিযোদ্ধা, বাংলাদেশ চলচ্চিত্র অঙ্গনের ব্যক্তি, সাংবাদিক, চিত্রনায়ক ফারুকের আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব ও এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত ছিলেন।

জানা গেছে, জীবিত অবস্থায় চিত্রনায়ক ফারুক অসিয়ত করে গেছেন, যেন মৃত্যুর পর তাকে পারিবারিক কবরস্থানে তার বাবা আজগর হোসেন পাঠানের কবরের পাশে দাফন করা হয়। সেই কথা অনুযায়ী তাকে তাদের পারিবারিক কবরস্থানে বাবার পাশে কবর দেওয়া হয়েছে।

অভিনয় ক্যারিয়ার

গুণী এই অভিনেতা ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে এইচ আকবর পরিচালিত ‘জলছবি’ চলচ্চিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমে বাংলা চলচ্চিত্রে যাত্রা শুরু করেন। এরপর ১৯৭৩ খ্রিষ্টাব্দে খান আতাউর রহমান পরিচালিত ‘আবার তোরা মানুষ হ’ ও ১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দে নারায়ণ ঘোষ মিতা পরিচালিত ‘আলোর মিছিল’ দুটি মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক চলচ্চিত্রে পার্শ্ব চরিত্রে অভিনয় করেন। ১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দে গ্রামীণ পটভূমিতে নির্মিত ‘সুজন সখি’ ও ‘লাঠিয়াল’ চলচ্চিত্র দুটি ব্যবসাসফল ও আলোচিত হয়। ‘লাঠিয়াল’ চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য তিনি শ্রেষ্ঠ পার্শ্ব অভিনেতা বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন। পরের বছর ১৯৭৬ খ্রিষ্টাব্দে মুক্তি পায় তার অভিনীত তিনটি ছবি ‘সূর্যগ্রহণ’, ‘মাটির মায়া’ ও ‘নয়নমনি’। চলচ্চিত্র তিনটি বিভিন্ন বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করে। ১৯৭৮ খ্রিষ্টাব্দে শহীদুল্লাহ কায়সার রচিত কালজয়ী উপন্যাস সারেং বৌ অবলম্বনে নির্মিত ‘সারেং বৌ’ ও আমজাদ হোসেন পরিচালিত ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’ চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। চলচ্চিত্র দুটি নারীকেন্দ্রিক হলেও তার অভিনয় সমালোচকদের প্রশংসা অর্জন করে। ১৯৭৯ খ্রিষ্টাব্দে তার অভিনীত ‘দিন যায় কথা থাকে’, ‘নাগরদোলা’, ‘কথা দিলাম’, ‘মাটির পুতুল’, ‘সাহেব’, ‘ছোট মা’, ‘এতিম’, ‘ঘরজামাই’Ñ চলচ্চিত্রগুলো ব্যবসাসফল হয়। ১৯৮০ খ্রিষ্টাব্দে ‘সখী তুমি কার’ ছায়াছবিতে শাবানার বিপরীতে শহুরে ধনী যুবকের চরিত্রে অভিনয় করে সমালোচকদের প্রশংসা লাভ করেন। ১৯৯০ খ্রিষ্টাব্দে ‘মিয়া ভাই’ চলচ্চিত্রের সাফল্যের পর তিনি চলচ্চিত্রাঙ্গনে ‘মিয়া ভাই’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন।


রাজনীতি

গুণী এই ব্যক্তিত্ব স্কুলজীবন থেকে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। ১৯৬৬ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ছয় দফা আন্দোলনে যোগ দেন এবং এ সময়ে তার নামে প্রায় ৩৭টি মামলা দায়ের করা হয়। ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দে অনুষ্ঠিত একাদশ বাংলাদেশের সাধারণ নির্বাচনে ঢাকা-১৭ সংসদীয় আসন থেকে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী হিসেব নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন এবং সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। 

লেখা : শেখ সেলিম