ইউরোপের ১৫০ দিন -সৈয়দা তাসলিমা আক্তার

23 Jul 2023, 01:10 PM ভ্রমন শেয়ার:
ইউরোপের ১৫০ দিন -সৈয়দা তাসলিমা আক্তার

[পূর্ব প্রকাশিতের পর]


বলছিলাম বার্গেনে আমাদের এলোমেলো ঘুরে বেড়ানোর গল্প, আমি আর ফারজানা প্রায়ই ভিন্ন ভিন্ন রুটের বাসে চড়ে চলে যেতাম অজানা কোনো গন্তব্যে। কখনও পৌঁছে যেতাম বিশাল কোনো শপিং মলে, কখনো সবুজ চাদরে মোড়া কোনো বিজন প্রান্তরে, কখনো রুক্ষ পাথুরে জঙ্গলে আবার কখনো সাজানো গোছানো রূপকথার মতো পরিপাটি ছোট্ট কোনো জনপদে, যাকে আমরা বাঙালিরা পাড়া বলে থাকি। বেশিরভাগ সময়েই আমাদের অভিযান শেষ হতো সুন্দর আর প্রশান্তিকর কোনো গন্তব্যে গিয়ে। তবে, ব্যতিক্রম যে হয়নি তা কিন্তু নয়। হয়েছে, তবে তা হাতে গোনা। যা হোক, এবারের অভিযানের গল্পে ফিরে আসি। তবে, এখন আর বাসের নাম্বার বা রোড নাম্বার এমন কি জায়গার নামও মনে করতে পারব না, অবশ্য বার্গেনের জায়গার নাম মনে রাখার চেষ্টা বিশাল ঝক্কিও ; কেননা, নরোজিয়ান উচ্চারণে অধিকাংশ জায়গার নামই আমার কাছে বেশ খটমট আর জটিল মনে হতো, শুধু দিন যাপনের প্রয়োজনে অথবা প্রায়শ যে জায়গাগুলোতে যেতে হতো সে জায়গাগুলোর নাম প্রয়োজনের তাগিদেই আমাদের কণ্ঠস্থ হয়েছিল।

যেখানটায় বাস আমাদের নামিয়ে দিলো সেটা সম্ভবত শহরের কোনো প্রান্ত হবে। এরপর পিচঢালা সরু একটি পথ, পথ ধরে কিছুটা এগিয়ে গেলেও এখানে জনমানুষের চলাচলের কোনো হদিস মিলল না। এমনিতেই বার্গেনের জনসংখ্যা বেশ কম। শহরের ব্যস্ত সড়কগুলো ছাড়া এমন অলিগলিতে হঠাৎ হঠাৎ দু’-একজন পথচারীর দেখা মেলে, তবে সহসা মানুষের দেখা না মিললেও চলাচলের চিহ্ন চোখে পড়ে, কিন্তু এখানটায় এসে কেমন যেন পরিত্যক্ত অথবা পরিজনহীন একটা অনুভূতি হচ্ছিল, তাই আর না এগোনোটাই যুক্তিযুক্ত মনে হলো। আমরা যেখানটায় বাস থেকে নামলাম তা আসলেই চলমান পথের শেষ সীমা এবং এখান থেকে শহরের ফেরার কোনো যান পাওয়া যাবে না, ভাগ্যক্রমে দেখা পাওয়া একজন পথচারীর কাছ থেকে এ তথ্য জেনে আমরা হেঁটে অনেকটা পিছিয়ে এলাম। এটা ছোট্ট একটা পাড়া, পাহাড়ের ঢালে সাপের মতো এঁেকবেঁকে এগিয়ে চলা পিচঢালা পথের ধার ঘেঁষে গুটিকয়েক ঘর। আমরা অনেকটা পথ হেঁটে চলার পরও কোনো মানুষজনের দেখা পাইনি। বাড়িগুলোকে দেখে মনে হলো এ গুলোও যেন জনমানব শূন্য, আদতে তা নয়। বার্গেনের এই চার মাসের অভিজ্ঞতায় দেখেছি এরা স্বভাবগতভাবে খুব শান্ত, তাদের বাড়ির ভেতরের কোনো রকম শব্দ বা চলাচলের কোনো আভাস বাইরে থেকে পাওয়া যায় না, মাঝে সাঝে সন্ধ্যাবেলা কোনো কোনো বাড়ির ঝুল বারান্দায় দু’-একজন পৌঢ়কে বসে একা অথবা সঙ্গীসহ চা-কফি পান করতে দেখা যায়, তাও আবার সপ্তাহান্তে। এখানকার বাড়ির বাসিন্দারাও নিশ্চয়ই ব্যতিক্রম নয়। এছাড়া আজ আবার কোনো ছুটির দিনও নয়। সুতরাং, যারাই এখানে বাস করে নিশ্চয়ই জীবিকার তাগিদে বাইরে ব্যস্ত সময় পার করছে, দিন ফুরোলে নীড়ে ফিরবে। এই ফাঁকা জনমানব শূন্য পরিবেশে আমরা নিজ মনে এ বাড়ি-সে বাড়ির আঙ্গিনায় ছবি তুলে চলেছি। আসলে সময় কাটাচ্ছি, সময় খরচা করে এতদূর যেহেতেু আসাই হলো তাই কিছুটা সময় এখানে কাটিয়ে না গেলে কেমন হয়- তাই না। এমনিতেই আমাদের আজকের অভিযানকে ব্যর্থ অভিযান হিসেবে আখ্যা দেওয়া যায় তার উপর হঠাৎ বৃষ্টি বেসুরো সময়কে আরো তালগোল পাঁকিয়ে দিল। ভাগ্যিস, ততক্ষণে আমরা বাস স্টপের কাছাকছি চলে এসেছি, অনেকটা দৌড়ে আমরা বাস স্টপের ছাউনির তলে আশ্রয় নিলাম।

এই বাস স্টপটি আনেকটা পাবলিক টেলিফোন বুথের মতো। তবে, এর তিনদিক কাচঘেরা আর একদিক খোলা, যেখানে পাবলিক টেলিফোন বুথের চারধার কাচ দিয়ে ঢাকা। ছোট্ট এ ছাউনিতে যদিও মাথা গুজবার সুযোগ মিলল তবে তা বৃষ্টির ছাট থেকে আমাদের কতটা রক্ষা করতে পারল তা অবশ্য অন্য হিসাব। এখানে আমাদের বেশ খানিকক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো বৃষ্টি থেমে যাবার জন্য অথবা বাস আসার জন্য। অবশেষে বৃষ্টি কিছুটা কমলো তবে বাস আসতে তখনো বাকি। আসলে যে-সকল এলাকায় জনবসতি কম বা বাস-যাত্রীর সংখ্যা কম সেখানে বাসের চলাচলও কম। এখানে প্রায় প্রতিটা বাস স্টপে ডিজিটাল ডিসপ্লে আছে যাতে সেখানে বাস কতটা সময় পর আসবে এবং বাসের প্রতিক্ষণের অবস্থান সম্পর্কে তথ্য পাওয়া যায়। তবে এই ফাঁকে নিঃসঙ্গ এই বাস স্টপের সাথেও আমরা আমাদের ফ্রেমবন্দি করতে ভুললাম না। একসময় বাসের জন্য আমাদের অপেক্ষারও অবসান হলো সেদিনের মতো আমরা আমাদের ডেরায় ফিরলাম।

এবার কিন্তু পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত হতেই হলো, ভাবছেন হঠাৎ এত বাধ্যগত শিক্ষার্থী হয়ে গেলাম কীভাবে ? আসলে আমার ইউরোপ ভ্রমণটা ছিল অনেকটা রথ দেখা কলা বেচার মতো বিষয়, তবে আমি কলা বেচা বাদ দিয়ে শুধু রথই দেখে গেছি, না এখন আর উপায় নেই। যারা শুরু থেকে আমার ইউরোপ ভ্রমণের সঙ্গী [ভ্রমন কাহিনীর নিয়মিত পাঠক নন] ছিলেন না তারা হয়ত রথ দেখা কলা বেচার গল্প শুনে কিছুটা বিভ্রান্ত তাদের জন্য আমার পুরোনো প্রসঙ্গের জের টেনে বলছি, আমার ইউরোপ বা বিশেষ করে বার্গেনে যাত্রার মূল লক্ষ্য কিন্তু ছিল এক্সচেঞ্জ এডুকেশনের একটা পার্ট। বার্গেন ইউনিভার্সিটিতে আমার মাস্টার্স কোর্সের একটা সেমিস্টার সম্পন্ন করতেই আসা। তাই আমি, আমার কলিগ ফারজানা-সহ এগারজনের একটি দল আমরা বার্গেনে এসেছি [আমার লেখায় মাঝে মাঝেই আমি তাদের কথা উল্লেখ করেছি]। পাঁচ মাসের সেমিস্টারের প্রায় চারমাস ইতোমধ্যে অতিক্রান্ত, ক্লাস অ্যাসাইনমেন্টের পাট চুকে গেছে এখন চূড়ান্ত পরীক্ষা। এর আগে হোম এক্সামের কথা শুনলেও এ বিষয়ে আমার ব্যক্তিগত ধারণা খুব ঝাপসা ছিল। তবে, এবার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা লাভের সুযোগ এলো। আপাত মনে হতে পারে ঘরে বসে পরীক্ষা দেব সমস্ত বই-খাতা-পত্র এমনকি ইন্টারনেট ব্যবহারের অবাধ স্বাধীতা তার উপর তিনদিন সময় নিয়ে একটা পরীক্ষা -এটা কোনো পরীক্ষা হলো ? বাস্তবতা হলো হোম এক্সামেই অধিকাংশের গ্রেড কমে আসে। আমাদের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। আসলে এই সকল অবাধ সুযোগের আড়ালে প্রায় অদৃশ্যভাবে বেশ কিছু জটিল শর্ত লুকায়িত থাকে আর এখানেই বিপত্তি। বিষয়টি আমার কাছে একাধারে জটিল আর বিরক্তিকর ছিল। মনে হচ্ছিল তত্ত্ব আর তথ্যের গভীর সমুদ্রে হাবুডুবু খাচ্ছি কিন্তু আমার যেটা প্রয়োজন তার নাগাল পাচ্ছি না। বিদঘুটে পরীক্ষার চক্করে এক বিষাদময় বন্দিজীবন। যেদিন উত্তরপত্র জমা দেওয়া সম্পন্ন হলো সেদিন যেন হাফ ছেড়ে নিঃশ্বাস নিলাম। নতুন করে মুক্ত জীবনের প্রতি আবেগ আরো বেড়ে গেল, আবেগের অতিশয্যে বৃষ্টি উপেক্ষা করে কনকনে ঠান্ডায় আমি আর ফারজানা বেরিয়ে পড়লাম শেষ নভেম্বরের মুক্ত বাতাস সেবনে।

পরীক্ষা কিন্তু সবে একটি শেষ হলো মাঝে দিন পাঁেচকের বিরতি এর মধ্যেই ফারজানা আর আমি অসলোতে যাওয়ার পরিকল্পনা করে ফেললাম। অনেকটা চুপিসারেই আমি আর ফারজানা এক ভোরে অসেলোর ট্রেনে উঠে বসলাম। চুপিসারে কেন?- লোকে শুনলে পাগল ভাবতে পারে পরীক্ষার মাঝে বিরতিতে পড়াশোনায় মন না দিয়ে বেড়াতে চলে গেছি, কি দরকার লোকজনকে চিন্তায় ফেলে । আসলে বার্গেনে যাওয়ার পর থেকেই আমাদের পরিকল্পনায় ছিল আমরা একদিনের জন্য হলেও অসলোতে যাবো। যতটা না অসলো দেখার আগ্রহ তারচেয়ে বেশি আগ্রহ ছিল বার্গেন থেকে অসলো অথবা অসলো থেকে বার্গেনের ট্রেন জার্নিতে। যাবো যাবো করে কেন জানি পরিকল্পনাটি বাস্তবরূপ পাচ্ছিল না আর এদিকে আমাদের ইউরোপ প্রবাসের সময়ও প্রায় ফুরিয়ে আসছিল তাই অনেকটা মরিয়া হয়েই অসলোর পথে বেরিয়ে পড়লাম।

বলা হয়নি বোধহয় বার্গেনে এরই মধ্যে তুষারপাত শুরু হয়ে গেছে। প্রকৃতির সবুজসাজ সময়ের পরিক্রমায় শুভ্রতার রূপ পেয়েছে। প্রকৃতির এই ভিন্নরূপের সাথে আমার কোনো পূর্ব পরিচয় ছিল না। স্বেতশুভ্র প্রকৃতি তার অবারিত রূপের ঝলকানিতে আমরা যেন বিভোর। আক্ষরিক অর্থেই শুভ্রতার ঝলকানি আমরা উপভোগ করছি ইউরোপের অভিজাত এক যন্ত্রযানে বসে। ইউরোপে যাওয়ার পর থেকেই জেনে আসছি ইউরোপে ট্রেন বড়লোকের যান, এখানে গরিবরা প্লেনেই যাতায়াত করে থাকে। কথাটি সবক্ষেত্রে সঠিক না হলেও অনেকটাই সত্য, ইউরোপে ল্যাক্সারিয়াস জার্নির মধ্যে ট্রেন জার্নি অন্যতম যা অনেক ক্ষেত্রেই মধ্যবিত্তদের নাগালের বাইরে। তবে বিভিন্ন ভ্রমণ প্যাকেজ আর ট্যুার কোম্পানিদের বিজ্ঞাপনের বদৌলতে এটা নিশ্চিত করে বলতে পারি এখানে জাহাজে ভ্রমণ শুধুমাত্র এলিট শ্রেণির জন্যই প্রয়োজ্য, অন্যেরা চাইলেও তা এফোর্ট করতে পারবে না। হ [চলবে]