প্রতিবছর বৃষ্টিপাত হলেই ডেঙ্গুর উপদ্রব বেড়ে যায়। অন্যান্য বছর থেকে এবার ডেঙ্গুর উপদ্রব অনেকটাই বেশি। বছরের অন্য সময়ের চেয়ে বৃষ্টিপাতের এই সময়টাতে ডেঙ্গু থেকে বাঁচতে একটু বেশি সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। এডিস মশার কামড়ে ডেঙ্গুজ্বর হয়, এটা আমাদের সবার জানা। অধিক বৃষ্টির কারণে জলবদ্ধতা, বাতাসে অধিক আর্দ্রতা এডিস মশার বংশ বিস্তারে সহায়ক। তাছাড়া পরিত্যক্ত প্লাস্টিক, ডাবের খোসা, গাড়ির টায়ার, পানির ট্যাংক, ফুলের টবে জমে থাকা পানিতে এডিস মশা বংশ বিস্তার করে। এদের ডিম ফোটানোর জন্য দরকার হয় পরিষ্কার পানি। তাই শুকনো মৌসুম বা শীতের সময় এডিস মশা কমে যায়। সবাই মিলে এই সময়টায় বাড়ির চারপাশ যদি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে পারি তাহলে ডেঙ্গু থেকে অনেকটাই মুক্ত থাকতে পারব। করোনার মতো ডেঙ্গুও বর্তমান সময়ের সবচেয়ে যন্ত্রণাদায়ক একটি রোগ। এই জ্বরে আক্রান্ত ব্যক্তিরা একদিকে যেমন দুর্বল হয়ে পড়ে অন্যদিকে এর রেশ শরীরে থেকে যায় দীর্ঘদিন। তবে ডাক্তারের পরামর্শ মতো তরলজাতীয় খাবার খেলে এবং বিশ্রাম ও নিয়মমাফিক চললে এ থেকে পুরোপুরি মুক্তি পাওয়া সম্ভব। তবে, কিছু কিছু ক্ষেত্রে মারাত্মক জটিলতা দেখা দিতে পারে এবং সময়মতো ডাক্তারের পরামর্শ না নিলে মৃত্যুও ঘটতে পারে।
এবার জেনে নিই এডিস মশা কখন কামড়ায়, ডেঙ্গুর লক্ষণ, ডেঙ্গু প্রতিরোধ, চিকিৎসা-পদ্ধতি এবং সতর্কতা সম্পর্কেÑ
ডেঙ্গুজ্বর কী এবং কীভাবে ছড়ায়
ডেঙ্গুজ্বরের উৎপত্তিই হচ্ছে শুধুমাত্র ডেঙ্গু ভাইরাস থেকে এবং এই ভাইরাসবাহিত ‘এডিস ইজিপ্টা’ নামের একধরনের মশার কামড়ে। যদি ডেঙ্গুজ্বরের জীবাণুবাহী মশা কোনো ব্যক্তিকে কামড়ায়, তাহলেই শুধু সেই ব্যক্তি ৪ থেকে ৬ দিনের মধ্যে ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়। তাছাড়া আক্রান্ত ব্যক্তিকে যদি কোনো জীবাণুবিহীন এডিস মশা কামড়ায়, তাহলে সেই মশাটিও তখন ডেঙ্গুজ্বরের জীবাণুবাহী মশায় পরিণত হয়। এভাবে ডেঙ্গুর জীবাণুবাহী মশার মাধ্যমে একজন থেকে অন্যজনের শরীরে ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়ে।
ডেঙ্গুজ্বর কখন হয় এবং কাদের বেশি হয়
সাধারণত মে থেকে অক্টোবরের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত বিশেষ করে গরম এবং বর্ষার সময়টাতেই ডেঙ্গুজ্বরের প্রকোপ বেশি থাকে। শীতকালে এই জ্বর খুব কম হয়। শীতে লার্ভা অবস্থায় ডেঙ্গু মশা অনেকদিন বেঁচে থাকতে পারে। বর্ষার শুরুতেই সেগুলো থেকে নতুন করে ডেঙ্গু ভাইরাসবাহিত মশা বিস্তার লাভ করে। সাধারণত শহর অঞ্চলে অভিজাত এলাকায়, বড়ো বড়ো দালান কোঠায় এই মশার প্রাদুর্ভাব বেশি, তাই ডেঙ্গুজ্বরও এই এলাকার বাসিন্দাদের বেশি হয়। বস্তিতে বা গ্রামে বসবাসরত লোকজনের ডেঙ্গু কম হয় বা একেবারে হয় না বললেই চলে। যারা একবার ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়েছে, তাদের ক্ষেত্রে পরবর্তীসময়ে ডেঙ্গু হলে তা মারাত্মক হওয়ার ঝুঁকি থাকে। বিশেষ করে, শিশুদের ক্ষেত্রে এটি বেশি দেখা যায়। আমাদের সাধারণত দুই ধরনের ডেঙ্গু হয়ে থাকে। ক্লাসিক্যাল ডেঙ্গু এবং ডেঙ্গু হেমোরেজিক।
ক্লাসিক্যাল ডেঙ্গুজ্বর
ক্লাসিক্যাল ডেঙ্গুজ্বরে সাধারণত তীব্র জ্বর ও সেইসঙ্গে সারাশরীরে প্রচ- ব্যথা হয়ে থাকে। জ্বর ১০৫ ডিগ্রি ফারেনহাইট পর্যন্ত হয়ে থাকে। এর নিচে নামতেই চায় না। শরীরে বিশেষ করে হাড়, কোমর, পিঠসহ অস্থিসন্ধি এবং মাংসপেশিতে তীব্র ব্যথা হয়। এছাড়া মাথাব্যথা ও চোখের পেছনে ব্যথা হয়। অনেক সময় ব্যথা এত তীব্র হয় যে, মনে হয় এই বুঝি হাড় ভেঙে যাচ্ছে। জ্বর হওয়ার ৪ বা ৫ দিনের সময় শরীরজুড়ে লালচে দানা দেখা যায়, যাকে বলা হয় স্কিন যার্শ। অনেকটা এলার্জি বা ঘামাচির মতো। এর সঙ্গে বমি বমি ভাব, এমনকি বমি হতে পারে। রোগী অতিরিক্ত ক্লান্তি বোধ করে এবং রুচি কমে যায়। সাধারণত ৪ থেকে ৫ দিন জ্বর থাকার পর কোনো জটিল অবস্থা না হলে তা এমনিতেই চলে যায়।
হেমোরেজিক ডেঙ্গুজ্বর
ডেঙ্গুর হেমোরেজিক অবস্থা সবচেয়ে জটিল। এই জ্বরে ক্লাসিক্যাল ডেঙ্গুজ্বরের লক্ষণ ও উপসর্গের পাশাপাশি আরো যে সমস্যাগুলো হয়, তা হলো শরীরের বিভিন্ন অংশ থেকে রক্ত পড়তে শুরু হয়। যেমন চামড়ার নিচে, নাক ও মুখ দিয়ে, মাঢ়ি ও দাঁত হতে, কফের সঙ্গে রক্তবমি, পায়খানার সাথে তাজা রক্ত বা কালো পায়খানা, চোখের মধ্যে এবং চোখের বাইরে, নারীদের বেলায় অসময়ে ঋতুস্রাব অথবা রক্তক্ষরণ শুরু হলে অনেকদিন পর্যন্ত রক্ত পড়তে থাকা ইত্যাদি। রোগের এই অবস্থায় অনেক সময় বুকে পানি, পেটে পানি ইত্যাদি দেখা দিতে পারে। অনেক সময় লিভার আক্রান্ত হয়ে রোগীর জন্ডিস, কিডনিতে আক্রান্ত হয়ে রেনাল ফেইলিউর ইত্যাদি জটিলতা দেখা দিতে পারে।
ডেঙ্গু শক সিনড্রোম
ডেঙ্গুজ্বরের ভয়াবহ রূপ হলো ডেঙ্গু শক সিনড্রোম। ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভারের সাথে সার্কুলেটরি ফেইলিউর হয়ে ডেঙ্গু শক সিনড্রোম হয়। এর লক্ষণ হলো রক্তচাপ হঠাৎ কমে যাওয়া, নাড়ির স্পন্দন অত্যন্ত ক্ষীণ ও দ্রুত হয়, শরীরের হাত-পা ও অন্যান্য অংশ ঠান্ডা হয়ে যায়, প্রস্রাব কমে যায়, হঠাৎ করে রোগী জ্ঞান হারিয়ে ফেলতে পারে। এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।
কী কী পরীক্ষা করা উচিত
ডেঙ্গুজ্বর হলে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই খুব বেশি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার প্রয়োজন হয় না। জ্বর হওয়ার ৪ থেকে ৫ দিন পরে সিবিসি এবং প্লাটিলেট পরীক্ষা করাই যথেষ্ট। এর আগে করলে রিপোর্ট স্বাভাবিক থাকে এবং অনেককেই বিভ্রান্তিতে পড়তে হয়। প্লাটিলেট কাউন্ট ১ লক্ষের কম হলে, ডেঙ্গু ভাইরাসের কথা মাথায় রেখে পরবর্তী পদক্ষেপ নিতে হবে। তাছাড়া ডেঙ্গুর এন্টিবডি পরীক্ষা ৫ থেকে ৬ দিনের পর করা যেতে পারে। এই পরীক্ষা রোগ সনাক্তকরণে সাহায্য করে। প্রয়োজনে ব্লাড সুগার, লিভারের পরীক্ষাসমূহ যেমন এসজিপিটি, এসজিওটি, এলকালাইন ফসফাটেজ ইত্যাদি করা যাবে। এছাড়াও প্রয়োজনে পেটের আল্ট্রাসনোগ্রাম, বুকের এক্সরে ইত্যাদি করা যেতে পারে। চিকিৎসক যদি মনে করেন যে, রোগী ডিআইসি-জাতীয় জটিলতায় আক্রান্ত, সেক্ষেত্রে প্রোথ্রোম্বিন টাইম, এপিটিটি, ডি-ডাইমার ইত্যাদি পরীক্ষা করতে পারেন। হ
লেখক : ডায়াবেটোলজিস্ট, ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল