ভালোবাসার চিঠি

23 Jul 2023, 01:29 PM রঙ্গশালা শেয়ার:
ভালোবাসার চিঠি

‘লাভ লেটারস’ হলো আমেরিকান নাট্যকার এ.আর.গার্নির এপিস্টলারি ফর্মে লেখা একটি নাটক, অর্থাৎ যেখানে অভিনেতারা চিঠিপত্র পাঠ করে লেখার পেছনের মানুষগুলোর গল্পটা দর্শকের সামনে তুলে ধরে। মূলত এটা পাঠাভিনয়। থিয়েটার তাদের ৪৮ তম প্রযোজনা হিসেবে সম্প্রতি মঞ্চে আনে এই নাটক-‘লাভলেটারস’। গত ৫ মে, ২০২৩ তারিখে মহিলা সমিতির মঞ্চে হয়ে গেল এ নাটকের উদ্বোধনী মঞ্চায়ন। ইতোমধ্যে নাটকটির ৫টি প্রদর্শনীও হয়েছে ।

১৯৮৮ খ্রিষ্টাব্দে অ্যালবার্ট র‌্যামসডেল গার্নি জুনিয়র [১৯৩০-২০১৭] ‘লাভলেটার্স’ নাটকটি লেখেন যা খুবই জনপ্রিয়তা পায় তখন এবং সাহিত্যে পুলিৎজার পুরস্কারের জন্য মনোনীতও হয়। নামডাক ছড়িয়ে পড়ে আমেরিকার বাইরেও। বিভিন্ন দেশে, বিভিন্ন ভাষায় নাটকটি অনূদিতও হতে থাকে। এরই ধারাবাহিকতায় থিয়েটারের জন্য মূল নামটি ঠিক রেখে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে নাটকটি এবার বাংলায় রূপান্তর করেন অধ্যাপক ও অনুবাদক আবদুস সেলিম। নাটকটির প্রধান দু’টি চরিত্র- অনন্ত শাহেদ চৌধুরী এবং মাইশা ইসলামের ভূমিকায় পাঠাভিনয় করেন মঞ্চ ও টিভির কালজয়ী অভিনেতা রামেন্দু মজুমদার এবং ফেরদৌসী মজুমদার। এই নাম দুটো উচ্চারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দর্শকের মনেও খেলে যায় একধরনের নস্টালজিয়া। মনে ভাসে কত কত নাটকের কথা, সোনালি অতীতের কথা। আসলে ‘লাভলেটার্স’ তো অতীত স্মৃতি রোমন্থনেরই প্রচেষ্টা। স্মৃতি রোমন্থনের এই নাটকীয়তা ছিল আরো অনেক কিছুতে। সেই প্রসঙ্গে একটু পরে আসছি। ‘লাভলেটার্স’ নির্দেশনা দেন ত্রপা মজুমদার।

নির্দেশকের বয়ানে জানা যায়, অনন্ত শাহেদ চৌধুরীর চরিত্রটি করবার জন্য অভিনেতা আলী যাকেরকে প্রস্তাব করা হয়েছিল এবং তিনি তাতে সম্মতিও দিয়েছিলেন। কিন্তু করোনা ও কর্কট রোগ বানচাল করে দিল সব পরিকল্পনা। অগত্যা আলো জ্বলে উঠলে মঞ্চে দৃশ্যমান হন রামেন্দু মজুমদার এবং ফেরদৌসী মজুমদার জুটি।

একটি একটি করে চিঠি হাতে নিয়ে পড়তে শুরু করেন প্রথমে অনন্ত শাহেদ চৌধুরী [রামেন্দু] যেগুলো তিনি প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে লিখেছিলেন শৈশবের বন্ধু মাইশা ইসলাম [ফেরদৌসী]-কে। জন্মদিনের পার্টির ধন্যবাদ নোট এবং বৈশাখে নববর্ষের পোস্টকার্ড দিয়ে শুরু হয় তাদের এই আজীবন চিঠি চালাচালির খেলা।

মজার বিষয় হলো, চিঠি পাঠ করছেন চিঠি লেখক স্বয়ং আর তার প্রতিক্রিয়া তাৎক্ষণিকভাবে ফুটে উঠছে প্রাপক মাইশা ইসলামের চোখে-মুখে। একদিকে পাঠ আর অন্যদিকে অপরজনের অভিব্যক্তি প্রকাশের এই খেলা চলতে থাকে পুরো সময় জুড়ে। তবে রামেন্দু মজুমদার ছিলেন অনেকাংশেই পাঠকের ভূমিকায় আর ফেরদৌসী মজুমদার তাঁর অভিব্যক্তি-প্রতিক্রিয়া প্রকাশের নিপুণতা দিয়ে একসময় মিলনায়তনের সকল দর্শকের দৃষ্টি নিজের দিকে টেনে নিয়ে যেতে সক্ষম হন। অর্থাৎ যখন মাইশা পাঠ করছেন, দর্শক তখনো তার দিকে তাকিয়ে, আবার যখন অনন্ত পাঠ করছেন চিঠি, তখনও দর্শক মাইশার দিকেই তাকিয়ে। অনবদ্য তিনি একারণেই।

পাঠাভিনয়ের চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনের বাইরে মঞ্চসজ্জা ছিল বাহুল্যবর্জিত ও ছিমছাম। যা ঘটার, তা যদি ঘটানো যায় দর্শকের মগজে ও প্রাণে, সুঅভিনয় আর নির্দেশকের যথাযথ নির্দেশনার মাধ্যমে, তাহলে আর কী প্রয়োজন মঞ্চে নানা আয়োজনের জঞ্জাল বাড়িয়ে ! আলোর ঝলকানি, দ্রব্যসামগ্রীর প্রতুলতা, অভিনেতার আস্ফালন, আরোহন, অবরোহন- সবই অহেতুক হয়ে যায় যদি না এতসব করেও দর্শকপ্রাণ ছুঁতে না পারা যায়। নির্দেশক তাই আয়োজন বলতে রেখেছেন পেছনে একটি বড়ো সাদা দরোজা। কী অর্থ হতে পারে এর ? ধবধবে সাদা দরজা কি আমাদের জীবনের সময়ের সীমানা ? যে সীমানা পেরিয়ে মানুষকে একসময় পাড়ি জমাতে হয় অজানা কোনো দেশে, যে দেশের কথা কেউ জানে না !

অনন্ত আর মাইশার বড়ো হয়ে ওঠা, জীবনের নানা ধাপ-পদক্ষেপ, সময়ের পরিবর্তন, রাজনৈতিক ও সামাজিক অবস্থা তাদের পরস্পরকে লেখা চিঠির ভাষায় প্রকাশ পেতে থাকে। অতীতের প্রায় ৫০ বছরের দুটো মানুষের স্বপ্ন, উচ্চাকাক্সক্ষা, হতাশা, বিজয় এবং পরাজয়ের কথা প্রকাশিত হতে হতে দুটো মানুষ তার পূর্ণ অবয়বে দেখা দেয় দর্শকের মানসলোকে। অভিনেতারা কয়েকবার পোশাকে সামান্য কিছু পরিবর্তন এনে দর্শককে বোঝাতে সক্ষম হয়েছেন ঋতু ও সময়ের পরিবর্তন, বয়স, পেশা, পদ-মর্যাদা। দর্শক যেন ভুলে না যান, ক্ষণিকের জন্য হলেও সময়ের এই পরিক্রমা, প্রায়ই তাই টুংটাং করে বেজে উঠতে শোনা গেছে ঘণ্টাধ্বনি, যেন প্রহরী এসে অমলকে বলছে- ‘সময় থেমে নেই, সময় কেবলই চলে যাচ্ছে।’

অভিনেত্রী যখন মশগুল চিঠির প্রত্যুত্তর দিতে- পেছনের স্ক্রিনে ফুটে উঠতে থাকে প্রাসঙ্গিক আবহ। তবে আমার কাছে মনে হয়েছে এই আয়োজনটা না হলেও চলত। ঠিক যেন যথাযথভাবে কাজে লাগানো হলো না, মানে বিশাল পর্দার ছবিগুলো, [মানে ছবিগুলো আরেকটু মজার হতে পারত] বা আবহ নতুন কিছু যোগ করতে পারলো না দর্শকের মনে বরং ওই সময়ে পর্দায় তাকিয়ে থাকার কারণে মাইশার মুখের আরো কিছু চমৎকার অভিব্যক্তি দেখা থেকে যেন দর্শককে বঞ্চিত করা হলো। এছাড়া মঞ্চের একদিকে ছিল বইয়ের আলমারি, আর সামনে দুপাশে মাইশা-অনন্তের বসার ব্যবস্থা- একদম দর্শকের মুখোমুখি। মূলত রামেন্দু মজুমদার এবং ফেরদৌসী মজুমদার পুরোটা সময় বসেই পাঠাভিনয় করে গেছেন বা মাঝে মাঝে প্রয়োজনে একটু দাঁড়িয়েছেন। আর তাঁদের কোরিওগ্রাফি ও অন্যান্য কিছু সহযোগিতার জন্য সার্বক্ষণিক মঞ্চে ছিল তাঁদের দু’জন সহকারী অভিনেতাও।

এবার বলি সেই নাটকীয়তার কথা। টিকিট কাউন্টারে যখন আপনি টিকিটটি হাতে পাবেন, নিঃসন্দেহে সেটা ভালো লাগবেÑ একটি চিঠির খাম, একপাশে ডাকটিকেট, সিল, প্রাপক ও প্রেরকের নামের মতো করে নাটকের নাম ও অন্যান্য তথ্যাবলি! খামটি খুললেই ভেতরে পাওয়া যায় একটা পোস্টকার্ড, একটা চিরকুট। ভাবুন তো, কতদিন এমন একটা চিঠি আসে না আমাদের নামে ! খামটা উল্টাতে উল্টাতে ফিরে যাওয়া হয় সেই অতীতে। কত কত চিঠিই না একসময় আসত আমার, আপনার নামে ! যা হোক, চিঠির আদলে বানানো টিকিটের আইডিয়া কিন্তু নাটকের মূল থিমের সঙ্গে খুব মানিয়ে গেছে। আর হ্যাঁ, নাট্যদর্শকের জন্য ছিল আপ্যায়নেরও ব্যবস্থা- জামের শরবত, বিস্কিট, চা, পানি এবং দারুণ সুন্দর তার সুশৃঙ্খল ব্যবস্থাপনা।

সব মিলিয়ে থিয়েটারের এই প্রযোজনা ছিল দারুণ উপভোগ্য। সাহিত্যের টার্মে যাদের বলা হয় রোমান্টিক, স্মৃতি রোমন্থনের এই পুরো নাট্য-আয়োজন তাদের ভালো লাগবে নিঃসন্দেহে। 

লেখা : ধীমতি শুচিস্মিতা