সৈয়দ হাসান ইমাম বাঙালির বাতিঘর

27 Jul 2023, 02:26 PM জন্মদিন শেয়ার:
সৈয়দ হাসান ইমাম বাঙালির বাতিঘর

স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্রের শব্দসৈনিক, আবৃত্তিকার, পরিচালক, অভিনয়শিল্পী, ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির আহ্বায়ক এবং স্বৈরাচার-সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলনের অগ্রণী ব্যক্তিত্ব সৈয়দ হাসান ইমাম ১৯৩৫ খ্রিষ্টাব্দের ২৭ জুলাই ভারতের বর্ধমানে জন্মগ্রহণ করেন। তার শৈশব কেটেছে পশ্চিমবঙ্গে। বাবা সৈয়দ সোলেমান আলী ছিলেন আয়কর কর্মকর্তা। মাত্র দু'বছর বয়সে বাবাকে হারান হাসান ইমাম। তার পৈত্রিক নিবাস বাংলাদেশের বাগেরহাটে হলেও মায়ের বাড়ি বর্ধমানে। তার শিক্ষাজীবন শুরু হয় বর্ধমান টাউন স্কুলে। ১৯৫২ থেকে ১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত রাজ কলেজ ও ১৯৫৪ থেকে ১৯৫৭ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত টেকনিক্যাল কলেজে পড়াশোনা করেন তিনি। এরপর ১৯৫৭ খ্রিষ্টাব্দে পূর্ব পাকিস্তানে আসেন। ওই বছরই প্রথমে দর্শনার চিনিকলে এবং পরে ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তানে যোগদান করেন। 

এরপর ১৯৬০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে অভিনয়জীবন শুরু করেন তিনি। ১৯৬১ খ্রিষ্টাব্দে প্রতিকূল পরিস্থিতিতে প্রতিবাদী শিল্পী সমাজের নেতৃত্বে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মশতবার্ষিকী উদ্‌যাপন করেন। হাসান ইমাম অভিনীত প্রথম দিকের ছবির মধ্যে 'রাজা এল শহরে', 'শীত বিকেল', 'জানাজানি', 'ধারাপাত' ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। এছাড়া 'ওরা ১১ জন', 'পদ্মা নদীর মাঝি', 'তুমি আমার', 'নয়ন মণি'সহ দুইশ'র বেশি ছবিতে অভিনয় করেছেন তিনি। ১৯৬৫ খ্রিষ্টাব্দে সমগ্র পাকিস্তানের চলচ্চিত্র উৎসবে হাসান ইমাম শ্রেষ্ঠ অভিনেতার সম্মান লাভ করেন খান আতাউর রহমানের ‘অনেক দিনের চেনা’ ছবিতে অভিনয়ের জন্য।

এছাড়া হাসান ইমাম রবীন্দ্র জন্মশতবর্ষের কেন্দ্রীয় উৎসবে ড্রামা সার্কেল প্রযোজিত 'তাসের দেশ', 'রাজা ও রানী' এবং 'রক্তকরবী' নাটকে প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেন। তিনি ১৯৬৪ খ্রিষ্টাব্দে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় কর্মী ছিলেন। তিনি বেতার ও বাংলাদেশ টেলিভিশনের জন্মলগ্ন থেকেই  নাটকে নিয়মিত অভিনয় করেন। তার উল্লেখযোগ্য টিভিনাটকের মধ্যে, মুস্তাফা মনোয়ার নির্দেশিত শেক্সপিয়ারের 'মুখরা রমণী বশীকরণ', রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'রক্তকরবী', মোস্তফা কামাল সৈয়দ প্রযোজিত 'স্বপ্ন বিলাস' ইত্যাদি। তিনি ১৯৬৬ খ্রিষ্টাব্দে '৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ পূর্ব সময়ে প্রগতিশীল ছাত্রসংগঠন ও রাজনৈতিক দলের মঞ্চে নাটক-নাটিকা ও গণসংগীত পরিচালনা করেন। হাসান ইমাম পরিচালিত অন্য নাটকগুলোর মধ্যে ম্যাক্সিম গোর্কীর 'মা', সোমেন চন্দের 'না' ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। ১৯৬৯-এর গণ আন্দোলনের সময় সংস্কৃতি সংসদ আয়োজিত প্রায় ১০ হাজার মানুষের উপস্থিতিতে বাংলা একাডেমির বটমূলে মঞ্চায়িত 'রক্তকরবী' নাটকটি সেসময়ে বিপুল সাড়া জাগায়। সৈয়দ হাসান ইমাম এতে প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেন।

সৈয়দ হাসান ইমাম মুজিবনগর স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে সালেহ আহমেদ নামে বাংলা খবর পাঠ করতেন। ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত সংবাদ পাঠ এবং নাট্যবিভাগের দায়িত্ব পালন করেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে জহির রায়হানকে সভাপতি ও হাসান ইমামকে সাধারণ সম্পাদক করে মুজিবনগরে চলচ্চিত্রশিল্পী ও কলাকুশলী সমিতি গঠন করা হয়, যাদের উদ্যোগে মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র দলিল 'লেট দেয়ার বি লাইট' নির্মিত হয়। মুক্তিযুদ্ধের পর বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি প্রতিষ্ঠায় হাসান ইমাম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

ব্যক্তিগত জীবনে সৈয়দ হাসান ইমাম নৃত্যশিল্পী লায়ল হাসানকে বিয়ে করেন। 

সৈয়দ হাসান ইমাম শ্রেষ্ঠ অভিনেতা ও শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ও সাংবাদিক সমিতি পুরস্কার ছাড়াও স্বাধীনতা পুরস্কার, একুশে পদকসহ অনেক জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কার লাভ করেন। বাঙালির বাতিঘর সৈয়দ হাসান ইমামের জন্মদিনে আনন্দভুবনের পক্ষ থেকে আন্তরিক শুভেচ্ছা।