ইউরোপের ১৫০ দিন -সৈয়দা তাসলিমা আক্তার

21 Aug 2023, 01:19 PM ভ্রমন শেয়ার:
ইউরোপের ১৫০ দিন  -সৈয়দা তাসলিমা আক্তার

[পূর্ব প্রকাশিতের পর]


আগেই বলেছি আমাদের অসলো ভ্রমণ যতটা না অসলো দেখার আগ্রহ থেকে হয়েছিল তারচেয়ে বেশি আগ্রহ ছিল বার্গেন থেকে অসলো অথবা অসলো থেকে বার্গেনের ট্রেন জার্নিতে, কেননা ইউরোপ যাওয়া থেকে শুনছি যে ইউরোপ ভ্রমণের প্রকৃত স্বাদ পেতে হলে অবশ্যই রেলপথে ভ্রমণ করতে হবে। এমন না যে, ইউরোপে এসে আমরা ট্রেনে একদমই ভ্রমণ করিনি, করেছি তবে তা খুব স্বল্প সময়ের জন্য ; বড়োজোর ঘণ্টা তিনেক। মনে হয়েছিল যেন শুরু হতে-না-হতেই শেষ হয়ে গেল। এই প্রথম লম্বা একটা পথ, প্রায় সাত-সাড়ে সাত ঘণ্টার জার্নি, কিছু শুকনা খাবার আর প্রয়োজনীয় কিছু টুকিটাকি জিনিসপাতি গুছিয়ে নিয়ে সকাল সকাল আমরা বেরিয়ে পড়লাম, সকাল না বলে ভোর বলাই ভালো, যদিও ট্রেন সকাল ৮.১৫ মিনিটে আর আমরা সকাল সাড়ে সাতটাই বেরিয়ে পড়লাম। কেননা, ফেনটপ থেকে পাঁচ বা ছয়টি স্টপেজ আমাদের এগিয়ে যেতে হবে, এইটুকু পথ আমাদের প্রতিদিনের বাহন লাইটট্রেন বা বিমানই ভরসা। সকাল সকাল বিমানে যাত্রী চাপ একটু বেশি থাকায় আমরা হাতে কিছু সময় নিয়েই বের হলাম। ভাবছেন, সকাল সাড়ে সাতটায় রওনা হলাম কিন্তু বলছি ভোরবেলায় বেরিয়ে পড়লাম। আসলে এই শেষ নভেম্বরে এসে ইউরোপের সূর্য আমার মতো অলস হয়ে যায়, সকাল নয়টার আগে তার ঘুমই ভাঙে না, তাই আমরা যখন ফেনটপ (আমাদের স্টুডেন্ট হাউজ) থেকে বের হলাম তখন চারিধার রীতিমতো অন্ধকার, ভোর না বলে উপায় কী বলেন।

ট্রেন স্টেশনে লোকজনের সমরোহ নেহায়েত কম না। এখানে বলে রাখা ভালো ইউরোপে বিমান, শিপ এমনকি ট্রেনের টিকেটও সেলে বিক্রি হয়, আর আমরা মূলত সেলের টিকেটেই অসলো যাচ্ছি। কেননা, টিকেটের প্রচলিত মূল্য ক্ষেত্রবিশেষে একদেশ থেকে অন্য দেশে বিমান টিকেটের সমমূল্য কখনো-সখনো তারও বেশি। কমদামে টিকেট পাওয়ার বিষয়টিও আমাদের এ সময়ে অসলো যাওয়ার পেছনে যথেষ্ট ভূমিকা রেখেছে। তখনও ৮.১৫ বাজতে দেরি তাই আমরা প্লাটফর্ম লাগোয়া একটি কফিশপ থেকে কফি নিয়ে প্লাটফর্মের একধারে সাজানো চেয়ারে বসে ট্রেনের অপেক্ষা করতে করতে ভাবছিলাম ট্রেনের টিকেটে তো কোনো সিট নাম্বার নেই, কোন বগিতে উঠবো, আমি আর ফারজানা পাশাপাশি সিট পাবো তো, নিঃসন্দেহে দেশীয় অভিজ্ঞতা প্রসূত ভাবনা। যাই হোক, একসময় ট্রেন এলো, কোন বগিতে উঠবো তার ঘোষণাও এলো তবুও মনে সংশয় সিট ঠিকঠাকমতো পাবো তো, জানলার ধারে বসতো পারবো তো। তবে ট্রেনে উঠেই সকল সংশয় নিমিষেই উধাও, বিশাল বগি আমি আর ফারজানাসহ হাতে গোনা আট-দশজন যাত্রী, সুতরাং শুধু ঠিকঠাকমতো বসে কেন, চাইলে শুয়েও যাওয়া যাবে। নওজেরিয়ানরা আক্ষরিক অর্থেই তা করে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তারা একা একা ভ্রমণ করে, ভ্রমণে তারা হয় বই পড়ে অথবা ঘুমায়, আমাদের মতো গল্পগুজবে তাদের খুব একটা আগ্রহ নেই। তবে, এ যাত্রায় আমিও গল্পগুজবে তেমন একটা আগ্রহী না। কেননা, বাইরের প্রকৃতির মনোমুগ্ধকর রূপ তার থেকে দৃষ্টি ফেরাতেই দিচ্ছে না।

আমি ফেনটপের স্টুডেন্ট হাউজের যে রুমে থাকি তার একটি মাত্র জানালার পাশে একটি ছোটোখাটো কিন্তু ঘন সবুজের সমারোহে একটি বনের দৃশ্যপট ছিল। আমি প্রতিদিন কিছুটা সময় জনালার পাশে দাঁড়িয়ে এর শ্যামল সজীবতা উপভোগ করতাম। এখানে সবুজের ¯িœগ্ধতা ছাড়াও নানান জাতের নানান রঙের পাখির আনাগোনাও ছিল, ছিল তাদের আপন মনে গেয়ে যাওয়া অজানা সুরের গুঞ্জন। একসময় বনটি সবুজ থেকে সোনালি হলো হলুদ লাল আর কমলার মিশেলে শেষ বিকেলে আলোয় তা যেন জ্বলজ্বল করতো। তবে তা খুবই ক্ষণস্থায়ী শরতের শেষে শীত যতটাই এগিয়ে আসে বনের সকল রং ঝরাপাতার সঙ্গে ঝরে গেল, তারপর শুধুই একঘেয়ে কংকাল কা-। দিনের আলোতে বিষয়টি খুব একটা অস্বস্তিকর না হলেও দিনের শেষে মনে হতো যেন এক পোড়ো জঙ্গলের ছায়া ঘিরে রেখেছে চারপাশটা। ভাবছেন, ট্রেনে চেপে অসলো যাচ্ছি তারমধ্যে এই বর্ণগন্ধহীন জঙ্গল এলো কোথা থেকে। আসলে জঙ্গলটি আমার দিনরাত্রির দৃশ্যপট ছিল বলে এর পরিবর্তনের প্রতিটি ধাপ আমার স্মৃতিতে বা মানসপটে যাই বলেন না কেন জ্বলজ্বলে ছিল। আসলে পুরো ইউরোপের প্রকৃতিই কিন্তু তখন এরকমই। তাই যখন ট্রেনে যাব বলে সিদ্ধান্ত নিলাম তখন যদি পুরোটা পথই এরকম মন খারাপ করা দৃশ্যই দেখতে হয় তবে ভ্রমণের সকল আনন্দ এখানেই মাঠে মারা পড়বে। আমরা নিঃসন্দেহে ভাগ্যবান সময় আর প্রকৃতির নিজ খেয়াল তার এই মৃতপ্রায় রূপকে তুষারের ¯িœগ্ধ আবরণে সাজিয়ে তুলেছে। শুভ্রতার আলোকচ্ছটা যেন সমস্ত প্রকৃতিকে আলোকিত করে তুলেছে আর আমরা যারা প্রকৃতির এই রূপকে প্রথমবার দেখছি তারা মুগ্ধতার ঘোর থেকে বেরুতে পারছি না।

ইউরোপীয়দের সময়জ্ঞান খুব টনটনে, সকাল ৮.১৫ মিনিটের ট্রেন কাঁটায় কাঁটায় ৮.১৫ মিনিটেই ছেড়েছে, টানা সাত ঘণ্টা জার্নি শেষে বিকেল সোয়া তিনটানাগাদ আমরা অসলো পৌঁছি। স্টেশন থেকে বেরুতে বেরুতে সাড়ে তিনটা বেজে গেল। এরপর আমাদের গন্তব্য অনিশ্চিত। আমাদের অসলো ট্যুরটা পুরোপুরি না হলেও একে ব্যাকপ্যক ট্যুরই বলা যায়। আমরা অসলোতে মোটে একরাত থাকব, কোথায় থাকব সে গল্পে পরে আসছি, এখন কী করবো তার জন্য আমরা গুগল ম্যাপের শরণাপন্ন হলাম। বেশ কয়েকটি জায়গা বেছে রেখেছি ঘুরব বলে আর এ জন্য সময় বরাদ্দ সন্ধে সাতটা পর্যন্ত। তবে, তার আগে অবশ্যই কিছু খেয়ে নিতে হবে। যেহেতেু অসলোতে প্রথম আসা, পথঘাট স্বাভাবিকভাবেই অপরিচিত, সেখানে খুঁজে পেতে হালাল রেস্টুরেন্টের সন্ধান পাওয়া সত্যিই দুঃসাধ্য, তাই সে পথে আর গেলাম না ট্রেন স্টেশনসংলগ্ন সুপারশপ থেকেই কিছু একটা কিনে খেয়ে নেওয়া যৌক্তিক মনে হলো। যেই ভাবা সেই কাজ আর আমাদের সাথেও টুকটাক কিছু শুকনো খাবার রয়েছে এই দিয়েই সেদিনকার মতো লাঞ্চ সমাপ্ত, এরপর পথে নামা ; প্রথমেই যাব অসলোর বিখ্যাত অপেরা হাউজে। গুগল মামাকে ভরসা করে এগিয়ে গেলাম। না এ ক্ষেত্রে গুগল মামা ভরসার মান রেখেছে। আমরা খুব সহজেই অপেরা হাউজে পৌঁছুতে পরলাম, এটি অসলোর কেন্দ্রে বজরভিকা (ইলড়ৎারশধ) এলাকায় অবস্থিত। অবশ্য বাস নাম্বার নিশ্চিত হওয়ার জন্য পথচারীতে সহায়তা নিতে হয়েছে, তবে কোনোরকম গোলকধাঁধায় পড়তে হয়নি।

এই শেষ নভেম্বরে নরওয়েতে নিয়মিতই তুষারপাত হচ্ছে, তাই অসলোর পথঘাট সব বরফে ঢাকা, অবশ্য বারগেন ততটা তুষারচ্ছন্ন নয় ; পরে জেনেছিলাম, অসলোতে বরাবরাই বারগেনের তুলনায় তুষারপাত বেশি হয়ে থাকে। আমরা যখন অপেরা হাউজে পৌঁছালাম, মনে হলো যেন আমরা রূপকথার বরফরাজ্যে প্রবেশ করেছি। পুরো এলাকা সাদা-শুভ্র বরফে আচ্ছন্ন এখানে ধুলোবালির পৃথিবী যেন নির্বাসনে। সমুদ্র খাঁড়ির গা ঘেষে দাঁড়িয়ে থাকা স্বেতপাথরের ভীতে সমুদ্রসবুজ কাচের অপেরা হাউজটিকে দেখে মনে হবে যেন এই মাত্র সমুদ্র জল থেকে উঠে এসেছে। তার গা থেকে এখনো জল গড়িয়ে পড়ছে। সেদিন সম্ভবত অপেরা হাউজের সাপ্তাহিক বন্ধের দিন ছিল অথবা টাইম সিডিউল আমাদের সময়ের সাথে মেলেনি এমন কিছু একটা হবে, যে-কারণে ইচ্ছে থাকা সত্বেও আমরা অপেরা হাউজের ভেতরটা দেখতে পারিনি। তবে, যারা আমাদের মতো ব্যাকপ্যাক ট্যুরিস্ট তাদের কাছে অপেরা হাউজের বাহ্যিক স্থাপত্য শৈলীই বেশি আকর্ষণীয়। আমাদের কাছেও এর ব্যতিক্রম ছিল না। ভেবেছিলাম আধ ঘন্টার মতো সময় আমরা এখানে কাটিয়ে পরবর্তী গন্তব্যে রওনা হবো কিন্তু কীভাবে ঘণ্টাদেড়েক সময় কেটে গেল তা আমরা নিজেরাই জানি না। তবু যেন সবটা দেখে শেষ করতে পারিনি। অবশ্য বরফ এখানে একটা কারণ ছিল বৈকি। সমস্ত অপেরা হাউজ চত্বর স্বচ্ছ কাচের মতো বরফে ঢাকা থাকার কারণে চলতে হচ্ছিল খুবই সাবধানে একটু এদিক সেদিক হলেই চিৎপটাং। তারপরও যে শেষ রক্ষা হয়েছিল তা কিন্তু নয়। একবার দুবার না বেশ কবার আমাদের চিৎপটাং এর অভিজ্ঞতা হয়েছিল। ভাগ্যিস হাত-পা কিছু ভাঙেনি তাই বাঁচোয়া।

আগেই বলেছি, অপেরা হাউজটি খাঁড়ির মুখে অবস্থিত, এখান থেকে সারি-সারি অলস জাহাজ চোখে পড়ে। দিনমানের ক্লান্তি কাটাতে যেন সাবই এখানে বিশ্রাম নিচ্ছে। সমুদ্রের পানিও শীতের তীব্রতায় কাবু, কোথাও কোথাও পানি জমে বরফ হয়ে গেছে। সমুদ্র পাখিগুলো একটু উষ্ণতা আর খাবারের খোঁজেই বোধ করি ডাঙায় ভীড় জমায়। কিছু সৌখিন ফটোগ্রাফার এর মধ্যে নিজেদের ফ্রেম খুঁজে নিচ্ছে। আমরা অপেরা হাউজের ছাদময় ঘুরে বেড়াচ্ছি আর প্রকৃতির অন্যরকম এক রূপকে যতটা পারি দৃষ্টি দিয়ে হৃদয়পটে ধরে রাখার চেষ্টা করছি। [চলবে]