জন্ডিস আসলে কোনো রোগ নয়, এটি কোনো রোগের লক্ষণ মাত্র। কারো শরীরে জন্ডিস হলে বিলুরুবিনের মাত্রা অনেক বেড়ে যায়। ফলে ত্বক, চোখের সাদা অংশ ও অন্যন্য মিউকাস ঝিল্লি হলুদ হয়ে যায়। রক্তে বিলিরুবিনের ঘনত্ব ১.২ মিলি গ্রাম নিচে এবং ৩ মিলি গ্রামের বেশি হলে জন্ডিস ধরা হয়। লধঁহফরপব শব্দটি ফরাসি শব্দ লধঁহরংংব থেকে এসেছে যার অর্থ হলুদাভ।
রক্তে বিলিরুবিনের মাত্রা অতিরিক্ত বেড়ে গেলে জন্ডিস দেখা দেয়। আমাদের রক্তের লোহিত কণিকাগুলো একটা সময়ে স্বাভাবিক নিয়মেই ভেঙে গিয়ে বিলিরুবিন তৈরি করে যা পরবর্তীসময়ে লিভারে প্রক্রিয়াজাত হয়ে পিত্তরসের সাথে পিত্তনালীর মাধ্যমে পরিপাকতন্ত্রে প্রবেশ করে। অন্ত্র থেকে বিলিরুবিন পায়খানার মাধ্যমে শরীর থেকে বেরিয়ে যায়। এছাড়া প্রস্রাবের মাধ্যমেও বেরিয়ে যায়। বিলিরুবিনের এই দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় যেকোনো অসঙ্গতি দেখা দিলে রক্তে বিলিরুবিন বেড়ে যায় আর দেখা দেয় জন্ডিস।
জন্ডিসের কারণ
লিভারের রোগ হচ্ছে জন্ডিসের প্রধান কারণ। আমরা সারাদিন যা কিছুই খাই না কেন তা কিন্তু লিভারে প্রক্রিয়াজাত হয়। লিভার বিভিন্ন কারণে রোগাক্রান্ত হতে পারে। হেপাটাইটিস এ, বি, সি, ডি এবং ই ভাইরাসগুলো লিভারে প্রদাহ সৃষ্টি করে যাকে বলা হয় ভাইরাল হেপাটাইটিস। আমাদের দেশসহ সারাবিশ্বেই জন্ডিসের প্রধান কারণ এই হেপাটাইটিস ভাইরাসগুলো। তবে উন্নত দেশগুলোতে অতিরিক্ত মধ্যপান জন্ডিসের একটি অন্যতম কারণ।
এছাড়া অটোইমিউন লিভার ডিজিজ এবং বংশগত কারণসহ আরো কিছু অপেক্ষাকৃত বিরল ধরনের লিভার রোগেও জন্ডিস হতে পারে। ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায়ও অনেক সময় জন্ডিস হয়। তাছাড়া থ্যালাসিমিয়া ও হিমোগ্লোবিন ই-ডিজিজের মতো যেসমস্ত রোগে রক্ত ভেঙে যায় কিংবা পিত্তনালীর পাথর বা টিউমার এবং লিভার বা অন্য কোথাও ক্যান্সার হলেও জন্ডিস হতে পারে। তাই জন্ডিস মানেই লিভারের রোগ এমনটি ভাবাও ঠিক নয়।
রক্তে বিলিরুবিনের মাত্রা বেড়ে গেলে জন্ডিস দেখা দেয়। এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে যেসব কারণ জানা গেছে সেগুলো হলো-
লিভার প্রদাহ : লিভার প্রদাহে বিলিরুবিনের উৎপাদন বেড়ে যায়।
ফলে রক্তে বিলিরুবিনের মাত্রা বেড়ে গিয়ে জন্ডিস সৃষ্টি হয়।
পিত্তনালীর প্রদাহ : পিত্তনালীর প্রদাহে বিলিরুবিন শোষণ ব্যাহত হয়। ফলে বিলিরুবিন বৃদ্ধি পেতে থাকে।
পিত্তনালীর ব্লক : পিত্তনালীতে ব্লক হলে লিভার বিলিরুবিন সরাতে ব্যর্থ হয়। বেড়ে যায় জন্ডিসের সম্ভাবনা।
গিলবার্ট’স সিনড্রোম : এই অবস্থায় এনজাইমের কার্যক্ষমতা কমে যায়। এর ফলে পিত্তের রেচনতন্ত্রে সমস্যা হয় এবং বিলিরুবিনের মাত্রা বেড়ে যায়।
ডুবিন-জনসন সিনড্রোম : এই বংশগত রোগে লিভার থেকে বিলিরুবিন শোষণ হতে বাঁধা দেয়। ফলে জন্ডিস হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে।
জন্ডিসের লক্ষণ
জন্ডিস হলে চোখ হলুদ হয়ে যায়। তবে, হেপাটাইটিস রোগে জন্ডিসের পাশাপাশি ক্ষুধামন্দা, অরুচি, বমিভাব, জ্বরজ্বর অনুভূতি কিংবা কাঁপানি দিয়ে জ্বর আসা, মৃদু বা তীব্র পেট ব্যথা ইত্যাদি হতে পারে। এসব উপসর্গ দেখা দিলে অবশ্যই একজন লিভার বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া উচিত। চিকিৎসক শারীরিক লক্ষণ এবং রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে জন্ডিসের তীব্রতা ও কারণ নির্ণয় করে প্রয়োজনীয় চিকিৎসার নির্দেশনা দিয়ে থাকেন। চিকিৎসা সাধারণত নির্ভর করে ঠিক কী কারণে জন্ডিস হলো তার ওপর।
জন্ডিস প্রতিরোধে করণীয়
হেপাটাইটিস-এ এবং ই খাদ্য এবং পানির মাধ্যমে সংক্রমিত হয়। আর বি, সি এবং ডি দূষিত রক্ত, সিরিঞ্জ এবং আক্রান্ত ব্যক্তির সঙ্গে শারীরিক সম্পর্কের মাধ্যমে ছড়ায়। তাই সব সময় বিশুদ্ধ খাদ্য ও পানি খেতে হবে। শরীরে রক্ত নেওয়ার দরকার হলে অবশ্যই প্রয়োজনীয় স্ক্রিনিং করে নিতে হবে। ডিসপোজেবল সিরিঞ্জ ব্যবহার করাটাও খুবই জরুরি।
মদ্য পান থেকে বিরত থাকতে হবে। কলকারখানার রাসায়নিক পদার্থ থেকে দূরে থাকতে হবে। নেশাদ্রব্য গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকতে হবে। ব্যবহারকৃত ইনজেকশন কিংবা নাক-কান ফোঁড়ানোর সুঁই ব্যবহার করবেন না। যারা সেলুনে সেভ করেন, তাদের খেয়াল রাখতে হবে যেন আগে ব্যবহার করা ব্লেড বা ক্ষুর আবারো ব্যবহার করা হয় কি না ? নিরাপদ যৌনমিলন করুন। হেপাটাইটিস এ এবং বি হওয়ার আশঙ্কামুক্ত থাকতে হেপাটাইটিস এ এবং বি-এর ভ্যাকসিন গ্রহণ করুন।
জন্ডিস অনেক ক্ষেত্রেই মৃত্যুর কারণ হতে পারে। তাই এই রোগ থেকে বাঁচতে হলে আমাদের সবাইকে সচেতন হতে হবে।