এআই সংবাদ উপস্থাপক বনাম মানব উপস্থাপক

26 Sep 2023, 03:51 PM সংবাদ উপস্থাপক শেয়ার:
এআই সংবাদ উপস্থাপক বনাম মানব উপস্থাপক

১৯ জুলাই, ২০২৩ বুধবার চ্যানেল ২৪-এর সন্ধ্যা ৭টার বুলেটিনে যুক্ত হয়ে সংবাদ উপস্থাপন করে এআই উপস্থাপক ‘অপরাজিতা’। সম্প্রতি বিভিন্ন দেশে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে [এআই] কাজে লাগিয়ে সংবাদ উপস্থাপনার বিষয়টি লক্ষ্য করা যায়। এই বছরের এপ্রিলে ‘ফেদা’ নামের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে দিয়ে সংবাদ পাঠ করিয়েছেন কুয়েত নিউজ। এরপর ৯ জুলাই ভারতের একটি বেসরকারি টেলিভিশন, ওড়িশা টেলিভিশন লিমিটেড [ওটিভি] কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ‘লিসা’কে দিয়ে সংবাদ পাঠ করিয়ে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশও কাজ শুরু করে দিচ্ছে কীভাবে এআই প্রযুক্তি ব্যবহার করে সংবাদ পাঠ করানো যায়। এর সফলতাও আসে। এবার বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স [এআই] বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রেজেন্টার অপরাজিতাকে দিয়ে সংবাদ উপস্থাপন করাল বেসরকারি টেলিভিশন ‘চ্যানেল ২৪’। অনেকেই বলছেন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রেজেন্টারকে দিয়ে খবর বা অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করালে এই পেশার সঙ্গে যারা দীর্ঘদিন জড়িত আছেন তারা কর্ম হারাতে পারেন। এ বিষয়টি নিয়ে কয়েকজন সংবাদ উপস্থাপকের সঙ্গে কথা হয়। চলুন জেনে নিই বিষয়টিকে তারা কীভাবে দেখছেন। লিখেছেন শহিদুল ইসলাম এমেল...

শামীম আরা মুন্নী

[সিনিয়র সংবাদ উপস্থাপক, ৭১ টিভি]

প্রযুক্তি দিন দিন এগিয়ে যাচ্ছে এটা অস্বীকার করা যাবে না। প্রযুক্তির কল্যাণে অনেক কিছুই সহজ হয়ে যাচ্ছে এটা বলতেই হবে। তাই বলে দীর্ঘদিন এই পেশার সঙ্গে যুক্ত থাকা অভিজ্ঞ উপস্থাপকদের বাদ দিয়ে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দিয়ে খবর পড়ানো হবে, এই বিষয়টি নিয়ে এখনো কিছু বলার সময় হয়নি। আমাদের দেশে এআই প্রযুক্তি দিয়ে পুরোপুরি খবর পড়া শুরু হলে তখনই বলা যাবে এই প্রযুক্তির কারণে কেউ কর্ম হারাবে কি না। আর যদি এমনটি হয় এই প্রযুক্তির কারণে মনুষ্য উপস্থাপকদের কাজ হারানোর সম্ভাবনা আছে তাহলে অনেকেই হয়ত সমস্যার মধ্যে পড়বেন। অনেকেই সংবাদ উপস্থাপকসহ নানা বিষয়ের ওপর কোর্স করছে। তারা আশা করছে কোর্স কমপ্লিট করে ভালো একটা টেলিভিশন চ্যানেলে যোগদান করবে। এখন যদি রোবট দিয়েই খবর পড়ানো হয় বা অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করা হয় তাহলে তাদের স্বপ্ন কিছুটা হলেও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তারা আর এই পেশায় আসার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করবে না।

দীর্ঘদিন যাবৎ এই পেশার সঙ্গে যারা ফুলটাইম যুক্ত আছেন তারা কাজ হারালে হয়ত সাময়িক সমস্যার সম্মুখীন হবেন। এমনিতেই দেশে দিন দিন বেকারের সংখ্যা বাড়ছে। তারপরও মানুষ নতুন নতুন নানা ক্ষেত্রে জীবিকার সন্ধান করছে। এআই প্রযুক্তির কারণে কিছু সংখ্যক উপস্থাপকদের যদি বাদ দেওয়া হয় তাহলে বেকারের সংখ্যা আরো বেড়ে যাবে। এআই প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে সংবাদ উপস্থাপনা ছাড়া অন্য ক্ষেত্রে ব্যবহার করা যেতে পারে। তাহলে কষ্ট করে কোর্স সম্পন্ন করে এই পেশায় যারা আসছে তাদের কিছুটা হলেও উপকার হবে। ধরুন, সংবাদ উপস্থাপনার বাইরে আমার একটা বিজনেস আছে। চাকরি চলে গেলে আমি একটা কিছু করে খেতে পারব। কিন্তু অনেকেরই তা নেই। তারা এটার ওপর নির্ভরশীল। তাদের হয়ত সমস্যা হবে। এছাড়া যারা নিয়মিত বিভিন্ন চ্যানেলে খবর পড়ছেন, তাদের অনেক ভক্ত দর্শক আছে। কিন্তু রোবটের কোনো ভক্ত দর্শক থাকবে না। কারণ, মানুষের মতো রোবটের আবেগ অনুভূতি নেই।

তাছাড়া খবর পড়ার সময় যান্ত্রিক ত্রুটি বা অন্য কোনো সমস্যা হলে সঙ্গে সঙ্গে তাৎক্ষণিক আমরা সেটা সামলে নিয়ে খবর পড়া চালিয়ে যেতে পারি। রোবটকে শিখিয়ে দিয়ে নিউজ পড়ানো হয়। খবর পড়ার আগে ডেটা ইনপুট দিয়ে খবর পড়ার জন্য রেডি করতে হয়। তাই রোবট কিন্তু সেই সময়ে তাৎক্ষণিকভাবে খবর পড়া চালিয়ে যেতে পারবে না। তাই আমাদের দেশে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দিয়ে পুরোপুরি খবর পড়া শুরু হলে বুঝতে পারবো মনুষ্য উপস্থাপকদের ওপর এর প্রভাব কতটুকু পড়বে। এখনি বলা মুশকিল। তবে এতটুকু বলতে পারি নিয়মিত রোবট দিয়ে খবর পড়ালে, খবর দেখা থেকে মানুষের আস্থা হারাতে পারে।

ফারহানা তৃনা

[সিনিয়র সংবাদ উপস্থাপক ও আবৃত্তিশিল্পী, বাংলাভিশন টেলিভিশন ও বাংলাদেশ বেতার]

বিজ্ঞান মানুষের জন্য আশীর্বাদ নাকি অভিশাপ এটি যেমন অমীমাংসিত বিতর্কের বিষয়, তেমনি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দিয়ে পুরোপুরি সংবাদ বা অনুষ্ঠান উপস্থাপনা মানুষকে কর্মহারা করবে কি না সেটিও এই মুহূর্তে অমীমাংসিত একটি বিষয়। কেননা, উপস্থাপক কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার হলেও তার দর্শক বা শ্রোতা কিন্তু মানুষ, তাই একজন উপস্থাপকের সফলতা নির্ভর করে দর্শকের গ্রহণযোগ্যতার ওপর।

যদিও বিশ্বের অন্যান্য রাষ্ট্রের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সংবাদ উপস্থাপনা দেখার সুযোগ হয়নি তবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ‘অপরাজিতা’-র প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের একটি টেলিভিশন চ্যানেলে সংবাদ পরিবেশনা আমি দেখেছি এবং মানব দর্শক হিসেবে বলব, আমার কাছে সেটি খুব বেশি প্রাণবন্ত মনে হয়নি। যেকোনো উপস্থাপনা যত বেশি প্রাণবন্ত হয় উপস্থাপক তত বেশি দর্শকপ্রিয়তা পায়। স্যাটেলাইট চ্যানেলগুলোও কিন্তু চায় বেশি বেশি দর্শক, বেশি বেশি ভিউ। তাই আমি মনে করি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার উপস্থাপক এখনো পুরোপুরি মানব উপস্থাপককে প্রতিস্থাপন করার মতো প্রস্তুত নয় এবং একজন মানুষের সকল আবেগকে পুরোপুরি প্রতিস্থাপন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার দ্বারা আদৌ সম্ভব কি না সেটিও বড়ো প্রশ্ন। আবার সেই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে পরিচালনা করার জন্য কিন্তু প্রযুক্তিতে দক্ষ মানুষেরই প্রয়োজন। তাই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা উপস্থাপককে আমি ভাবছি মানুষের প্রতিযোগী নয় সহযোগী হিসেবে। যেহেতু কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা উপস্থাপকের মানুষের মতো ক্লান্তি নেই, ঘুম নেই, আহার-বিহারের ভাবনা নেই, মৃত্যু বা জরা নেই। তাই যেখানেই মানব উপস্থাপক আটকে যাবে [হোক সেটি ঢাকার ট্রাফিক বা অসুস্থতা] সেখানেই কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা উপস্থাপক হতে পারে মানুষের সহযোগী, চ্যানেলগুলোর বিপদের বন্ধু !

তাই সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রযুক্তিগত দিক থেকে তাল মিলিয়ে এগিয়ে চলা এখন সময়ের দাবি, কাজ হারাবার ভাবনা না ভেবে কীভাবে এআই প্রযুক্তি বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আমাদের সহযোগী হবে সেই ভাবনাই ভাবতে হবে। তবেই বলা যাবে চাকরি ধ্বংস হবে না কি সৃষ্টি হবে !

মৌসুমী আহমেদ লোপা

[সিনিয়র সংবাদ উপস্থাপক, যমুনা টেলিভিশন]

ব্যক্তিগতভাবে আমি চিন্তিত না এ ব্যাপারে। এআই নিউজ প্রেজেন্টারের জন্য কর্মহীন হয়ে পড়বে মানুষ আমি এভাবে ভাবতে চাই না। একজন সংবাদ উপস্থাপকের সর্বোচ্চ চেষ্টা থাকে তথ্যের ধরন অনুযায়ী অভিব্যক্তি দিয়ে দর্শককে ধরে রাখা। দর্শক যেন তার কথাগুলো বিশ্বাস করে। আবেগ অনুভূতিসম্পন্ন মানুষের পক্ষেই সম্ভব অন্যকে প্রভাবিত করা যা রোবটের পক্ষে করা কঠিন। এআই নিউজ প্রেজেন্টারকে আগে থেকেই ডেটা ইনপুট দিতে হয়। যার ফলে তাৎক্ষণিক অপ্রত্যাশিত কোনো ঘটনা এআই প্রেজেন্টারের জন্য কাভারেজ দেওয়া চ্যালেঞ্জের বিষয়। আর কোনো ভুল ডেটা ইনপুট দিলে ভুলটাই প্রচার হবে। আমাদের সামনে প্রম্পটারে অনিচ্ছাকৃত কোনো ভুল থাকলে যেমন আমরা বেশিরভাগ সময় শুদ্ধ করে পড়ে দেওয়ার চেষ্টা করি। হয়তো খুব কম সময়ই চোখ এড়িয়ে যেতে পারে।

একটু খেয়াল করে দেখবেন বিশ্বের অনেক দেশেই কিন্তু এআই প্রেজেন্টার নিউজ পড়েছে। যদি দর্শক সেটা গ্রহণই করত তাহলে এতদিনে ওইসব দেশের চ্যানেলগুলোতে মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়ত। আর বিবিসি, সিএনএন, আলজাজিরাতে মানুষ নয়, সব নিউজ পড়তে দেখতাম এআইকে। তেমনটা কিন্তু হয়নি।

এআই নিউজ প্রেজেন্টার প্রযুক্তির একটি নতুন সংযোজন। এটি নিয়ে এখনই ভয় পাওয়ার কিছু নেই যে, মানুষ এই সেক্টরে কর্মহীন হয়ে পড়বে। তবে এটি আরো বেশি আপডেট হলে আর মানুষের [দর্শক] মধ্যে যদি ভবিষ্যতে আবেগ কমে শূন্যের কাছাকাছি চলে আসে তবে তখনকার চিত্রটা হয়ত কিছু নেতিবাচক হলেও হতে পারে। তারপরও খুব বেশি প্রভাব পড়বে না বলেই আমার মনে হয়।

আর হ্যাঁ বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে আমরাও যে এক্ষেত্রে পিছিয়ে নেই সেটি প্রমাণ করেছে চ্যানেল ২৪। দেশে প্রথমবারের মতো এআই প্রেজেন্টার দিয়ে নিউজ প্রচার করার সাহস দেখানোর জন্য তাদের সাধুবাদ জানাই।