বটতলা অ্যাক্টরস স্টুডিয়ো ৮ম আবর্তনের সমাপনী অনুষ্ঠান ও নাট্যপ্রযোজনা : তত্র পোড়ে যত্র দগ্ধ

01 Oct 2023, 02:21 PM রঙ্গশালা শেয়ার:
বটতলা অ্যাক্টরস স্টুডিয়ো ৮ম আবর্তনের সমাপনী অনুষ্ঠান ও নাট্যপ্রযোজনা : তত্র পোড়ে যত্র দগ্ধ

দেশের বড়ো বড়ো শিল্প-দুর্ঘটনায় ভুক্তভোগী সবসময়ই শ্রমিকশ্রেণি। মালিকপক্ষ কিংবা সংশ্লিষ্ট সরকারি বিভাগ- দুর্ঘটনার দায় নেয় না কেউই বরং উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপানোর নাটকীয়তায় মেতে ওঠে সবাই। আর সুবিধা নেয় সুযোগ সন্ধানী কোনো তৃতীয়পক্ষ- মিডিয়া, সাংবাদিক, নাট্যকার কিংবা অন্য কেউ। কিন্তু সত্যিকারের বিবেকবান মানুষ সে সাংবাদিক, ফটোগ্রাফার, উদ্ধারকর্মী, মালিক পক্ষ কিংবা সংশ্লিষ্ট সরকারি বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা যেই হোক না কেন- কোনোভাবেই তারা দায়িত্ব এড়াতে পারে না। ঝুঁকিপূর্ণ জায়গায় বহুতল ভবন নির্মাণের অনুমতি দেয় কে কিংবা কেন, নেই এর তদারকি, ফিটনেস সার্টিফিকেট ছাড়া কী করে জলে-স্থলে চলে লঞ্চ, বাস, ট্রাক ? ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় কীভাবেই বা চলতে থাকে দিনের পর দিন রাসায়নিক শিল্প কারখানা ? ফলে ভবনধস, অগ্নিকাণ্ড, লঞ্চডুবি কিংবা সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান সাধারণ মানুষ, দিনমজুর আর শ্রমজীবীরাই। এসব হতাহতের ঘটনা একসময় শুধুই একটি খবর বা লেখকের লেখার দুর্দান্ত বিষয়বস্তুই হয়ে থাকে বিস্মৃতিপ্রবণ মানুষের কাছে। কিন্তু যার পোড়ে, বা যে হারায় স্বজন কিংবা নিজের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ- তারই কেবল পোড়ে এবং পুড়তে থাকে আমৃত্যুকাল অবধি। নিদেনপক্ষে হয়ত তারা হন পাণ্ডুলিপির একেকটি চরিত্র। শেষ পর্যন্ত এইটুকুই তাদের প্রতিদান। দর্শক মনে তা কিছু আহা, উহু জন্ম দেওয়া ছাড়া তারা বেঁচে থাকে আর কোথায় ? দিনের পর দিন তাদের জীবন চলে একই বঞ্চনায়, কিন্তু কোনোদিন কাঠামো বদল হয় না সিস্টেমের। 

তত্র পোড়ে যত্র দগ্ধ- এ নাটকটি দেখে এই কথাগুলোই জন্ম নেয় মনে। নাট্যকার সৌম্য সরকার তার নাটকের মাধ্যমে দর্শক মনে কিছু প্রশ্ন উসকে দিয়ে যান শেষমেশ। আর এই নাট্যপ্রযোজনাটি মঞ্চায়িত হয় বটতলা থিয়েটারের অঙ্গসংগঠন ‘অ্যাক্টরস স্টুডিয়ো’র ৮ম ব্যাচের শিক্ষার্থীদের প্রচেষ্টায় গত ৭ সেপ্টেম্বর মহিলা সমিতির নীলিমা ইব্রাহিম মঞ্চে। নাটকের নির্দেশনা দেন ইমরান খান মুন্না।

এদিন ‘তত্র পোড়ে যত্র দগ্ধ’ নাটকটি নিয়ে মঞ্চে উঠেছিলেন বটতলার অ্যাক্টরস স্টুডিয়োর অষ্টম আবর্তনের ১১ জন নবীন অভিনয়কর্মী। কাঠের শুধু ৩টি পাটাতন ব্যবহার করে খুব সাধারণ একটি সেট বানিয়েই অসাধারণ শারীরিক কলাকৌশল ও কোরিওগ্রাফির মাধ্যমে নিপুণভাবে অভিনেতারা তুলে ধরেন নানা দৃশ্য। ঝড়ের আঘাতে লঞ্চডুবি, ভবন ধসে পড়া ও আটকে পড়া আহত-নিহত কর্মীদের মর্মান্তিক দশা, ডিপোতে আটকে পড়া মজুর-শ্রমিকসহ শ্বাসরুদ্ধকর আহাজারি তারা ফুটিয়ে তুলতে সক্ষম হয় আলো, শব্দ, সংগীত ও দেহভঙ্গিমার মাধ্যমে। দেশের ভয়াবহ কিছু দুর্ঘটনাকে উপজীব্য করে লেখা এই নাটকের বিষয়বস্তু গাম্ভীর্যপূর্ণ হলেও সংলাপ ছিল মূলত হাস্যরসাত্মক ও স্যাটায়ারধর্মী। মিলনায়তন ভর্তি দর্শককে তাই হেসে উঠতে দেখা গেছে ক্ষণে ক্ষণেই। অভিনেতাদের রসিকতাপূর্ণ সংলাপ ও কার্যকলাপ তাই বলে বিষয়বস্তুকে মোটেও হালকা করেনি বরং গভীরভাবে ভাবতে সাহায্য করেছে দর্শককে। এই প্রযোজনায় শিক্ষার্থীদের একনিষ্ঠতার পরিচয় পাওয়া যায় সুস্পষ্টভাবে। অভিনয়ে তারা সবাই ছিলেন বেশ সাবলীল ও পরিমিত। তবে কিছু কিছু দৃশ্যের সংলাপ প্রক্ষেপণের গতি শ্লথ না হয়ে যদি আরেকটু বেগবান হতো তবে নাটক আরো সুদৃঢ় হতো বলে মনে হয়েছিল। নতুন শিক্ষার্থীরা নিশ্চয়ই পরবর্তী প্রদর্শনীতে কাক্সিক্ষত গতিটি ধরতে পারবেন। নাটকের সংগীত, আলো, পরিশীলিত কস্টিউম সব মিলিয়ে উপভোগ্য একটি প্রযোজনা হিসেবেই দাঁড় করতে পেরেছিল এই টিমটি। হয়ত এই প্রযোজনাটিকে বটতলা যুক্ত করে নেবেন ভবিষ্যতে তাদের অন্যান্য প্রযোজনার সঙ্গেও পথে, মঞ্চে সচেতনায়নে।

এদিন ৮ম আবর্তনের শিক্ষার্থীদের এই নাট্য-পরিবেশনার পর তাদের হাতে সনদপত্র তুলে দেন বটতলার ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টর মোহাম্মদ আলী হায়দার। শিক্ষার্থী, কোরিওগ্রাফার, নাট্যকার ও নির্দেশকের হাতে ফুলের শুভেচ্ছা তুলে দেন জনাব আব্দুল কাদের ও মিজানুর রহমান। বক্তব্য রাখেন বটতলার সভাপতি জনাব শফি আহমেদ ও অ্যাক্টরস স্টুডিয়োর মুখ্য প্রশিক্ষক ও নির্বাহী কাজী রোকসানা রুমা এবং অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন অ্যাক্টরস স্টুডিয়োর প্রধান শিক্ষক ড. সামিনা লুৎফা নিত্রা। অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে শিক্ষার্থী অরণি সেমন্তি খান বলেন, ‘চার মাসে অভিনয় শেখা সম্ভব নয়, তবে আমরা যে মানুষটা ছিলাম চার মাস আগে, সেই মানুষটি আমরা এখন আর নেই। আমরা অভিনয় কতটুকু শিখতে পেরেছি তা জানি না তবে আমরা সমাজ ও রাজনীতি সচেতন হয়েছি অনেক, যা আমাদের জীবনবোধ পাল্টে দিয়েছে।’

এযাবৎ বটতলা অ্যাক্টর্স স্টুডিয়োর ৮টি আবর্তন সমাপ্ত হলো এবং নবম আবর্তন শুরু হতে যাচ্ছে শিগ্গিরই। নতুন এই ছেলেমেয়েরা অ্যাক্টর্স স্টুডিয়োর এই প্রশিক্ষণ যজ্ঞের মধ্য দিয়ে নাট্যাভিজ্ঞতা অর্জন করতে ও শিল্পের নানা পথ খুঁজে নিতে পেরেছে- এমনটাই প্রত্যাশা বটতলার। প্রশিক্ষণ শেষে আগ্রহী শিক্ষার্থীরা যুক্তও হতে পারে বটতলার সঙ্গে তাদের নানা কর্মযজ্ঞে। বটতলার ছায়াতলে সেই সুযোগ তো তাদের থাকছেই। 

লেখা : ধীমতি শুচিস্মিতা