ইউরোপের ১৫০ দিন -সৈয়দা তাসলিমা আক্তার

22 Oct 2023, 03:44 PM ভ্রমন শেয়ার:
ইউরোপের ১৫০ দিন  -সৈয়দা তাসলিমা আক্তার

[পূর্ব প্রকাশিতের পর]


জীবনে চলার পথে কারণে-অকারণে কত জনের কাছে কত ঋণ জমা হয়ে যায়। নিঃসন্দেহে ঋণের প্রতিদান হয় না। তবে, প্রয়োজনে পাশে থেকে কৃতজ্ঞতা তো অন্তত জানানো যায়। কিন্তু যদি এমন কারো কাছে কোনো ঋণ জমে যায় যে, যার সাথে জীবনে আর কখনো দেখা হলো না অথবা দেখা হওয়ার কোনো সুযোগ নেই বিষয়টা আসলেই খুব অস্বস্তিকর। জানি না এরকম কারো সাথে হয়েছে কি না। তবে, আমার সাথে হয়েছে, একাধিকবার হয়েছে। অন্য কোনো গল্পে যাচ্ছি না। তবে, অসলোতে এসে যা হলো তাই বলি ; আগেই বলেছি বাসের ডে টিকেট কাটবো এখানে স্টপেজে টিকেট কাটার কোনো ব্যাবস্তা নেই, রেগুলার টিকেট বাস থেকেই কেটে নেওয়া যায়। তবে, ডে-টিকেটের জন্য এখন সিটি সেন্টারই সব থেকে সুবিধাজনক জায়গা। যদিও আজ আমাদের ভ্রমণ পরিক্রমায় সিটি সেন্টার ছিল না কিন্তু টিকেটের জন্য যেতে হচ্ছে। এটা একটু ঘুরপথ হলেও খুব যে একটা সমস্যা তা নয়। তবে, সমস্যা একটা ছিল এবং এটা মোটামুটি জটিলই বলা যায়। সিটি সেন্টারে যেতে নির্দিষ্ট বাসে উঠে বসলাম, বার্গেনে বাসে কোনো টিকেট কাটার ব্যবস্থা না থাকলেও অসলোতে এই ব্যাবস্তা আছে, তাই বিনা টিকেটেই বাসে উঠে পড়লাম। একটা কনফিউশন ছিল যে, মেশিনে কয়েন ছাড়া টিকেট কাটা যায় কি না, তবে ধরে নিয়েছিলাম কার্ডে নিশ্চয়ই কাটা যাবে। আমাদের কাছে টিকেট কাটার জন্য পর্যাপ্ত কয়েন সম্ভবত নেই, সম্ভবত বলছি এই কারণে যে, গুনে দেখা হয়নি। বাসে ওঠার সাথে সাথেই বাস ছেড়ে দিল এ ব্যাপারে নিশ্চিন্ত হওয়ার আগেই, বাস চলতে শুরু করলে ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করে জনতে পারলাম কয়েন ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। আমি আর ফারজানা দু’জনেই বেশ অস্বস্তি নিয়ে নিজেদের পার্স আঁতিপাঁতি করে খুঁজতে শুরু করলাম কয়েন পাওয়া যায় কি না। তাও এক/দুই টাকার কয়েন না দু’জনের পুরো নব্বই নক (নরওয়েজিয়ান মুদ্রা)। নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছে আমরা আমাদের কাছে আঁতিপাঁতি করে খুঁজে পাওয়া কয়েনগুলো দিয়ে টিকেট কিনতে গেলে ডাইভার আমাদের বাস থেকে নেমে অপেক্ষা করতে বলল তারপর আমাদের অবাক করে দিয়ে পয়সা না নিয়ে এমন কি কিছু বলার সুযোগ পর্যন্ত না দিয়ে আমাদের ‘বাই’ বলে চলে গেল। আমি আর ফারজানা দুজনেই পুরো থ, ইউরোপে যেখানে পাই পয়সার হিসেব হয় সেখানে এটা কী হলো ? সময় লাগলো এই কিংর্কতব্যবিমূঢ় অবস্থা থেকে বের হতে।

ধাত¯’ হয়ে আমরা টিকেট কাউন্টারে গিয়ে ২৪ ঘণ্টার দুটো টিকেট কিনে নিলাম। এতটা পথ উজানে এসে এখন ভাবতে বসলাম, কোথা থেকে শুরু করা যায়। গুগল মামার সাহায্যে জেনে নেওয়ার চেষ্টা করলাম আশে-পাশে দেখার মতো কিছু আছে কি না। না বেশ কিছু শপিংমল ছাড়া আমাদের জন্য আর কিছু নেই, আসলে থাকার কথাও নয়। কেননা, সিটি সেন্টারগুলো মূলত বাণিজ্যিক এলাকা হিসেবেই গড়ে ওঠে ; যেখানে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি দপ্তরের কার্যালয় থাকে, থাকে বিশাল বিশাল শপিং সেন্টার আর বেশ কিছু আবসিক হোটেল, যেমন আমাদের মতিঝিল এলাকা। যেহেতু কেনাকাটা বিষয়টি আমাদের সিলেবাসে ছিল না তাই বাসে করে চলে গেলাম নোবেল গেট এলাকায়, অসলো সিটি সেন্টার থেকে বাসে নোবেল গেট যেতে সময় লাগে প্রায় আধ ঘণ্টার মতো। নোবেল গেট কেন এলাম ? অসলো আসার আগেই vigeland park  সম্পর্কে জেনে ছিলাম, ভালোর থেকে মন্দ কথাই শুনে ছিলাম বেশি। ভিজিল্যান্ড পার্ক vigeland park প্রসঙ্গে বিশেষ করে বাঙালিরা তো রীতিমতো ইউরোপীয়ানদের রুচিবোধ নিয়ে তাদের চৌদ্দ গোষ্ঠী উদ্ধার করে দিতে ছাড়েনি। আমরা মূলত কৌতূহল থেকেই এ পার্কটি দেখতে যাই, আর অনেকটা ‘নাই কাজ তো খই ভাজ’ এমন সময় পার করছিলাম, সময়টাও কাজে লাগালাম। বিশাল এলাকাজুড়ে পার্কটির প্রাকৃতিক পরিবেশ নেহায়েত মন্দ না, তবে পার্কের যে বিশেষত্ব তা কেন বিশেষভাবে প্রর্দশিত এ বিষয়টি আমরাও বুঝতে পারিনি। vigeland park নিয়ে তখন থেকে মুখবন্ধ লিখে যাচ্ছি আসল কথা এখনও বলা হলো না ; যাই হোক, মূল বিষয়ে আসি, এটি মূলত একটি ভাস্কর্য সমৃদ্ধ পার্ক। পার্কের সদর দরজা থেকে শুরু করে পুরো পার্কজুড়ে ছড়িয়ে আছে বয়স, লিঙ্গ ভেদে মানুষের বিভিন্ন আকৃতি আর ভঙ্গিমার মূর্তি। বলা বাহুল্য, ভাস্কর্যের সব আদলই ছিল একদম আদিরূপে, বসনের কোনো বালাই ছিল না। আর মন্দ কথার কারণ ঠিক এটাই। একটা প্রবাদ আছে না ‘এক দেশের গালি আরেক দেশের বুলি’। আমাদের প্রাচ্যের ভাবধারায় বেড়ে ওঠা মন আর চোখ যা স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করতে অনভ্যস্ত প্রাশ্চাত্যে হয়ত তাই শিল্প বা সংস্কৃতির ক্লাসিক প্রকাশ। vigeland park-এর ভাস্কর্যের বিশেষত্ব এটাই যে, মানবকূলের আদি বা প্রাকৃতিকরূপ। ভাস্কর্যের ন্যুডরূপটি আমাদের কাছে যতটা কদর্য পাশ্চাত্যে কিন্তুকিন্তু তা নয়। যাই হোক, কৌতূহলবশত যাওয়া এবং বুঝতে চেষ্টা করা শিল্পীর মনন আর শিল্পের তাৎর্পয। সন্দেহ নেই এখানে আমদের অর্জন শূন্য, আসলে আমরা কিছুই বুঝতে পারিনি। তবে পার্কে যেহেতেু এসেছি পুরোটা ঘুরে যাওয়াই ভালো নতুবা আবার খাটুনি পোষাবে না। আগেই বলেছি, বিশাল এলাকাজুড়ে পার্ক, এখানে সেখানে বসার ব্যব¯’া থাকলেও বসার উপায় নেই। কেননা, থেকে থেকে ঝিরঝির বৃষ্টির মতো তুষার পড়েই যাচ্ছে  তাই সবটাই ভেজা। মাঝে মাঝে অবশ্য সূর্য উঁকিঝুকি মারছে না তা নয়। তবে, তা ক্ষণিকের জন্য। একটা ঠান্ডা মেঘলাদিনের প্রায় পুরোটা সময় পার্কে কাটিয়ে আমরা আবার শহরের দিকে রওনা হলাম।

নভেম্বরের শেষ থেকেই ইউরোপজুড়ে ক্রিসমাসের আমেজ। জায়গায় জায়াগায় রয়েছে কার্নিভালের আয়োজন। এমনি একটি কার্নিভালের পথে এখন আমরা। বাসে করেই যেতে হবে তবে, যে পথটুকু হেঁটে যাচ্ছি সে পথে নতুন কিছু দেখলেই থামছি ছবি তুলছি, আবার হাঁটছি, যেহেতু আমাদের তেমন কোনো তাড়া নেই সূর্য যদিও অস্তাচলে কিš‘ ঘড়ির কাঁটা তখন মাত্র চারটের ঘরে ; আমরা আবার আজই বারগেন ফিরে যাব, ট্রেন সেই রাত্রি ১১টায়। হাতে এখনও প্রায় ঘণ্টা ছয়েক সময়, তাই সময় কাটাতেই এদিক-সেদিক ঘোরাঘুরি। পথে যেতে যেতে বার কয়েকই খাড়ির দেখা মেলে নানান স্থানে, দেখা মেলে বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন যাদের আমরা সোসালিস্ট বলে থাকি, তাদের ভিন্নধর্মী প্রচারণামূলক ব্যানার, ম্যুরাল। এছাড়া ইউরোপের পথে-ঘাটে গ্রাফিতি আর্ট বলে একধরনের দেয়ালচিত্র দেখা যায়। বেশিরভাগ সময়ই এটা একধরনের প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে ব্যবহৃত হয় কখনো কখনো এটা শিল্পীর একান্ত নিজস্ব ভাবনা বা ভালো লাগা থেকেও আঁকা হয়ে থাকে। এছাড়াও শিল্পের আরো বৈচিত্র্যময় উপস্থাপনার দেখাও মেলে চলতি পথে। ইউরোপ প্রবাসের এই মাস চারেক সময়ে গ্রাফিতি চিত্র এখন আর চট করে দৃষ্টিকে আর্কষিত করে না, ব্যাপারটা বেশ সাদামাটা বা চোখসওয়া হয়ে গেছে। তবে অসলোতে যে বিষয়টি বেশ চমৎকৃত করেছে নিঃসন্দেহে আমার কাছে তো বটেই আরো অনেক পথচারীর কাছেই এধরনের উপস্থাপনা অভিনব বলেই মনে হবে। একইসাথে উপস্থাপনার ধরনে এত নান্দনিকতা ছিল যে, এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগই ছিল না। প্রথমে ভেবেছিলাম এটা ছোটোখাটো জাহাজের ছাদ বা তার আদল, আবার ভেবেছি এটা কোনো শোকস্মৃতিকে ধারণ করে আছে এমন কোন স্কালপ্চার হবে হয়ত। আমরা এর রহস্য উদ্ঘাটনের চেষ্টায় কিছুটা সময় খরচ করলাম, এখানেও আমরা ব্যর্থ হলাম। বিভিন্ন আকারের অগণিত শার্টের সাহয্যে নির্মিত একটি কাঠামো এটাকে ঠিক কীভাবে ব্যাখ্যা করা যায় ; আমি এর কোনো নাম বা উপমা খুঁজে পাইনি। যাই হোক, কাঠের কাঠামোতে ঝুলে থাকা অসংখ্য শার্টের চাদোয়ার নিচ দিয়ে হেঁটে এসে একজায়গায় ছোট্ট করে যে লেখাটা পেলাম তা আবার আমাদের ভাবনাকে গুলিয়ে দিল।

kaarina kaikkonen, we are still the same 2018, 1200 shirts  পুরো বিষয়টা আসলেই মাথার উপর দিয়ে গেছে। পরে নেট ঘেঁটে যেটুকু তথ্য পেলাম তা হলো কারিনা কাইকোন একজন সুপরিচিত ইউরোপিয়ান শিল্পী যার শিল্পের মাধ্যম অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বিভিন্ন ধরনের ফেব্রিক। আর এ স্ট্রাকচারটি কারিনা কাইকোন আর নরওয়েজিয়ান কালচারাল ইন্সটিটিউটের একটি যৌথ উদ্যোগ ছিল। যদিও we are still the same 2018, 1200 shirtsএই স্কাল্পচারটিতে তিনি আসলে কি ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছেন তার কোনো ব্যাখ্যা আমি কোথাও পাইনি।  [চলবে]