রবীন্দ্রনাথের পূজার গান -ছায়া কর্মকার

23 Oct 2023, 01:11 PM সারেগারে শেয়ার:
রবীন্দ্রনাথের পূজার গান  -ছায়া কর্মকার

সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাংলা গান ‘রবীন্দ্রসংগীত’। এ গান কেবল সুর ও ছন্দের জাদুতেই আশ্চর্য সৃষ্টি নয়। কবিজীবনের যা কিছু শ্রেষ্ঠ বাণী তা বলা হয়েছে এ গানের মধ্য দিয়ে। ঈশ্বর, মানব ও প্রকৃতি বিষয়ে তাঁর যাবতীয় উপলব্ধি ও অনুভূতি, আদর্শ ও বিশ্বাস গভীর অন্তরঙ্গতায় ধরা পড়েছে তার গানের বাণীতে। শুধু তাই নয়, নানা যুগে রচিত বাংলা গানের যাবতীয় বৈচিত্র্যের স্বাদ পাওয়া যায় রবীন্দ্রনাথের গানে। আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের সাধারণ বিষয়গুলো তার গানে বাদ যায়নি। অথচ একই সঙ্গে তা অসীমের বার্তাবাহী। আর এই জন্যই রবীন্দ্রসংগীত মানুষের চিরকালের আদরের ধন।

রবীন্দ্রনাথের গানে বিষয়ের বৈচিত্র্য নানান দিক থেকে বিস্ময়কর। পৃথিবীর যারা বিখ্যাত গীতিকার তারা সকলেই একটি বা দুটি ভাব বা বিষয় নিয়ে সার্থক গান রচনা করেছেন। রসোত্তীর্ণ প্রেমের গান যিনি লিখেছেন, ভগবান বিষয়ক গানে তিনি হয়ত তেমন সাফল্য দেখাতে পারেননি। কেউ হয়ত প্রকৃতির নানা রূপের বর্ণনায় সার্থক গীতিকার, কিন্তু প্রেমের গান রচনায় নিতান্তই অপটু। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ তাঁর বহুমুখী প্রতিভাবলেই বহু বিচিত্র বিষয়, ভাব ও ভাবনার গান লিখেছেন এবং সকল ক্ষেত্রেই তার রচনা সমান সার্থক ও রসোত্তীর্ণ। মানব মনে এমন কোনো ভাবনা নেই রবীন্দ্রনাথ যাকে গানে বাণীবদ্ধ করেননি। প্রকৃতিতে এমন কোনো রং নেই, এমন কোনো নিহিত দর্শন নেই যার সার্থক প্রতিফলন রবীন্দ্রনাথের গানে ঘটেনি।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা গানের এক অনন্য শ্রষ্টা। তাঁর সমস্ত সৃষ্টির মধ্যে গানকে তিনি অনন্য স্থান দিয়েছেন। তিনি প্রত্যাশা করেছেন গানের ভেতর দিয়েই তিনি চিরকাল বেঁচে থাকবেন। এই প্রত্যাশাটি তার ‘গীতবিতানে’র বিন্যাসেও লক্ষ্য করা যায়। তিনি ভাববোধের দিক দিয়ে তাঁর গানকে ছয়টি পর্যায়ে বিভক্ত করেছেন। যেমন, পূজা, স্বদেশ, প্রেম, প্রকৃতি, বিচিত্র এবং আনুষ্ঠানিক। কবি তার গানের ভাববোধকে প্রাধান্য দিয়েছেন বলেই আমরা এই বিন্যাসটি আস্বাদন করতে পারি।

রবীন্দ্রনাথ প্রায় আড়াই হাজার গান লিখেছেন। এগুলো বিশ্ব প্রকৃতির গান, বিশ্বপতির গান, বিশ্বমানবের গান। পূজাপর্যায়ের গানগুলো বিশেষ অধ্যাত্ম উপলব্ধির গান। এই গানগুলোর কেন্দ্রে রয়েছে ঈশ্বর সম্পর্কে তার নিবিষ্ট অনুভূতিগুলোর কথা। কবি তার অনুভূতির গভীরে ভগবানকে সেসব রূপে উপলব্ধি করেছেন, এই পর্যায়ের গানগুলো তাই ব্যক্ত হয়েছে, কখনো আনন্দে, কখনো বিস্ময়ে, কখনো বেদনায়। ভক্তি, জ্ঞান ও কর্মযোগের বাইরে এক সহজ বিশ্বাস ও প্রেমের পথে তিনি ঈশ্বরকে নিজের জীবনে উপলব্ধি করেছেন। উপনিষদের আলোকে অদ্বৈতবাদী কবি ঈশ্বরকে দেখেছেন নিরাকার পরমেশ্বররূপে- তিনি এক অদ্বিতীয়ম। তিনি মহাপ্রবলবলী, তিনি রাজেন্দ্র কিন্তু তিনি অরূপ। তিনিই বিশ্বাত্মা, মানবাত্মা তাঁরই অংশ।

কতগুলো গানে কবি একান্তভাবে লীলাবাদী, বৈষ্ণবীয় দ্বৈতাদ্বৈতবাদের প্রতিধ্বনি শোনা যায় সেখানে। এ সব গানে বলা হয়েছে, জগত ও জীবনের শত বৈচিত্র্যের মধ্য দিয়ে অনন্ত লীলাময় ভগবানেরই নিত্যপ্রকাশÑ ভক্তের সঙ্গে ভগবানের যে লীলা, তা তার নিজেরই সঙ্গে নিজেরই লীলা। এ সব গানে দেখা যায় ঈশ্বরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ মধুর রসের সম্পর্কের মধ্য দিয়ে মাধুর্যবাদী কবি তাকে জীবনে অনুভব করতে চেয়েছেন। এই লীলাবাদী অধ্যাত্ম অনুভূতির আরেকটি বক্তব্য এই যে, মানুষ যেমন ঈশ্বরের করুণা ও স্নেহস্পর্শ কামনা করে, ঈশ্বরও তেমনি মানুষের প্রেমের ভিখারি। স্ব-মহিমাকে আস্বাদন করার জন্যেই অনন্ত ভগবান নেমে আসেন ভক্তের সীমানায়।

উনিশ শতকের দিকে রাজা রামমোহন রায় [১৭৭২-১৮৩৩] বাঙালির কাছে উপনিষদ উপস্থাপন করেন ব্রাহ্মধর্ম ও ব্রাহ্ম সমাজের সূত্র ধরে। রবীন্দ্রনাথ উপনিষদ পেয়েছেন একপ্রকার পারিবারিকভাবেই। তবে, ঠাকুর বাড়িতে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর [১৮১৭-১৯০৫] ব্রাহ্মধর্মের উপাশনায় উপনিষদ পুরোপুরি অনুসরণ না করে সামঞ্জস্য রেখে বরণ করেছেন। রবীন্দ্রনাথের রচনাতেও তার নিজস্ব চিন্তার প্রয়োগ, গৃহশিক্ষা ও পরিবেশের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। প্রারম্ভে ব্রহ্মসংগীত রচনা একপ্রকার তার দাদাদের অনুসরণে হলেও কবি এতেই পরবর্তীসময়ে বর পেয়েছিলেন। তাঁর পূজাপর্যায়ের গানের বাণীর সমৃদ্ধি তারই প্রমাণ।

পূজাপর্যায়ের অনেক গানে রবীন্দ্রনাথ ঈশ্বরকে দেখেছেন চিরচঞ্চল পথিকরূপে তাঁর হাতের সম্মোহনী বাঁশির ডাকে মানুষ জন্ম জন্মান্তরের মধ্য দিয়ে ছুটে চলেছে সেই চির অধরাকে লক্ষ্য করে। মানুষও তাই চির পথিক। অনাদি অতীত থেকে অনন্ত ভবিষ্যৎ পর্যন্ত বিস্তৃত এই লীলার পথে মানুষের এ হলো এক অশেষ অভিসার যাত্রা। পূজাপর্যায়ের যাত্রী মনোভাবের গানগুলোতে এই দর্শন নিহিত।

পূজাপর্যায়ের গানে রবীন্দ্রনাথের ঈশ্বর ভাবনা এক নতুন মাত্রা পেয়েছে। রবীন্দ্রনাথের গানের বাণীতে ঈশ্বরকে তিনি বহুভাবে সম্বোধন করেছেন। কখনো নাথ, স্বামী, প্রভু এ সকল একজনকেই সম্বোধন করলেও ভিন্ন ভিন্ন অনুষঙ্গ বহন করেছে জগৎ ও জীবনের শত খ-তা ও সীমাবদ্ধতার মধ্যেই তিনি অসীম অনন্তকে উপলব্ধি করতে চেয়েছেন। রূপময় জীবন অস্বীকার করে নয়, তাকে পূর্ণমাত্রায় ভোগ করতে চেয়েছেন তিনি। নিছক ভোগের জন্যই এ ভোগ নয়- এ হলো জীবনের পাত্রে চিরন্তন রূপ ও রসের ভোগ। তিনি রূপসাগরে ডুব দিয়েছেন অরূপরতন আশা করে। রবীন্দ্র-অধ্যাত্মচেতনার এই বিশিষ্ট দিকগুলোই পূজাপর্যায়ের গানের বিষয়বস্তু। ভাবের বিচারে এই গানগুলো কয়েকটি উপপর্যায়ে বিভক্ত। যথা : প্রার্থনা- ‘অন্তর মম বিকশিত কর অন্তরতর হে।’ বন্ধু- শুধু তোমার বাণী নয় গো হে বন্ধু, হে প্রিয়।’ বিরহ- ‘পথ চেয়ে যে কেটে গেল কত দিনে রাতে।’ গান- ‘গানে গানে তব বন্ধন যাক টুটে।’ সাধনা ও সংকল্প- ‘প্রতিদিন আমি হে জীবন স্বামী।’ সুন্দর- ‘মোর সন্ধ্যায় তুমি সুন্দর বেশে এসেছ।’ আত্মবোধন- ‘শান্ত হরে মম চিত্ত নিরাকুল’। পথ- ‘পথ দিয়ে কে যায় গো চলে।’ আনন্দ- ‘আনন্দ গান উঠুক তবে বাজি।’ আশ্বাস- ‘আছে দুঃখ আছে মৃত্যু বিরহ দহন লাগে’...

রবীন্দ্রনাথ তাঁর জীবনের প্রথম দিকে ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণ ও চর্চা একনিষ্ঠভাবে করলেও সময়ের সাথে তিনি তাঁর ঈশ্বর ভাবনা প্রকাশ করেছেন নিজ আঙ্গিকে। তার সকল রচনার মধ্যে পূজাপর্যায়ের গানের বাণীতে ঈশ্বরের রূপ, মানব ও ঈশ্বরের সম্পর্ককে নানাভাবে ফুটিয়েছেন। তার মুক্তদৃষ্টির ঈশ্বর ভাবনার প্রকাশ হয়েছে জীবন অভিজ্ঞতার মাধ্যমে। পূজাপর্যায়ের গানে ঈশ্বরকে তিনি বারংবার নাথ, স্বামী, প্রভু সম্বোধন করলেও এগুলো ভিন্ন ভিন্ন অনুষঙ্গ বহন করেছে। লক্ষ্য করা যায় ‘প্রভু’ সম্বোধনটি প্রায় যুক্ত হয়েছে এক আলো ফুটে ওঠার প্রসঙ্গে। যেমন : ‘প্রভু, তোমার বীণা যেমনি বাজে আঁধার মাঝে, অমনি ফোটে তারা’। ‘প্রভু বলো বলো কবে’; ‘প্রাণ ভরিয়ে তৃষা হরিয়ে’, প্রভৃতি। এমনকি যেখানে আলোর প্রসঙ্গ নেই সেখানেও ‘বজ্রবেদনার’ কথা ও ফুল ফুটে ওঠার প্রসঙ্গ এসেছে। অন্যদিকে ‘নাথ’ বা ‘স্বামী’ সম্বোধনে রাত্রির অনুষঙ্গ অকর্ষিত হয়েছে। এখানে রাত্রির মধ্য দিয়ে কবি মনের গভীর বাসনা কামনাকে প্রকাশ করেছেন। যেমন : ‘শূন্যহাতে ফিরি হে নাথ’; ‘জীবন যখন শুকায়ে যায়’ গানটিতে ‘হে জীবন নাথ’ সম্বোধনটি বাসনা পূর্ণের লক্ষ্যে উপস্থাপন করা হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের গানে আমরা বহুবার ‘রাজা’ সম্বোধন পেয়েছি। এই ‘রাজা’র ক্ষুদ্র সৃষ্টি হিসেবে তিনি নিজেকে উপস্থাপন করেছেন। আবার কোথাও ভৃত্য বলে অভিহিত করেছেন। ‘রাজা’ সম্বোধন করে তিনি যেমন তার অসীম প্রতাপের বর্ণনা দিয়েছেন তেমনি সৃষ্টির হৃদয়ে যে নাথ হিসেবে এসেছেন সেই বিষয়টিও তার বাণীতে উপস্থাপন করেছেন। যেমন : ‘জগতে তুমি রাজা, অসীম প্রতাপ

হৃদয়ে তুমি হৃদয়নাথ হৃদয়হরণ রূপ ॥’


রবীন্দ্রনাথ তাঁর প্রথম জীবনে অনেক হিন্দি গানের সুর ভেঙে ব্রহ্মসংগীত রচনা করেছেন। দাদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রনাথ এক আনন্দময় প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে যদু ভট্টের গান বাংলায় রূপান্তরিত করতেন। ‘সোনার তরী’র ‘বৈষ্ণব’ কবিতায় রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, “প্রিয়জনে যাহা দিতে চাই তাই দিই দেবতারে।”

তিনি তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ সাধনাকে দেবতার বেদীতে অর্ঘ্যরূপে নিবেদন করেছেন। ঠাকুর বাড়িতে ব্রহ্মসংগীত রচনা নিছক আনুষ্ঠানিক ধর্মবোধ ও কর্তব্যের জন্য নয় বরং গীতি-আন্দোলনের এক আবহাওয়া সৃষ্টি করেছিল। গানের বাণী ও সুরে কবি দেবচরণে আত্মনিবেদন করেছেন। যদু ভট্টের “রুমঝুম বরখে আজু বাদরবা পিয়া বিদেশ মোরি” এই প্রেমের গানটির সুর নিয়ে কবি রচনা করেছেন পূজার গান :

শূন্য হাতে ফিরি হে নাথ, পথে পথে

শূন্য হাতে ফিরি হে দ্বারে দ্বারে-

চিরভিখারি হৃদি মম নিশিদিন চাহে কারে ”... 

লেখক : রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী