অনুস্বরের হার্মাসিস ক্লিওপেট্রা

19 Nov 2023, 01:17 PM রঙ্গশালা শেয়ার:
অনুস্বরের হার্মাসিস ক্লিওপেট্রা

এককথায় বলতে গেলে এভাবেই বলতে হয়- একটি পরিশীলিত, মার্জিত ও সুনির্মিত প্রযোজনা ‘হার্মাসিস ক্লিওপেট্রা’। হার্মাসিস ক্লিওপেট্রা নাটকের এদিন ছিল ৬ষ্ঠ প্রদর্শনী। এ নাটকের প্রথম মঞ্চায়ন হয় ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দের ২৩ আগস্ট। আর নাটকটি নির্দেশনা দেন অভিজ্ঞ নাট্যজন মোহাম্মদ বারী।

চোখ ঝলসানো আলো-সেটের আড়ম্বরতা, ঢাক-বাদ্য, নৃত্যযোগে দারুণ একটা নাটক উপহার দেওয়ায় যখন অনেকে মগ্ন, তখন চিত্রকলার মতো নীরবে, দর্শকের মনের বীণা-তারে অনুরণন তুলে দিয়ে যায় হার্মাসিস ক্লিওপেট্রা- যার মূল শক্তি প্রত্যেকের সুঅভিনয়, স্বাভাবিক বাচনভঙ্গি এবং অনুচ্চকিত অভিব্যক্তি। আতিশয্যের অনুপস্থিতি দর্শককে বাধ্য করে সংলাপে মনোনিবেশ করতে। দর্শক তখন সংলাপের মর্ম বা দার্শনিকতা নিয়ে কিছুটা গভীরভাবে ভাবতে অবকাশ পায়। তাই বলে নাটক কি ছিল শূন্য মঞ্চে ? কিংবা আলো, সংগীত, নৃত্য, দ্রব্যসামগ্রী ব্যতিরেকে ? তা নিশ্চয়ই নয়। পরিমিত ও যথার্থতার উপস্থিতি ছিল তার সব ক্ষেত্রেই- ঘটনার পরিবেশ ও আবহ সৃষ্টিতে ঠিক যতটুকুই ছিল প্রয়োজন। পোশাক, অলংকার, রূপসজ্জা সব কিছুতেই ছিল সময় ও সংস্কৃতিকে তুলে ধরার প্রয়াস।

প্রাচীন মিশরের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে লেখা এই নাটকের মূল বয়ান- প্রেম ও দায়িত্ববোধের দ্বন্দ্ব। একদিকে প্রেম অন্যদিকে মিশরকে গ্রিকদের শাসন-বলয় থেকে মুক্তি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি- কোনটিকে বেছে নেবে হার্মাসিস ? হার্মাসিসের জ্ঞান ও আত্মসম্মান স্মরণ করিয়ে দেয় যে, প্রতিপক্ষকে পেছন থেকে নিরস্ত্র অবস্থায় বধ করা অন্যায়। কিন্তু মিশরের জনগণ স্বাধীনতা লাভের আশায় চেয়ে থাকে হার্মাসিসের দিকে। অন্যদিকে মুক্তির আশায় চারমিয়ন, দীর্ঘদিন ক্লিওপেট্রার দাসী হয়ে থেকেও কামনা করে ক্লিওপেট্রার ক্ষমতার অবসান। তাই সে প্রতিপক্ষ হার্মাসিসকে দিতে থাকে নানা মন্ত্রণা। ক্লিওপেট্রাকে বধ করে হার্মাসিস হবে সম্রাট আর চারমিয়ন হবে সম্রাজ্ঞী- এই অভিপ্রায় তাকে ব্যপ্ত করে রাখে সর্বক্ষণ। হার্মাসিস আহত হয় চারমিয়নের এমন মনোবাসনায় কেননা মিশরের মুক্তিকামিতার চেয়েও ব্যক্তিগত লোভ-লালসায় লালিত হয়ে আছে চারমিয়ন ! তাহলে চারমিয়নের দেশপ্রেম কি তবে ব্যক্তিগত স্বার্থ উদ্ধারেরই খেলামাত্র ? হার্মাসিসের মনে উদয় হওয়া এমনি নানা প্রশ্ন দিয়ে নাট্যকার রাহমান চৌধুরী দর্শকদের চিন্তালোকেও নানা ভাবনার উদ্রেক ঘটাতে থাকেন। আর এমনিভাবে ভিন্ন এক জাতির প্রেক্ষাপটের গল্প হয়েও হার্মাসিস ও ক্লিওপেট্রা সমকালীন ও বিশ্বজনীন হয়ে ওঠে।

এই গল্পের ঘটনার সময় ও আবহকে তুলে ধরতে সেট বা মঞ্চ-পরিকল্পনায় ছিল প্রাচীন মিশরীয় মোটিফের নিখুঁত নকশা। একই সেট ও দ্রব্যাদি উলটে-পালটে ভিন্নরকম করে সাজিয়ে কখনো রাজভবনের বহির্দৃশ্য আবার কখনো অন্দরমহলের আভাস দিয়েছেন মঞ্চ পরিকল্পক। তেমনি দ্রব্যসামগ্রীগুলোও ছিল নান্দনিকতা ও রাজকীয়তার আভাসপূর্ণ। নিঃসন্দেহে সাকিল সিদ্ধার্থ জেনে-পড়ে-বুঝেই সুন্দরভাবে মঞ্চ পরিকল্পনা করেছেন। বিশেষ করে নিখুঁত করে বানানো মিশরীয় বাদ্যযন্ত্র হার্প [বীণা]-এর দিকে দৃষ্টি আটকেছে বারবার তেমনি শিল্পিত উপস্থাপন ছিল রাজসিংহাসন দুটোতেও।

অভিজ্ঞ হাতে পোশাকের পরিকল্পনা করেছেন তামান্না হক সিগমা। তিনি পোশাকের রং এমনভাবে নির্বাচন করেছেন যাতে সম্ভ্রান্ত ও রাজকীয়ভাব ফুটে উঠেছে ঠিকই কিন্তু চোখে তীক্ষ্ম হয়ে খোঁচা দেয় না কোনো রং বা নকশা ; ফলে চোখে একধরনের আরামবোধ হয়। অলংকার, পোশাকের কারুকাজে ছিল রুচিশীলতা ও পরিমিতি। প্রত্যেকের পোশাকে ছিল সঙ্গতি এবং বৈচিত্র্য। পোশাকে ভারসাম্য, সমানুপাত এমন ব্যাকরণগত অনুসরণে পোশাক-সজ্জা ঋদ্ধ হয়েছে। আর রূপসজ্জাকর শুভাশীষ দত্ত তন্ময় তার ব্রাশ-পাফ-এর লাইন ও কাটের মাধ্যমে চেহারায় মিশরীয় শার্পনেস ফুটিয়ে তুলেছেন সুচারুভাবে। 

মিশরীয় রানির ঠাট-বাট, চাল-চলন কী সাবলীলভাবে রপ্ত করেছেন ক্লিওপেট্রা চরিত্রের রূপদানকারী ফৌজিয়া করিম অনু! আর চারমিয়ন চরিত্রের অভিনেত্রী মেরিনা মিতুও চরিত্রকে ধারণ করেছেন দক্ষতার সাথে। হার্মাসিস চরিত্রে রূপদানকারী অভিনেতা এস আর সম্পদ বহুদূর যাবেন বলে আশা জেগেছে মনে। মঞ্চ-মাতানো এই তিন প্রধান অভিনেতার অভিনয় ও স্পষ্ট উচ্চারণ দর্শকের মনে আবেশ ছড়িয়ে দেয়। তেমনি বাকি চরিত্রগুলোর রূপদানকারী অভিনেতারাও ছিলেন যার যার চরিত্রানুযায়ী সাবলীল।

নাটকটি যত না ইতিহাস কেন্দ্রিক, তার চেয়ে মানুষের মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব, প্রেম-দায়িত্ববোধের সংঘাতই ছিল প্রধান। দূর সময় ও স্থানের গল্প হয়েও তা বর্তমান সময় এবং এই দেশের প্রাসঙ্গিকতা হারায়নি কখনো। তাই দর্শকদের মধ্যে যোগাযোগ ঘটানো গেছে সহজে। সব মিলিয়ে হার্মাসিস ক্লিওপেট্রা অনেকদিন পর মনে ভালো লাগার রং ছড়িয়ে দিল যেন।

তবুও অনেক দর্শকই থাকেন যারা মঞ্চে দেখতে চান দুই পক্ষের সশস্ত্র সঙ্ঘাত, বাদ্যযন্ত্রের ঝঙ্কার, নৃত্যের কারিশমা কিংবা সংগীতের দোলায়িত মূর্ছনা- তাদের মন, চোখ, কান এই প্রযোজনায় তৃপ্ত নাও হতে পারে। শুরুর দিকের ঘটনার বয়ানে অনেকেই মন-সংযোগ ঘটাতে ব্যর্থও হয়েছেন শুনেছি। নানা দর্শকের এরকম নানা মত নিয়েই একেকটি সুপ্রযোজনা এগিয়ে যেতে থাকে বহুদূর।

২০১৯-এ যাত্রা করা নতুন দল অনুস্বর-এর ছিল এটি নবম প্রযোজনা। অর্থাৎ মহামারির সময়কালকে নিয়েই মাত্র চার বছরে দলটি নয়টি প্রযোজনার সফল মঞ্চায়ন ঘটাতে সক্ষম হয়। অনুস্বরের এই প্রাণচঞ্চল কর্মোদ্দীপনা দলকে নিয়ে যাক আরো বহুদূর- এই শুভকামনা।


মঞ্চে—

ক্লিওপেট্রা : ফৌজিয়া করিম অনু

হার্মাসিস : এস আর সম্পদ

চারমিয়ন : মেরিনা মিতু

আমনেনহাট : মোহাম্মদ বারী

সেপা : প্রশান্ত হালদার

শিক্ষক : পিয়ার মোহাম্মদ

সেনাধ্যক্ষ পলাস : মাহফুজ সুমন

নোরাস : আরিফুর রহমান

রযামেসিস/সিংহ : নুরুজ্জামান সরকার

ডেলিয়াস : সাইফ সুমন

দেহরক্ষী : প্রেমাংশু মজুমদার

প্রহরী : সুদীপ্ত, তুষার, তাহসান

দাসী : দিলবার, রীমা, স্বর্ণা

কোরাস : সুদীপ্ত, তুষার, তাহসান, দিলবার, রীমা, স্বর্ণা


নেপথ্যে

রচনা : রাহমান চৌধুরী

নির্দেশনা : মোহাম্মদ বারী

মঞ্চ, দ্রব্য, পোস্টার পরিকল্পনা : সাকিল সিদ্ধার্থ

আলোক পরিকল্পনা : অম্লান বিশ্বাস

আলোক নিয়ন্ত্রণ : অনীক রহমান

সংগীত পরিকল্পনা : ইউসুফ হাসান অর্ক

পোশাক পরিকল্পনা : তামান্না হক সিগমা

পোশাক সহকারী : মুনিরা মাহজাবীন মিমো, উম্মে হানি, যজ্ঞোসীনি মৌ

কোরিওগ্রাফি : অনিকেত পাল বাবু

কোরিওগ্রাফি সহকারী : আবির সায়েম

রূপসজ্জা পরিকল্পনা : শুভাশীষ দত্ত তন্ময়

আবহ নিয়ন্ত্রণ : আবির সায়েম

প্রকাশনা : প্রশান্ত হালদার, অনীক রহমান

প্রযোজনা : অধিকর্তা : সাইফ সুমন


লেখা : ধীমতি শুচিস্মিতা