‘C’ ফর কফি, ‘C’ ফর ক্যাপুচিনো

19 Nov 2023, 01:28 PM অন্যান্য শেয়ার:
‘C’ ফর কফি, ‘C’ ফর ক্যাপুচিনো



‘হে অশান্তি, দাও ক্ষান্তি, সব ভ্রান্তি

দূর হোক আগে...

কফি ছাড়া শূন্য লাগে

ক্যাফে আমার প্রিয়া ক্যাফে।”

[কথা : গৌতম চট্টোপাধ্যায়। গানের দল : মহীনের ঘোড়াগুলি] 


কফি [Coffee], সিনেমা [cinema] আর সিগারেট [cigarette]- এই তিন ‘C’-এর মধ্যে কেমন একটা চনমনে ব্যাপার আছে, তাই না ! আর এই তিনের মেলবন্ধনও কিন্তু বেশ রোমান্টিক, নস্টালজিক।

মনে পড়ে সেই ’৯৭-’৯৮ খ্রিষ্টাব্দের কথা। আমরা তখন সদ্য কলেজের গণ্ডি পেরুনো তরুণ। পাবলিক লাইব্রেরিতে চলছে টানা শর্টফিল্ম ফেস্টিভ্যাল। ক্লাস শেষে তড়িঘড়ি ছুটলাম বিকেলের শো-এর আগাম টিকেট সংগ্রহ করতে। টিকেট কাউন্টারে ততক্ষণে সর্পিল দীর্ঘ সারি। ঠেলেঠুলে দুই বন্ধুর ২টি টিকেট জোগাড় করে অবশেষে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলা। কিন্তু লম্বা নিঃশ্বাস নিতেই নাসারন্ধ্রে এসে মগজকে উস্কে দিতে লাগল ব্লেন্ডেড কফির সুঘ্রাণ। ভ্রাম্যমাণ কফি-কার্টে করে বিক্রি হচ্ছে কফি- দাম মাত্র ২০ টাকা প্রতিকাপ। [তখন প্রতিকাপ চা পাওয়া যেত দু’টাকায়] আমরা দেখলাম অপেক্ষমাণ সিনেমাপ্রেমীদের অনেকের হাতেই তখন ধোঁয়া ওঠা কফির কাপ। আহা ! এত সুঘ্রাণ হতে পারে কফির ? অভুক্ত পেটে কফির গন্ধে আমাদের প্রেমাতাল অবস্থা। মনের চোখ দিয়ে পকেটের অবস্থা দেখে নিয়ে বুঝলাম- না, সম্ভব না। অগত্যা সম্বরণ করতে হলো কামনার মতো কফি আস্বাদনের বাসনাকেও। কিন্তু কফিকে সেদিন না-খেতে পাওয়ার সেই স্মৃতি কফির তীব্র গন্ধের মতো আজো মনে গেঁথে আছে। টুপ করে সন্ধ্যা নেমে আসা হেমন্তের সেই সন্ধ্যায় আমরা হেঁটে হেঁটে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে দিতে জীবনের প্রতি অন্যরকম এক মায়া বোধ করেছিলাম। এই যে বাড়িতে না জানিয়ে সিনেমা দেখা, লুকিয়ে সিগারেট খাওয়া, আর স্বাধ আর সাধ্যের দ্বন্দ্ব- পুরো ব্যাপারটাই ছিল ভীষণ রকম আনকোরা।


“সিনেমা যখন চোখে জ্বালা ধরায়

গরম কফির মজা জুড়িয়ে যায়

কবিতার বইগুলো ছুঁড়ে ফেলি

মনে হয় বাবা যদি বলতো আমায়

আয় খুকু আয় ...।”

[কথা : পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়। সুর : ভি বালসারা।

শিল্পী : হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ও শ্রাবন্তি মজুমদার]


এখন আমরা নিজেরা প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু সেই নস্টালজিয়া আমাদের ছেড়ে যায় না কখনো। তাই আজো আমার সেই বন্ধু, [এখন আমেরিকা প্রবাসী] দেশে ফেরার প্রতিটি বারেই আমার জন্য নিয়ে আসে বয়াম ভর্তি কফি- স্টারবাকস, লাভাৎজা বা ফোলজার্স- গুঁড়ো গুঁড়ো, দানাদার কিংবা আস্ত গোটাসহ। সারাবছর আমি সেই কফি দু-চামচ অতীত স্মৃতির সাথে মিশিয়ে নিংড়ে নিংড়ে পান করি। কফির তেতো-মিষ্টি স্বাদের সঙ্গে খুঁজে পাই আমার ছেলেবেলা, বন্ধুত্ব আর পাওয়া-না পাওয়ার নানা আনন্দ-বেদনার কথা।


“Should I kill myself, or have a cup of coffee?

But in the end, one needs more courage to live than to kill himself.”

    [Albert Camus, in A Happy Death]


“আমার কি আত্মহত্যা করা উচিত, নাকি এককাপ কফি খাওয়া উচিত ?”

কাম্যুর মতো আমারও মনে হয়, কফির যা দাম তা পুষিয়ে ওঠার চেয়ে তো মরণই সুলভ। কিন্তু তবু, অফিসের পর প্রিয় কফি শপে বসে কফির মগে চুমুক দিতে দিতে এই যে উপলব্ধি- আমি বেঁচে আছি ! আমি ভালো আছি ! নিত্যকার নানা কর্মব্যস্ততার পর এই যে নিজেকে আবিষ্কার করার ফুরসৎ পাওয়া গরম কফির পেয়ালা সামনে নিয়ে- এইসব অনুভূতির জন্যও বেঁচে থাকা যায়। পড়ন্ত বিকেলে কফি শপের এক কোণে বসে নিজেকে খুঁজে নেওয়ার এ সময়টা তাই সবচেয়ে নির্ঝঞ্ঝাট, একান্ত-আপন।

“মানুষ বলে টাকা দিয়ে সুখ কেনা যায় না। তারা মিথ্যা বলে। টাকা দিয়ে কফি কেনা যায় আর কফি আমাকে খুশি করে।” [সংগৃহীত]


‘মে আই অফার ইউ আ কাপ অব কফি ?’ এর সাবটেক্সট কিন্তু বলে অন্য কথা। শুনেছি কাউকে প্রেম প্রস্তাব করার প্রাথমিক ধাপ নাকি এটাই। প্রত্যুত্তরে মেয়েটি বা ছেলেটি যদি জবাব দেয়, নিশ্চয়ই ! তাতে বুঝে নিতে হবে তার আছে এতে সম্মতি। আর যদি বলে বসে- আমি খুবই খুশি হতাম যদি আপনার সঙ্গে কফি পান করতে পারতাম, কিন্তু দুঃখজনকভাবে আমি আজ খুব ব্যস্ত, আমাকে তাই এখনই উঠতে হচ্ছে।- এর মানে তো বুঝেই গেছেন ! তবে ভাবুন না, রাজি যদি সে হয়েই যায় আপনার কফির আমন্ত্রণে- কী এক সুখকর ব্যাপার তৈরি হয় তখন দেহ-মনে ! মগজের ডোপামিনকে আরো উস্কে দিতে টেবিলে ধোঁয়া ওঠা দু’কাপ ক্যাপুচিনো-এর চেয়ে নিষ্পাপ প্রেমময় আবহ আর কী-বা হতে পারে ? বানানো কথা নয় কিন্তু একদমই। এমনই এক প্রস্তাব পেয়ে বসলাম একবার ফেসবুকের মেসেঞ্জারে। যে পাঠালো, সে চেনা-জানা গ-ির হলেও কোনোদিনই কথা হয়নি সামনাসামনি। কফির প্রস্তাব ফিরিয়ে দেওয়ার মতো পাষাণ আমি কখনোই ছিলাম না। প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়ে কী দরকার কারো সারাজীবনের বিরাগভাজন হয়ে থাকার ? তো উপযুক্ত দিন-ক্ষণ-স্থান নির্বাচন করে আমরা বসলাম ছাদ খোলা এক কফি শপে। কফির স্বাদ নিতে নিতে চেনা-জানা হলো আরো বেশি করে। বন্ধুত্বও তৈরি হলো। এই অনাস্থার যুগে এই বা কম কী !

আমাদের ছেলেবেলায় শীত আসি আসি করলেই শীতের প্রস্তুতি হিসেবে আমি বাজার থেকে কিনে আনতাম পেট্রোলিয়াম জেলি, লাল কৌটার অলিভ অয়েল আর একটা নেসকেফে কফির ছোটো কাচের বয়াম। আমাদের কফি ছিল তখন এমনই- অর্থাৎ গরম তরল দুধের সঙ্গে কফি মিশিয়ে পান। তখন জানতাম কেবল দু’ধরনের কফির নাম এসপ্রেসো আর ব্ল্যাক। কিন্তু ঢাকায় ফ্রেঞ্চাইজ কফি শপগুলো আসতে শুরু করলে জানলাম কফির নতুন নতুন মিষ্টি কত কত নাম- এসপ্রেসো, মাকিয়াটো, অ্যামেরিকানো, ক্যাপুচিনো, লাতে। সেদিন গুলশানে প্রিয় এক কফিশপে ঢুকে কফি অর্ডার করে জেনে নিলাম কিছু তথ্যও। রোস্টেড বা ভাজা কফির ‘বিন’গুলোকে গ্রাইন্ডার বা গুঁড়ো করার মেশিনে গুঁড়ো করে নেওয়া হয় প্রথমে। তারপর ৯ গ্রাম কফির গুঁড়োকে কফি মেশিনে তীব্র চাপ প্রয়োগে বের করে আনা হয় ৩০ মিলি কফি নির্যাস। শুধু এই নির্যাসটি অনেকে খেতে পছন্দ করেন যাকে বলে এসপ্রেসো। এই এসপ্রেসোর সঙ্গে গরম দুধের ফেনা যোগের পরিমাণের উপর নির্ভর করে প্রধানত চার ধরনের কফি তৈরি হয়। এই কফি নির্যাস বা এসপ্রেসোর সঙ্গে উপরে দুধের অল্প একটু ক্রিম যোগে তৈরি হয় মাকিয়াটো। অ্যামেরিকানোতে দুধ মেশানো হয় না। আবার এসপ্রেসোর উপরে কাপ ভর্তি করে দুধের ফেনা ঢেলে দিলেই তৈরি হয়ে যায় ক্যাপুচিনো যা অনেকটাই স্ট্রং ফ্লেভারের হয়। আর লাতে হলো যারা হালকা স্বাদের কফি পছন্দ করেন। কেননা, সেখানে দুধের পরিমাণ অনেক বেশি থাকে। সঙ্গে আলাদা করে পছন্দমতো পরিমাণে চিনি মিশিয়ে পান করে থাকে কেউ কেউ। বলে রাখি আমার প্রিয় কিন্তু এসপ্রেসোর উপরে ফুলে ফেঁপে থাকা দুধের ক্রিম সমেত স্ট্রং স্বাদের ‘ক্যাপুচিনো’ কফি। আমার ধারণা ঢাকায় সবচেয়ে ভালো কফি বানায় নর্থেন্ড কফি রোস্টার কোম্পানি। জনপ্রিয়তার তালিকায় আরো আছে ব্রেড অ্যান্ড বিয়ন্ড, সেকেন্ড কাপ কফি, গ্লোরিয়া জিনস, অ্যারাবিকা, তাবাক, বাটলার্স চকোলেট ক্যাফে ইত্যাদি কফি শপ। গরমের দিনে কফিতে বরফ সহযোগে খুব চলে কোল্ড কফি। আর এই কোল্ড কফিটা সেরা বানায় খিলগাঁয়ের মামা অর্থাৎ মামা কফির ‘বারিস্তা’ অর্থাৎ সেই দোকানের কফি প্রস্তুতকারী মামা। আর বসুন্ধরার চায়ের আড্ডার কোল্ড কফি গরমের দিনে সত্যি প্রাণ জুড়ায়।


“আমি কখনই দুপুরের খাবারে কফি পান করি না। আমি এটাকে খুঁজি কারণ- এটি আমাকে বিকেলের জন্য জাগিয়ে রাখে।”

[রোনাল্ড রিগান]

শুনেছি অ্যামেরিকানরা চা পান করেন না, তাদের কাছে জনপ্রিয় পানীয় হচ্ছে কফি। সকালে কোনোমতে এককাপ কফি বানিয়ে বসে যান তারা ড্রাইভিং সিটে। সারারাস্তায় চুমুক দিতে দিতে ছুটে যান কর্মক্ষেত্রে। অড্রে হেপবার্নের সিনেমা ‘ব্রেকফাস্ট অ্যাট টিফানি’র প্রথম দৃশ্যেই দেখা যায় কফির কাপ হাতে অড্রে হেপবার্নকে। সাথে সিগারেটের একটা কেইস। নিজের ফ্ল্যাটে ঢুকছেন তিনি। কফি হাতে স্বাধীন নারীদের স্টাইল আইকন হিসেবে অড্রে হেপবার্ন পেয়েছিলেন দারুণ জনপ্রিয়তা। কফি যে অ্যামেরিকানদের জীবনের সঙ্গে গাঢ়ভাবে জড়িয়ে আছে তা হলিউডের সিনেমাগুলো দেখলেই বোঝা যায়। বিশ্বায়নের এই যুগে সেই সংস্কৃতি দোলা দিয়ে যায় ইদানীং আমাদের দেশেও। সন্ধ্যার পরে কফিশপগুলোতে ইয়ং জেনারেশনরে ভিড় আর বসার জায়গা না পাওয়ার অ্যাংজাইটি দেখেই এটা সহজে আন্দাজ করা যায়। কেননা, আজ কফি শুধু পছন্দের একটি পানীয়ই নয়, সামাজিক ও পারিবারিক যোগাযোগের কেন্দ্রবিন্দু, ব্যক্তিগত সময়ের সঙ্গী এবং একটি বৃহৎ শিল্প হয়েই গড়ে উঠছে আমাদের দেশেও। 


এসপ্রেসো না ক্যাপুচিনো ?

ক্যাপুচিনো বা কাপ্পুচিনো কফির তৈরি একধরনের পানীয় যা এসপ্রেসো, গরম দুধ এবং ফুটন্ত দুধের ফেনা দিয়ে তৈরি করা হয়। কাফে লাতে বা দুধ-কফির থেকে ক্যাপুচিনোতে ফুটন্ত বা ঘন দুধের পরিমাণ অনেক কম থাকে। ক্যাপুচিনো কফি সাধারণত চিনামাটির কাপে পরিবেশন করা হয়। ক্যাপুচিনোর উপরের দুধ-ফেনা অন্তরক হিসেবে কাজ করে এবং কফি বেশি সময় ধরে গরম রাখে। ক্যাপুচিনো শব্দটি ইতালীয় ভাষা থেকে এসেছে, যার অর্থ ‘ছোটো ঢাকনি’। ইতালির কাপ্পুচ্চো নামের একদল পাদ্রি সর্বদা মাথায় সাদা রঙের ঢাকনি বা হুড পরতেন। এই সাদৃশ্য থেকেই কাপ্পুচিনো কফির নাম এসেছে।

ক্যাপুচিনো তৈরিকারী এসপ্রেসো কফি মেশিনও ইতালিতেই প্রথম উদ্ভাবিত হয়। ইতালি থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে এটি পশ্চিমা বিশ্বের সর্বত্র ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ে। গত শতকের শেষের দিকে উত্তর আমেরিকাতে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের কফির দোকানের প্রসার ঘটলে সেখানে ক্যাপুচিনোর প্রচলন বেড়ে যায়।


নর্থ অ্যান্ড কফি রোস্টার্সে কফির

মূল্য তালিকা [টাকায়]

নাম ছোটো বড়ো

এসপ্রেসো ১৭৫ ২১০

মাকিয়াটো ২০৫ ২৫৫

আমেরিকানো ১৯০ ২৯০

ক্যাপ্পুচিনো ২৫৫ ৩৬৫

লাতে ২৫৫ ৩৬৫

তথ্যসূত্র : উইকিপিডিয়া


তাবাক কফিশপে কফির মূল্য তালিকা [টাকায়]

নাম ছোটো বড়ো

এসপ্রেসো ১৬৫ ২০০

মাকিয়াটো ১৯০ ২২০

আমেরিকানো ১৮৫

কাপ্পুচিনো ২৩০

লাতে ২৪০

তথ্যসূত্র : উইকিপিডিয়া

লেখা : ইভা আফরোজ খান