চা পানের ভালো-মন্দ

21 Nov 2023, 03:40 PM অভোগ শেয়ার:
চা পানের ভালো-মন্দ

বিশ্বে সর্বাধিক গ্রহণীয় পানীয়ের তালিকায় দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে চা। অর্থাৎ পানির পর মানুষ সবচেয়ে বেশি পান করে চা। জনপ্রিয় এই পানীয়ের রয়েছে নানামুখী স্বাস্থ্যগুণ। শুরুতে শুধু রং-চায়ের প্রচলন থাকলেও বর্তমানে চায়ে এসেছে নানারকম ভিন্নতা। এখন বিভিন্নভাবে চা পান করতে দেখা যাচ্ছে। চা-পানের ভালোমন্দ নিয়ে থাকছে বিস্তারিত...



চা পানের উপকারিতা

সারাবিশ্বের মানুষ কমবেশি চা পান করে থাকে। তার কারণ, একটি কুঁড়ি ও দুটি পাতার এই গুঁড়ো থেকে গরম জলে তৈরি চা পানের উপকারিতা কম নয়। চায়ের পাতায় ক্যাফিন থাকার কারণে চা পানে দেহে একটা চনমনে ভাব আসে, ক্লান্তি ও অবসাদ দূর হয়। চায়ের অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট দেহ ও ত্বক সজীব রাখে এবং হৃদরোগ ও ক্যান্সার থেকে মানুষকে দূরে রাখে। চা অ্যান্টি ম্যানেকিয়া হিসেবেও কাজ করে।

চা রক্ত জমাট বাঁধতে বাধা দেয়। মানসিক চাপ কমায়। মাথাব্যথা, শরীর ব্যথা, কোল্ড এলার্জি এবং জেগে থাকার জন্য যে সমস্ত ওষুধপত্র ব্যবহার হয়, সেগুলোতে ক্যাফিন থাকে। সুতরাং চা পান করলেও এ-ধরনের সমস্যা সমাধান করা সম্ভব। চায়ের পাতায় তিন শতাংশ ক্যাফিন থাকে। এটা সহজেই রক্তে মিশে যেতে পারে। যার জন্য চা পানের পরপরই এর ফলাফল অনুভব করা যায়।


চা পানের অপকারিতা

চা পানে খুব একটা অপকারিতা দেখা যায় না। তবে পটাশিয়াম বেশি থাকার কারণে যাদের রক্তে পটাশিয়ামের মাত্রা বেশি তাদের চা পান না করাই ভালো। এ ছাড়া রক্তস্বল্পতার জন্য চা প্রধান খাবারের পরপর না খাওয়াই ভালো। এতে লৌহ শোষণ ব্যাহত হয়। এছাড়া পটাশিয়ামের কারণে অত্যধিক চা পানের ফলে ঘন ঘন প্রস্রাব হয়ে দেহকে পানিশূন্য করে ফেলতে পারে।

দৈনিক কত কাপ চা পান করা উচিত ?

দিনে কত কাপ চা পান করা উচিত এটা নিয়ে অনেকেই দ্বিধায় ভোগেন। দিনে কয়বার এবং কতক্ষণ পরপর চা পান করা উচিত এটা নিয়ে কোনো সমীক্ষা না থাকলেও অতিরিক্ত চা পানে তেমন ক্ষতির ঝুঁকি নেই। জাপানের এক গবেষণায় দেখা যায়, দিনে ৩-৪ কাপ চা পান করার কারণে শতকরা ২৬ শতাংশ লোকের হৃদরোগ ও স্ট্রোকের ঝুঁকি কমে।


চা পানের বয়সমীমা

শিশুদের চা পানে অনেক সময়ই অনীহা প্রকাশ করতে দেখা যায়। সাধারণত বড়োদের মধ্যেই চায়ের অভ্যাস প্রচলিত বলে তারা মনে করেন এই পানীয়ে শুধু বড়োদেরই ঝোঁক বেশি। বড়োরাও শিশুদের চা পানে উৎসাহিত করেন না। কিন্তু আসল কথা হচ্ছে চা পানের কোনো বসয়সীমা নেই। এটা ঠিক গরম এই পানীয় খানিকটা সাবধানতার সঙ্গে পান করতে হয় বলে বড়োরা শিশু বা কম বয়সীদের হাতে চায়ের কাপ তুলে দিতে চান না। কিন্তু ছোট শিশু থেকে বয়োবৃদ্ধ পর্যন্ত সকলেই চা পান করতে পারেন। শিশু বা কম বয়সীদের চা পানে কোনো বাধা নেই। নেই কোনো ক্ষতির ঝুঁকিও। জেনে অবাক হতে পারেন, কোনো কোনো দেশে শিশুদের চা দেওয়া হয় ম্যালেরিয়া প্রতিরোধের জন্য। আবার কোন বয়সে গিয়ে চা পান বন্ধ করে দেওয়া উচিত ? এই প্রশ্ন মনে থাকলে জেনে নিন চা পানে নির্দিষ্ট করে কোনো বয়স বেঁধে দেওয়া নেই। একজন শিশু থেকে বৃদ্ধ সবাই চা পান করতে পারেন।


চায়ের পুষ্টিগুণ

বিশ্বজুড়ে আজ আমরা চায়ের যে জনপ্রিয়তা দেখি তা এমনি এমনি হয়নি। চা পানের পর এর নানামুখী গুণাগুণের কারণেই চায়ের আজ এই অবস্থান। অফিস থেকে শুরু করে আমাদের ঘর, পাঁচ তারকা হোটেল এমনকি রাস্তার পাশে গলির মোড়ে মোড়ে চায়ের অবস্থান। তার কারণ, চা পাতায় আছে ক্যারোটিন, রিবোফ্লাভিন, নায়াসিন, প্যানটোথেনিক অ্যাসিড ও এসকরবিক অ্যাসিড। তবে অবাক করা তথ্য হচ্ছে, চা তৈরির সময় উচ্চতাপে এ সমস্ত পুষ্টিগুণই নষ্ট হয়ে যায়। চায়ে যে পটাশিয়াম আছে, তা নষ্ট হয় না। বিশেষ করে গ্রিন-টি’র পটাশিয়াম পুরো মাত্রায়ই থাকে। এছাড়া অন্যান্য খাদ্য উপাদানগুলোও গ্রিন-টিতে কিছুটা থেকে যায়।

শুকনো চায়ের পাতায় থাকে ঠড়ষধঃরষব ড়রষ, ট্যালিন, ক্যাফিন, পলি ফেনল ও অত্যাবশ্যকীয় ফ্যাটি অ্যাসিড। চায়ের সুঘ্রাণ এ সমস্ত উপাদানের জন্যই হয়ে থাকে। ফুটন্ত পানিতে চা-পাতা দিলে অত্যাবশ্যকীয় ফ্যাটি অ্যাসিড বের হয়, ফলে চা সুবাসিত হয়।


নানা ধরনের চা

বাজারের চায়ের দোকানে তো বটেই এখন বাসাতেও গৃহিণীদের চা নিয়ে নানারকম এক্সপেরিমেন্ট করতে দেখা যায়। সকালে গ্রিন-টি তো দুপুরে রং-চা। আবার বিকেলে সিংগাড়া, সমুচার সঙ্গে দুধ-চা। কেউ কেউ লেবু, মাল্টার রস মিশিয়ে তৈরি করছেন লেবু আর মাল্টা চা। কেউ কেউ এগিয়ে গিয়ে তুলসি চা, মরিচ-চা, তেঁতুল-চা, গুড়ের চা তৈরি করছেন। আবার কেউ কেউ নানা রকমের মশলা দিয়ে তৈরি করছেন চা। তৈরি প্রক্রিয়া যদি সঠিক হয় তা হলে এসব পানে অসুবিধা নেই। সব চা-ই স্বাস্থ্যসম্মত।


তুলসি-চা

তুলসিপাতা দেহে অ্যান্টিক্যারোটিক হিসেবে কাজ করে। এর তেল বিশেষ করে এনটেরোকক্কাস ও সিউডোমোনাস ধরনের ব্যাকটেরিয়ার বৃদ্ধিতে বাধা প্রদান করে। সুতরাং তুলসি-চা জীবাণুর হাত থেকে দেহ রক্ষা করে।


গুড়ের চা

এটি স্বাদযুক্ত। গুড়ে আছে লৌহ, ক্যালসিয়াম ও শর্করা। রক্ত বৃদ্ধিতে গুড়ের চা কার্যকর।


লেবু চা

লেবু চা পটাশিয়ামের খুব ভালো উৎস। কারণ লেবুর পটাশিয়াম ও চায়ের পটাশিয়াম যুক্ত হয়ে এটি দ্বিগুণ কাজ করে থাকে। সুতরাং রক্তে পটাশিয়ামের ঘাটতি হলে এই চা খুবই কার্যকর। এ ছাড়া ত্বকের স্নিগ্ধ ভাব বজায় রাখতে লেবু-চা বেশ সাহায্য করে।

তেঁতুল-চা

যদিও এই চায়ের প্রচলন তেমন নেই। তথাপি বলা যায়, এই চা তেমন খারাপ কিছু নয়। তেঁতুলে আছে প্রচুর এমমিনো অ্যাসিড, পটাশিয়াম ও অক্সালিক অ্যাসিড। উচ্চরক্তচাপ কোলেস্টেরল ও ট্রাইগ্লাইসেরাইড কমাতে এর জুড়ি নেই।


মরিচ-চা

রক্ত সঞ্চালন ও হজমক্রিয়ায় সহায়ক হিসেবে কাজ করে মরিচের পুষ্টিগুণ। সুতরাং নতুন আবিষ্কার হলেও এই চা স্বাস্থ্যকর।


আদা-চা

আদা-চায়ের গুণাগুণ অনেক। সুস্বাস্থ্যের জন্য এই চা পান বেশ প্রয়োজনীয় বৈকি। সর্দি-কাশি অথবা যেকোনো ঠান্ডাজনিত অসুস্থতায় আদা-চা উপকারী। এ ছাড়া আদা হজমের সহায়ক ও বমিভাব দূর করতে সাহায্য করে।


দুধ-চিনি-চা

আমাদের দেশে পানের দিক দিয়ে এখন সম্ভবত সবচেয়ে বেশি এগিয়ে রয়েছে দুধ, চিনি ও চা এই তিনের মিশেলে তৈরি চা। যাকে আমরা দুধ-চা বলেই জানি। বিশেষত বিকেলের নাশতায় হালকা খাবারের পর এক কাপ গরম দুধের চা না হলে যেন আড্ডাটা আর জমেই না। দুধ-চিনি-চা খুব একটা খারাপ কিছু নয়। দুধ যত ঘন হবে, সেই চা তত উপাদেয় ও ক্যালোরি বহুল। তবে যাদের পেটের সমস্যা আছে এবং ওজন বেশি তাদের দুধ-চা পান না করাই ভালো।


মশলা-চা

মশলা-চা সাধারণত কালো চা পাতার সঙ্গে বিভিন্ন রকমের মশলা ও ভেষজের মিশ্রণ পানিতে ফুটিয়ে তৈরি করা হয়। মশলা-চা মূলত ভারতীয় উপমহাদেশের উদ্ভাবিত একটি সগন্ধযুক্ত পানীয়। এটি এখন বিশ্বব্যাপী সমাদৃত। মশলা-চা দারুচিনি, এলাচ, তেজপাতা, আদা, রসুন, লবঙ্গ এবং অন্যান্য আরো কিছু মশলা দিয়ে তৈরি করা হয়। এই চায়ে ব্যবহৃত সমস্ত মশলাই রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাসম্পন্ন। বিভিন্ন রকমের মশলা দিয়ে তৈরি এককাপ চা পান করে বহু উপকার পাওয়া যায়। চায়ে ব্যবহৃত মশলা পরিপাকে সাহায্য করে। এছাড়া মৌসুমি সর্দি-কাশি প্রতিরোধের এই চা অত্যন্ত কার্যকর। মশলা-চায়ে একসঙ্গে বিভিন্ন রকমের মশলা ব্যবহারের কারণে নানা রোগের সমস্যার সমাধান হতে পারে নিয়মিত সেবনে।

চা পান- খাবারের আগে নাকি পরে ?

এই সাধারণ জিজ্ঞাসা অনেকের থাকাটাই স্বাভাবিক। তবে, একেবারে খালিপেটে চা পান না করাই ভালো। এতে পাকস্থলি উত্তেজিত হয়ে পেপটিক আলসারসহ ক্ষুধামন্দা দেখা দিতে পারে। তবে, দুইবার খাবারের মধ্যবর্তী সময়ে চা পানে কোনো অসুবিধা নেই। যদি কারো রক্তস্বল্পতা থাকে, তাদের খাবারের এক ঘণ্টা পর চা পান করলে ভালো হয়।


বিছানায় চা

অনেকে সকালে ঘুম থেকে উঠেই এককাপ চা পান করেন। একে আমরা ‘বেড-টি’ বলে অভিহিত করি। ‘বেড-টি’ যেহেতু রাতের খাবারের ৮-১০ ঘণ্টা পর খালিপেটে পান করা হয়, সেজন্য এটি ভালো নয়। এ ছাড়া অনেকেই মুখ না ধুয়ে ‘বেড-টি’ পান করেন। এতে দাঁতের ফাঁকে ময়লা দাগ স্থায়ী হয়ে যায়।


চায়ে কম ঘুম

যেহেতু চা একটি উদ্দীপক পানীয়। সেহেতু চা পানে তৎক্ষণাৎ ঘুমের ভাব চলে যায়। এটি যে নিদ্রাহীনতার কারণ তা কিন্তু নয়। তবে অত্যধিক চা পান অবশ্যই অনিদ্রার সৃষ্টি করতে পারে। 

লেখা : তৃষা আক্তার, শহিদুল ইসলাম এমেল

মডেল : উর্বী স্বয়ম্প্রভা, অমিয়া অমানিতা