দুধ-চা না বনাম রং-চা!

21 Nov 2023, 03:46 PM অন্যান্য শেয়ার:
দুধ-চা না বনাম রং-চা!

বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় পানীয়ের জায়গা এখনো চায়ের দখলে। সকালে ঘুম থেকে উঠেই এককাপ গরম চা না হলে দিনই শুরু হয় না অনেক চা প্রেমীর। শরীর চাঙ্গা করতে, মানসিক বা কাজের চাপ থেকে মুক্তি পেতে চায়ের বিকল্প নেই। সারাবিশ্বের মানুষ প্রতিদিন ৩৭০ কোটি কাপ চা পান করেন। অতিথি আপ্যায়ন থেকে শুরু করে কাজের ফাঁকে কিংবা অবসর কাটাতে এককাপ চা না হলে ঠিক মানায় না। তবে, বিতর্ক থেকেই যায় যে কোন চা আসলে শরীরের জন্য সবচেয়ে উপকারী। দুধ-চা নাকি কালো-চা।

এই বিষয়টি নিয়ে রয়েছে বিস্তর গবেষণা। বিজ্ঞানীরা গবেষণায় লক্ষ্য করেছেন, যারা রং-চা মানে ব্ল্যাক-টি পান করেন তাদের মৃত্যুহার কম। বিশ্লেষণটি এভাবে হয়েছে যে, যারা দিনে ২-৩ কাপ চা পান করেন তাদের মৃত্যুর আশঙ্কা, যারা একদমই চা পান করেন না তাদের থেকে ৯-১৩ শতাংশ কম। এই গবেষণাটি মূলত যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব হেলথের একটি শাখা, ন্যাশনাল ক্যান্সার ইনস্টিটিউটের গবেষকদের দ্বারা পরিচালিত হয়েছে। গবেষকেরা দেখেছেন যে, যারা দিনে ২-৩ কাপ চা পান করেন তাদের মৃত্যুর আশঙ্কা, যারা একদমই চা পান করেন না তাদের থেকে ৯-১৩ শতাংশ কম। আবার অতিরিক্ত পরিমাণে চা পান করলে কার্ডিও ভাস্কুলার সিস্টেম ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। তার সাথে ইস্কেমিক হার্টেও সমস্যা এবং স্ট্রোকও হতে পারে। অ্যানালস অব ইন্টারনাল মেডিসিন জর্নালে প্রকাশিত এক সমীক্ষায় বলা হয়েছে যে, বিশ্বব্যাপী অসংখ্য মানুষ প্রতিদিনই নিয়মিত চা পান করেন। তবে, যারা মূলত ব্ল্যাক টি সেবন করেন তাদের মৃত্যুর ঝুঁকি তুলনামূলকভাবে কম।

আবার কোন ধরনের চা স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী এটা নিয়েও রয়েছে বিশেষজ্ঞদের মতামত। চিকিৎসকদের মতে, যারা নিয়মিত চা পান করেন, তারা যেন এটা মাথায় রাখেন যে, দুধ-চায়ের চেয়ে রং-চা শরীরের জন্য বেশি উপকারী।

জার্মানির বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক এক পরীক্ষায় ১৬ জন নারীকে একবার রং-চা, আরেকবার দুধ-চা পান করতে দেন। তারপর প্রতিবারই আলট্রাসাউন্ড পদ্ধতিতে তাদের রক্তনালির প্রসারণ মাপা হয়। এই পরীক্ষায় দেখা যায়, রং-চা রক্তনালির প্রসারণ ঘটায়। রক্তনালির প্রসারণ উচ্চরক্তচাপ ও হৃদরোগ নিয়ন্ত্রণে অত্যন্ত জরুরি। চায়ে থাকা ক্যাটেচিন রক্তনালির প্রসারণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। অন্যদিকে দুধ-চা রক্তনালির প্রসারণ ঘটাতে ব্যর্থ। কারণ, দুধের মধ্যে থাকে ক্যাসেইন নামের একটি পদার্থ, যা চায়ের মধ্যে থাকা ক্যাটেচিনকে বাধাগ্রস্ত করে। এতে চায়ে দুধ মেশালে চায়ের রক্তনালি প্রসারণের ক্ষমতা একবারেই চলে যায়। ইউএস ডিপার্টমেন্ট অব অ্যাগ্রিকালচারের গবেষকেরা পরীক্ষা করে দেখেন, চায়ের প্রভাবে কোষগুলো থেকে সাধারণের তুলনায় ১৫ গুণ বেশি ইনসুলিন নির্গত হয়। ডায়াবেটিস রোগ নিয়ন্ত্রণে ইনসুলিন নির্গত হওয়া জরুরি। কিন্তু চায়ে দুধ মেশালে এই ইনসুলিন নির্গমনের হার কমতে থাকে। চায়ে যদি ৫০ গ্রাম দুধ মেশানো হয়, তাহলে ইনসুলিনের নির্গমন ৯০ শতাংশ কমে যায়। রং-চা উচ্চরক্তচাপ, হৃদরোগ, ডায়াবেটিস ও ওজন নিয়ন্ত্রণে অত্যন্ত কার্যকর। কিন্তু দুধ-চা ততটা নয়।

কয়েক বছর আগে এক গবেষণায় দেখা গেছে, চায়ের মধ্যে ট্যানিন নামের একটি উপাদান খাদ্যনালির ক্যান্সারের কারণ হতে পারে। চুলায় চা-পাতা ঘণ্টার পর ঘণ্টা জ্বাল দিলে চায়ের ট্যানিন বেশি বের হয়। সাধারণ চায়ের দোকানে চা-পাতা ঘণ্টার পর ঘণ্টা জ্বাল দেওয়ার ফলে ট্যানিন বেশি বের হয়, এরকম চায়ের ক্ষেত্রে কিছু দুধ দরকার। এই দুধ চায়ের ট্যানিনকে আঁকড়ে ধরে এবং তাকে শরীরে মিশতে দেয় না। এ জন্য বেশি জ্বালের চায়ের ক্ষেত্রে দুধ মেশালে উপকার পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু দৈনন্দিন পানের জন্য জ্বাল না দিয়ে টি ব্যাগ দিয়ে রং-চা ভালো।

চা পানের ফলে জেনেটিক বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী মেটাবলিজম হারও প্রভাবিত হয়। এনআইএইচ-র সমীক্ষায় দেখা গেছে যে, চা তৈরির সময় প্রয়োজনমতো তাপমাত্রা বৃদ্ধি করা, চায়ের সাথে দুধ বা চিনি মেশানো ইত্যাদি মানবদেহে ক্যাফিন মেটাবলিজমের হারকে যথেষ্ট পরিমাণে প্রভাবিত করে। চায়ে আছে এপিগ্যালোক্যাটেচিন-গ্যালেট [ইজিসিজি] নামের একধরনের রাসায়নিক পদার্থ, যা খুব কার্যকর অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট। ভিটামিন সি-এর চেয়ে ১০০ গুণ বেশি ফলদায়ক। এটা কোষের ডিএনএকে এমনভাবে সুরক্ষা দেয়, যেন ক্যান্সারের প্রভাবে এর রূপান্তর না ঘটে। প্রতিদিন এক-দুই কাপ কালো-চা বা সবুজ-চা পান করলে ক্যান্সারের আশঙ্কা অনেকাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব।

চিকিৎসা বিজ্ঞান বলে ঘুমের অন্তত ১০ ঘণ্টা আগে থেকে ক্যাফেইন এড়িয়ে চলা উচিত। তাতে ভালো ঘুম হয়। যকৃৎ রাতে নিজের শারীরবৃত্তীয় কাজ করতে পারে। হজমশক্তিও ভালো থাকে। চা খাওয়া খারাপ নয়, কিন্তু তাতে দুধ-চিনি মিশিয়ে খেলে সবসময় তা স্বাস্থ্যের জন্য ভালো হয় না। সাধারণ কালো-চা অ্যান্টি অক্সিড্যান্টে ভরপুর। যা কোষের স্বাস্থ্য ভালো রাখে। 

গ্রন্থনা : ফাতেমা ইয়াসমিন