এককাপ চা

22 Nov 2023, 12:28 PM অভোগ শেয়ার:
এককাপ চা

কর্মব্যস্ত দিনের শুরু কিংবা শেষে এক কাপ চা হলেই জমে যায় বেশ ! চা এমনই এক পানীয় যার সুঘ্রাণ পেলেই সতেজ হয়ে ওঠে মন আর পান করার সঙ্গে সঙ্গে শরীর হয়ে ওঠে চাঙা। পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের পোশাক, খাবার, জীবনযাত্রার মধ্যে রয়েছে অনেক পার্থক্য। তবে চা নামক পানীয়টি অতিক্রম করেছে নানা দেশ, দেশের সংস্কৃতি। পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি মানুষের কাছেই চা অতি জনপ্রিয় পানীয়। চা ইতিহাসের আদ্যোপান্ত এবং চা-চাষের কথা থাকছে এই আয়োজনে...


‘চা’ বলতে সাধারণত সুগন্ধযুক্ত ও স্বাদবিশিষ্ট পানীয় বোঝানো হয়। চা মূলত ক্যামেলিয়া সিনেনসিন উদ্ভিদের পাতা, গর্ব ও মুকুলের কৃষিজাতপণ্য যা বিভিন্ন উপায়ে প্রস্তুত করা হয়। চায়ের নামকরণ করা হয় মূলত গ্রিকদেবী ‘থিয়া’র নামানুসারে।

চায়ের উৎপত্তি সম্পর্কে অনেক তর্কবিতর্ক রয়েছে। তবে চায়ের জন্মস্থান যে চীন সে সম্পর্কে যথেষ্ট প্রমাণাদি পাওয়া গেছে। চা-গাছের উৎপত্তিস্থান চীনের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে। চীনের চায়ের উৎপাদন কেন্দ্র হলো ইয়ুন্নান, গুইযৌ ও সিচুুয়ান প্রদেশে। এসব অঞ্চল থেকেই চা ছড়িয়ে পড়েছে সারাপৃথিবীতে।

চা-পাতার পানীয় হিসেবে ব্যবহার নিয়ে রয়েছে নানা রূপকথা। একটি রূপকথায় আছে- খ্রিষ্টপূর্ব ২৭৩৭ অব্দের একজন কৃষক নাকি পাহাড়ে ওষুধ সংগ্রহের সময় মাথায় ব্যথা পায়, ঠিক সেই সময়ই সামনে থাকা গাছটির কয়েকটি পাতা তিনি অভ্যাসবশত মুখে নিয়ে স্বাদ নেন। কারণ, যারা পাহাড়ে ওষুধ সংগ্রহ করতে যেতেন তাদের ঔষুধি গুণাগুণ বোঝার জন্য উদ্ভিদপত্রের স্বাদ নিতে হতো। তো এই গাছের পাতা মুখে দেওয়ার পর কৃষকের শরীরের অস্বস্তি বিলীন হয়ে গেল। প্রাচীনকালে চা ওষুধ হিসেবে ব্যবহার করা হতো।

চায়ের উৎপত্তি নিয়ে আরেকটি মজার রূপকথা প্রচলিত- খ্রিষ্টপূর্ব ২৭৩৭ অব্দের দিকে চীনের সম্রাট ছিলেন শেনাং। তিনি কোনো এক কারণে নিয়ম করেন যে, প্রজাদের অবশ্যই জল ফুটিয়ে পান করতে হবে। একদিন সম্রাটের জন্য যে জল ফোটানো হচ্ছিল তাতে কিছু পাতা উড়ে এসে পড়ে। এতে জলের রং পাল্টে যায়। আগ্রহের বশে সেই জল পান করে মুগ্ধ হয়ে যান সম্রাট শেনাং। এ-ধরনের আরো কিছু কাহিনি রয়েছে চায়ের উৎপত্তি নিয়ে। তবে এসবের ঐতিহাসিক কোনো সত্যতা পাওয়া যায়নি।

চা মূলত চীনা শব্দ। এর বৈজ্ঞানিক নাম ক্যাসেলিয়াসিনেনসিস। চা মৌসুমি অঞ্চলের পার্বত্য ও উচ্চভূমির ফসল। একপ্রকার চিরহরিৎ বৃক্ষের পাতা শুকিয়েই মূলত চা প্রস্তুত করা হয়। চা-গাছ হতে পাতা সংগ্রহ করতে যথেষ্ট নৈপুণ্য ও দক্ষতা অর্জন করতে হয়। একসঙ্গে তুলতে না পারলে চায়ের উৎকর্ষ ও আমেজ অনেকাংশেই নষ্ট হয়ে যায়। ১৬৫০ খ্রিষ্টাব্দে চীনে বাণিজ্যিকভাবে চায়ের উৎপাদন শুরু হয়। এর অনেক পর ষোড়শ শতাব্দীতে পর্তুগিজ পুরোহিত ও বণিকদের পরিচয় ঘটে চায়ের সঙ্গে। এরপর সপ্তদশ শতাব্দীতে ব্রিটেনে চা বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করে। ততদিনে অবশ্য ব্যবসার দিকে এক নম্বর স্থানে আছে চীনারা। আর তাদের ব্যবসায় ভাগ বসাতেই ভারতবর্ষে চা নিয়ে আসে ব্রিটিশরা। এখানে চায়ের রপ্তানির সঙ্গে উৎপাদনও শুরু করে তারা। তবে, স্বাদে গন্ধে যে চীনের চা-ই সেরা সে-কথা অস্বীকার করার উপায় নেই। মধ্য চীনের হুপেই প্রদেশের চা পৃথিবীর সেরা চা হিসেবে স্বীকৃত। কথিত আছে ১৮ শতকের ছিং রাজবংশের সম্রাট ছিয়ানলোং উ ইয়ুন শান গ্রামের এক কৃষকের বাড়িতে এসেছিলেন। তৃষ্ণার্ত হওয়ায় তিনি এক কৃষক নারীর কাছ থেকে চা-জল পান করেছিলেন। চা মুখে দিয়ে সম্রাটের মুখ সুগন্ধে ভরে ওঠে এবং তার মনটাও প্রশান্তিতে ভরে যায়। তিনি চেঁচিয়ে ওঠেন, এটিই ভালো চা। সে থেকেই এই গ্রামের চা বিশ্ববিখ্যাত হয়ে ওঠে। চা-পাতার রস প্রথমে ঔষধি পানীয় হিসেবে সেবন করা হতো।


চাষাবাদ পদ্ধতি

প্রচুর বৃষ্টিপাত হয় এমন পাহাড়ি বা উঁচু অথচ ঢালু জমি চা-চাষের উপযোগী ভূমি। পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা থাকলে উচ্চসমতল ভূমিতেও চায়ের আবাদ করা সম্ভব। হিউমাস সারযুক্ত এবং লৌহমিশ্রিত দো-আঁশ মাটি চা চাষের জন্য খুবই উপযোগী। উষ্ণ ও আর্দ্র জলবায়ু চা উৎপাদনের জন্য প্রয়োজন। চা-চাষের জন্য ১৭৫-২৫০ সেন্টিমিটার বৃষ্টিপাত আবশ্যক। এজন্য মৌসুমি ও নিরক্ষীয় অঞ্চলের দেশগুলোয় চা চাষের উৎপাদন বেশি হয়ে থাকে।

প্রথম অবস্থায় পাহাড়ের ঢালু জমি পরিষ্কার করা হয়। এর চারা পৃথক বীজতলায় তৈরি করা হয়। চারাগুলো যখন ২০ সেন্টিমিটার দীর্ঘ হয়, তখন সেগুলো চা-বাগানে সারিবদ্ধভাবে রোপণ করা হয়। সাধারণত দেড় মিটার পরপর চারাগুলো রোপণ করা হয়ে থাকে। এরপর গাছগুলো বৃদ্ধির জন্য যথামাত্রায় সার প্রয়োগ ও পানি সেচের ব্যবস্থা করতে হয়। এভাবে দুই থেকে তিন বছর পরিচর্যার পর পাতা সংগ্রহের উপযোগী করে তোলা হয়। কিন্তু গাছগুলো পাঁচ বছর না হওয়া পর্যন্ত যথাযথভাবে পরিপূর্ণতা লাভ করতে পারে না। একটি চা-গাছ গড়পড়তা ৩০ থেকে ৪০ বছর পর্যন্ত উৎপাদনের উপযোগী থাকে। তারপর পুনরায় নতুন গাছ রোপণ করতে হয়।

চা-গাছ রোপণ, আগাছা পরিষ্কার, সার প্রয়োগ করা, গাছ ছাঁটা, কচি পাতা চয়ন, চা-পাতা শুকানো, সেঁকা, চা-প্যাকিং ইত্যাদি বহুবিধ ধরনের কর্মকা-ে দক্ষ-অদক্ষ প্রচুর শ্রমিকের প্রয়োজন পড়ে। পাতা চয়নের কাজে দক্ষ মহিলা শ্রমিক নিয়োজিত থাকে। বিষয়টি বেশ ধৈর্যের বলে বাগান কর্তৃৃপক্ষ সাধারণত নারী শ্রমিকদেরই পাতা চয়নের জন্য নিয়োগ করে থাকে। এছাড়াও উচ্চফলনের স্বার্থে চা-বাগানে প্রচুর জৈব ও রাসায়নিক সারসহ প্রয়োজনীয় কীটনাশক প্রয়োগ করতে হয়। চা-গাছ হতে পাতা সংগ্রহ করতে ব্যক্তিকে যথেষ্ট নৈপুণ্য ও দক্ষতা অর্জন করতে হয়। কারণ দু’টি পাতা ও একটি কুঁড়ি একসঙ্গে তুলতে না পারলে চায়ের উৎকর্ষ ও আমেজ অনেকাংশেই নষ্ট হয়ে যায়।

ইংরেজদের হাত ধরে চা ভারতীয় উপমহাদেশে প্রবেশ করলেও বর্তমানে ভারত পৃথিবীর প্রধান চা উৎপাদনকারী দেশ। ভারতের আসামে প্রথম চা চাষ শুরু হলেও তা পরে ছড়িয়ে পড়ে দার্জিলিং, কেরালা ও বাংলায়। বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চল চা চাষের জন্য বিখ্যাত। কয়েক বছর ধরে উত্তরের জেলা পঞ্চগড়েও চায়ের আবাদ হচ্ছে। পৃথিবীর অধিকাংশ বৃষ্টিবহুল দেশে এখন চা উৎপন্ন হয়।

চা দেশভেদে, মানুষভেদে, রুচিভেদে ভিন্ন ভিন্ন প্রক্রিয়ায় পান করা হয়। তবে বিশ্বব্যাপী এর জনপ্রিয়তা সর্বজনীন। বাড়িতে মেহমান এলে চা ছাড়া তো এখন মেহমানদারি সম্পূর্ণই হয় না আমাদের দেশে। চা নিয়ে তো অনেক কিছু জানা হলো তবে এবার হয়ে যাক এককাপ চা ! হ

গ্রন্থনা : তৃষা আক্তার

মডেল : অমিয়া অমানিতা, উর্বী স্বয়ম্প্রভা