অভিশপ্ত বৃক্ষগুলোকে মানবরূপে ফিরিয়ে আনবে কে : ইকবাল খোরশেদ

29 Nov 2023, 12:58 PM অন্যান্য শেয়ার:
অভিশপ্ত বৃক্ষগুলোকে মানবরূপে ফিরিয়ে আনবে কে : ইকবাল খোরশেদ

রাইদাহ গালিবা কুইন। একটি নাম। না শুধু একটি নাম নয়, উজ্জ্বল এক প্রতিভা। কুইনের সাথে আমার কখনো দেখা হয়নি, হয়নি কোনো ভাববিনিময়। কিন্তু তাঁকে আমি চিনতাম। যে জননীর নাভিমূল ছিন্ন করে কুইন এই পৃথিবীর আলোতে প্রথম চোখ মেলেছিলেন, সেই জননীকে আমি চিনি ; চিনি কাজের সূত্রে, তাঁকে জানি তাঁর গল্প ও কবিতা পাঠের মাধ্যমে। জননীকে জানি তাই কুইনকে কিছুটা জানি, বাকিটা জানি তাঁর লেখালেখির সূত্রে। শ্যাম বর্ণের ‘ঝাঁকড়া চুলের বাবরি দোলানো’ উঁচা সুঠাম দেহের রাইদাহ গালিবা কুইনের ছিল আশ্চর্য এক প্রতিভা। মাত্র বারো বছর বয়স হয়েছিল তাঁর। এরও তিন বছর আগে নয় বছর বয়সে, ২০২০ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর প্রথম গল্পের বই প্রকাশ হয়েছিল। তারপর একে একে তাঁর আরও তিনটি গল্পের বই প্রকাশ হয়েছিল যথাক্রমে দশ, এগারো ও বারো বছর বয়স পূর্ণ হওয়ার আগেই।

কুইনের গল্পগুলো অনেকটা রূপকথার গল্পের আদলে লেখা। তবে, গল্পগুলোতে উঠে এসেছে মানুষের যাপিত জীবন ও সমাজদেহের চালচিত্র। ভেবে আশ্চর্য হতে হয়, ওইটুকুন একটি বালিকা তাঁর গল্পে তিনি প্রতিবাদ মুখর হয়েছেন ; মানবতার পক্ষে সোচ্চার হয়েছেন। তাঁর প্রতিবাদ অন্যায়ের বিরুদ্ধে, তাঁর প্রতিবাদ মানুষের সর্বগ্রাসী লোভের বিরুদ্ধে। তাঁর প্রতিবাদ অসাম্য ও ক্ষুধা-দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে। কুইনের লেখা প্রথম গল্প ‘পিটুর জাদু জুতা’র কথাই ধরা যাক : পিটু নিতান্ত গরীব। তার মা যা আয় করেন তা দিয়ে তাঁদের একবেলার অন্নের সংস্থান হয়। একদিন পিটুর জুতা ছিঁড়ে গেলে সে জুতা কেনার জন্য মায়ের কাছে টাকা চায়, কিন্তু মায়ের কাছে তো টাকা নেই। পিটুর একটি পোষা তোতাপাখি ছিল। মায়ে-ছেলে যুক্তি করে সিদ্ধান্ত নেয় পাখিটি বিক্রি করে দেবে। বিক্রিলব্ধ টাকা দিয়ে পিটু জুতা কিনবে। সিদ্ধান্তমতো পিটু তার পোষা পাখিটি এক বৃদ্ধার কাছে বিক্রি করে দেয় একজোড়া জাদুর জুতার বদলে। সেই জুতা পায়ে দিয়ে পিটু যা চায়, তা-ই পায়। পিটু দেখলো এতো ভারি মজা ! যা চাওয়া যায়, তা-ই পাওয়া যায়। পেতে পেতে একসময় দরিদ্র পিটু ধনী হয়ে ওঠে। ব্যস্, এখন অহংকারে পিটুর মাটিতে পা পড়ে না। তবে, জাদুর জুতার সহ্য হয় না পিটুর এমন অহংকার। সে পিটুকে আর কিছু দিতে অসম্মতি জানায়। পিটুও বুঝতে পারে তার ভুল। পিটুর ভুল ভাঙলেও জাদুর জুতা কিন্তু আর পিটুর ইচ্ছেদাস হয়ে থাকে না। কেননা, তাকে তো অন্য অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াতে হবে। গল্প বলার মেধাবী কৌশলে কুইন জাদু জুতার ভেতরে মানবিক গুণাবলি আরোপ করে জুতাকেও একটি চরিত্র করে তুলেছেন। কুইন তাঁর সৃষ্ট ‘পিটু’ আর ‘জাদু জুতা’ চরিত্র দুটির মধ্যদিয়ে মানুষের মনের ভেতরের আলো-আঁধারির রূপকে চিত্রায়িত করেছেন। পিটু একজন লোভী মানুষের প্রতিভূ আর জাদু জুতা একদিকে যেমন প্রতিবাদী, অন্যদিকে তেমন মানবতাবাদী। সে পিটুর লোভী ও অহংকারী চরিত্রের প্রতিবাদ করেছে। আবার সে পিটুর দারিদ্র্য দূর করে অন্য জনের দারিদ্র্য দূর করতে প্রয়াসী হয়েছে। এমনিভাবে রাইদা গালিবাহ কুইন তার সব গল্পেই সমাজের নানারকম অসংগতি ও মানব মনের শুভ-অশুভের দ্বান্দ্বিকরূপ তুলে ধরেছেন।

কুইনের প্রকাশিত শেষ বইতে তিনি এক অভিশপ্ত ভয়ংকর গাছের আর এক নির্লোভ সাহসী কাঠুরের চরিত্র অংকন করেছেন। ভয়ংকর গাছ মূলত একজন যুবরাজ। তার শত্রু এক দৈত্য তাকে অভিশাপ দিয়ে ভয়ংকর গাছে পরিণত করেছে। গরীব নির্লোভ এক কাঠুরে বহু বাধার পথ অতিক্রম করে নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দৈত্যের ঘেরাটোপ থেকে জল এনে গাছের গায়ে ছিটিয়ে তাকে মানবরূপ ফিরিয়ে দিয়েছে। বিনিময়ে সে কোনো কিছুই দাবি করেনি। মানবরূপ পাওয়ার আগে অভিশপ্ত গাছ তার পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া যেকোনো মানুষকে পশুতে রূপান্তর করে দিত।

গত বছর কুইনের ডেঙ্গু জ্বর হয়েছিল। জ্বর সারানোর জন্য তিনি হাসপাতালে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়েছিলেন। লোভী এক চিকিৎসকের সীমাহীন লোভের শিকার হয়েছেন কুইন। ত্রুটিপূর্ণ চিকিৎসা, অবহেলা আর সীমাহীন লোভের কারণে বড়ো অকালে প্রতিভাধর এক শিশুগল্পকার পাড়ি জমালেন সেখানে, যেখানে প্রতিদিন বাড়ছে মানুষের ভিড়। অভিশপ্ত গাছের মতোই ওই চিকিৎসকও যেন এক অভিশপ্ত মানুষ। তার লোভের শিকার হয়ে জীবন দিতে হয়েছে বারো বছরের নিষ্পাপ শিশু রাইদাহ গালিবা কুইনকে। দেশ হারিয়েছি এক ভবিষ্যৎ গল্পকারকে।

যে রত্নগর্ভা জননী এমন সন্তানের জন্ম দিয়েছেন তিনি জানেন সন্তান হারানোর যন্ত্রণা কতটা গভীর, কতটা সহ্যক্ষমতা থাকলে একজন মা এমন বেদনাকে সঙ্গী করে দিন যাপন করতে পারেন। সত্যিই কি পারেন ? না কি পারার একটা প্রাণান্ত অভিনয় করে চলেন...  

এইসব অভিশপ্ত বৃক্ষগুলোকে মানবরূপে ফিরিয়ে আনবে কে ? কবে আসবেন একজন তেমন কাঠুরে ? এদেশ, দেশের চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যব্যবস্থা কি কুইনের পরিবারের, জাতির এই অপূরণীয় ক্ষতির মূল্য দিতে পারবে ? কোনো কিছুর বিনিময়ে কি মোছানো যাবে কুইনের মায়ের চোখের জল ?