রিকশা : লিভিং ট্রাডিশন

12 Dec 2023, 03:06 PM অন্যান্য শেয়ার:
রিকশা : লিভিং ট্রাডিশন

আনন্দভুবন-এর যাত্রা শুরু হয়েছিল ১৯৯৬ খ্রিষ্টাব্দে। সেই প্রথম দিন থেকেই আনন্দভুবন পাঠকপ্রিয়তার শীর্ষে অবস্থান করেছিল, এখনো করছে। মাঝে গড়িয়েছে ২৭টি বছর। আনন্দভুবন ২৮ বছর অতিক্রম করছে। দীর্ঘ এই যাত্রাপথে তাকে অতিক্রম করতে হয়েছে অনেক চড়াই-উৎরাই। এসেছে অনেক সহযোগী ও প্রতিযোগী। এখন পাল্লা দিতে হচ্ছে, পত্রপত্রিকা তো বটেই, আরো আছে ফেসবুক ও ইউটিউব। এতসবের মাঝেও আনন্দভুবনের অর্জনও কিন্তু কম নয়। নানা সময়ে কেমন ছিল আনন্দভুবনের-এর ফিচার, প্রতিবেদনগুলো ? ‘ফিরে দেখা’ পাঠককে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে অতীতে। ১৯৯৮ খ্রিষ্টাব্দের ১ জানুয়ারি [ঈদসংখ্যা] সংখ্যায় প্রচ্ছদ প্রতিবেদন করা হয় ‘রিকশাচিত্র’ বিষয়ে। প্রতিবেদনের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ ছিল চিত্রশিল্পী শিশির ভট্টাচার্যের লেখা নিবন্ধ। ‘রিকশা : লিভিং টাডিশন’ শিরোনামের নিবন্ধটি এবারের ‘ফিরে দেখা’ বিভাগে প্রকাশ করা হলো...

২য় বর্ষ, ১৭ সংখ্যা, ১৬ জানুয়ারি ১৯৯৮

রিকশা : লিভিং ট্রাডিশন


শিশির ভট্টাচার্য


রিকশা পেইন্টিং বিষয়ে কিছু লেখায় নিজস্ব অভিজ্ঞতা দিয়েই শুরু করছি যেহেতু তা খুবই প্রাসঙ্গিক। ঘটনাটা অনেক আগের। আমিও একবার একটা রিকশা পেইন্টিং করেছিলাম। মালিক বলেছিলেন আমার ইচ্ছে মতো সাজাতে। তাই আমার পছন্দমতো নানারকম জীব-জন্তু পাখি ইত্যাদি দিয়ে মোটামুটি ভরিয়ে দিলাম রিকশাটাকে। এর মধ্যে রিকশার পেছনে দুদিকে দুটো গোল চাকতির মতো তাতে আঁকলাম দুটো বানরের ছবি। মালিক যেহেতু একটু শিক্ষিত সে তো মহাখুশি। একদম আলাদা ধরনের... দেখলেই চেনা যাবে কার রিকশা। চালকও খুব উৎফুল্ল ; কখন এটা নিয়ে রাস্তায় নামবে। রিকশা শহরে বের হলো ভাড়া খাটার জন্য... কিন্তু ঐ রিকশায় কেউ চড়ে না। কারণ... বানরের ছবি। কুসংস্কার কি না জানি না, যাত্রার সময় বানরের মুখ দেখলে নাকি যাত্রা খারাপ হয়, তাই কেউই উঠছে না রিকশায়। দুপুর নাগাদ রিকশা আমার কাছে এলো, চালক বলল, কী আঁকাইছেন ? কেউ তো রিকশায় চড়ে না। রিকশাওয়ালাই বলল, এই বানর সরাইয়া এইখানে ফুল-টুল বা পাখি-টাখির কিছু একটা আঁইক্কা দ্যান। আমি হতবাক এবং তাই করলাম। রিকশাও তখন শহরময় ঘুরে বেড়াতে লাগল কাছে দূরে সর্বত্র।

ঘটনাটা মনে হয় ’৭৫ সালের... এখন ’৯৮ শুরু হয়েছে। এই ২০-২২ বছরে কত জায়গায় কতরকম কারুকাজ করা এবং চিত্র-শোভিত রিকশা দেখলাম যদিও অধিকাংশ ঢাকা শহরে। কিন্তু আশ্চর্য, সত্যি বানরের ছবি রিকশায় দেখেছি বলে মনে পড়ে না। আর একটা ঘটনা বলি... এরশাদ সরকারের সময় আটের দশকের মাঝামাঝিই হবে, জানি না কী কারণে সিটি করপোরেশন থেকে নিয়ম হলো রিকশার পেছনে বডিতে নম্বর বড়ো করে লিখতে হবে। যাতে সহজেই নম্বর পড়া যায় সেজন্য কালোর ওপর সাদা দিয়ে লিখতে হবে। বডিতে অন্য কোনো ছবিটবি বিশেষ করে সিনেমার নায়ক-নায়িকা সংবলিত চিত্র আঁকা যাবে না, অশ্লীল কিছু তো প্রশ্নই ওঠে না। রাতারাতি পাল্টে গেল রিকশার চেহারা- নইলে পুলিশ ধরছে-ফাইন করছে। যে যেমনভাবে পারে নিজেরাই থ্যাবড়ানো কালোর ওপর চুন দিয়ে লেখার মতো লিখে নিলো। শাড়ি পরিহিতা মহিলাদের পেটে আলকাতরা লাগিয়ে দেবার মতো কুৎসিত এবং বীভৎস চেহারা হলো রিকশা নকশার। রিকশায় চড়ে সামনের রিকশায় যখনই ওই অবস্থা দেখেছি মনে হয়েছিল, যে এই আইন করেছে তার মুখে ওই কালো রং লেপটে দিয়ে থু থু দিয়ে আসি। দিন যায়.... দেখি ওই থ্যাবড়ানো কালো রং এক একটা আকার পাচ্ছে, কোনোটা প্রজাপতি, কোনোটা পাখি বা ফুল কোনোটা বা হার্টের সেপ এবং তারই মধ্যে সুন্দর করে সাদা রং দিয়ে নম্বর লেখা। মনে মনে ভাবলাম, কী সুন্দর নীরব বিপ্লব ঘটে যাচ্ছে। কিন্তু অনেকেই এমন কি সরকারও টের পাচ্ছে না। ...এই অবস্থা বেশি দিন টেকেনি। রিকশা পেইন্টাররা আবার তাদের স্বাধীনতায় কাজ করে যাচ্ছে। ফাইন আর্টের ওপর প্রথাগত শিক্ষা শেষে এখন মনে হয়... ঘাটনা দুটো যদিও রিকশা পেইন্টিং সংক্রান্ত কিন্তু একজন শিল্পী ও শিল্পকলার জন্য ওই দুটো ঘটনাই অনেক গুরুত্ব বহন করে। এক, শিল্পীর স্বাধীনতা মানেই ইচ্ছে মতো স্বেচ্ছাচারিতা না এবং দুই শিল্পীর স্বাধীন সত্তা এবং সুকুমার বৃত্তিকে কোনো শাসকই দাবিয়ে রাখতে পারে না। রিকশা পেইটিং নিয়ে মূল্যায়ন বা সমালোচনা জাতীয় কিছু বলা সত্যিই খুব কঠিন। কেননা, রিকশা পেইন্টিং আশ্চর্যরকম শক্তিশালী এবং প্রভাবশালী একটা চরিত্র নিয়ে এত ব্যাপকভাবে সারাদেশজুড়ে প্রতিষ্ঠিত তা ভাবতেই অবাক লাগে। শিল্পীর যা যা বৈশিষ্ট্য থাকা প্রয়োজন একজন রিকশা পেইন্টার বা ওস্তাদের সেগুলো তো আছেই বরং অনেক ক্ষেত্রে কুলীন শিক্ষিত শিল্পীর কাছে ঈর্ষণীয় এমন গুণাবলীও রয়েছে। কিন্তু সমাজে বা দেশে একজন প্রতিষ্ঠিত শিল্পী হিসেবে রিকশা পেইন্টার-এর নামও আমরা জানি না বা জানার প্রয়োজন হয় না।

কিছু কিছু ব্যাপার উল্লেখ না করলেই নয়, যেমন- রিকশা পেইন্টিং-এর উজ্জ্বল রং এবং রেখা। এ দুটোতেই সজ্জিত হয়ে ওঠে নানা ইমেজ, সঠিক প্রতিকৃতি [পোট্রেট] প্রকৃতি- ফুল-লতাপাতা, পাখি, নানারকম লেখা, বাণী, ধর্মীয় শব্দ ইত্যাদি কত কী! রং ব্যবহারে অত্যন্ত সাহসী এবং দৃঢ়। হয়ত আকাশ লাল, জমিন নীল বা হলুদ, চেহারার রং একদিকে সবুজ অন্যদিকে লাল গোলাপী বা ম্যাজেন্টা, সামঞ্জস্য রাখার জন্য সেভাবেই রঙের বিন্যাস। [এগুলো তাদের কে শিখিয়েছে ? চিত্রকলার ইতিহাসে যাকে আমরা ফরইজম বলি]। এগুলো কেন্দ্র করে রেখার ব্যবহার কী আশ্চর্য স্বাচ্ছন্দ, কোনো জড়তা নেই, তুলি দিয়ে লাইন দিতে কখনো সাদা লাইন দিয়ে বের করে দেওয়া কখনো কোনো ডার্ক রং। লাইন ওয়ার্কে সমৃদ্ধ কোনো রিকশা পেইন্টিং যদি পিকাসোর লাইন ওয়ার্ক এবং কামরুল হাসানের লাইন ওয়ার্কের পাশে রেখে দেখা যায় খুব কি বেমানান লাগবে ?

নায়ক-নায়িকার ছবি অহরহ জনপ্রিয় বিষয়, খুব কম রিকশা পেইন্টিং-এ সিনেমার ব্যানারের মতো নিখুঁত আঁকা থাকে। অধিকাংশতেই খুবই সহজভাবে আঁকা, ভাবতে অবাক লাগে এত সহজভাবে শিল্পীর নিজের মতো করে এঁকেও প্রত্যেকের চেহারা চেনা যায় তাদের চেহারার বৈশিষ্ট্যে। পোর্টেটের সিমপ্লিফিকেশন করে প্রকাশবাদী অনেক বিখ্যাত শিল্পীর চিত্র রয়েছে যাদের সম্পর্কে কেউ যদি শিল্পী হতে চায় তবে পড়তে হয়। সেই শিল্পীর কাজের পাশে যদি রিকশায় আঁকা নায়ক-নায়িকার চিত্রগুলো রাখা যায়- কেমন লাগবে ? এরপরও আছে নানারকম ফ্যান্টাসি, সুররিয়ালিস্টিক জাতীয় চিত্র, সমাজ বিবর্তনের, রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের নানা রকম প্রতীকী উপস্থাপন এবং সর্বোপরি পুরো রিকশায় ফর্মটাকে আকর্ষণীয় করে সাজানোর ক্ষমতা।

রিকশা পেইন্টিং টিকে থাক তাদেরই মতো করে, রিকশা পেইন্টারও যেন স্বাধীনভাবে কাজ করে যেতে পারে, এটাই একমাত্র উল্লেখযোগ্য লিভিং ট্রাডিশন সব সময়ই যেনÑ লিভিং ট্রাডিশন লিভিং থাকে।


আনন্দভুবন আজ যা ভাবে তা  অন্যেরা ভাবে আগামীকাল 

ঢাকা শহরের রিকশা ও রিকশাচিত্র জাতিসংঙ্ঘের শিক্ষা ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কোর বিমূর্ত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে।

আফ্রিকার দেশ বতসোয়ানার কাসানে শহরে ‘ইনট্যানজিবল কালচারাল হেরিটেজ’ সংরক্ষণবিষয়ক চলতি ২০২৩ কনভেনশনের আন্তঃরাষ্ট্রীয় পরিষদের সভায় এই বৈশ্বিক স্বীকৃতি মেলে।

জামদানি বয়ন শিল্প, শীতল পাটি বয়ন শিল্প, বাউল গান ও মঙ্গল শোভাযাত্রার পর বাংলাদেশের পঞ্চম ‘বিমূর্ত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য’ হিসেবে এ স্বীকৃতি পেল ‘ঢাকার রিকশা ও রিকশা পেইন্টিং’।

সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘এর ফলে গত আট দশক ধরে চলমান রিকশা চিত্রকর্ম একটি বৈশ্বিক ঐতিহ্য হিসেবে ইউনেস্কোর স্বীকৃতি লাভ করল।’

উল্লেখ্য যে : আজ থেকে দুই যুগেরও বেশি সময় পূর্বে ১৯৯৮ খ্রিষ্টাব্দে আনন্দভুবন রিকশা আর রিকশাচিত্র নিয়ে একটি প্রচ্ছদ ও প্রচ্ছদ রচনা প্রকাশ করে। এতে বিভিন্ন ধরনের প্রতিবেদনের পাশাপাশি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের অধ্যাপক চিত্রশিল্পী শিশির ভট্টাচার্য রিকশাচিত্র নিয়ে ‘রিকশা : লিভিং ট্রাডিশন’ শিরোনামে একটি নিবন্ধ রচনা করেন, আজ প্রায় ২৫ বছর পর ইউনেস্কোর বিমূর্ত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় স্থান করে নিল এই রিকশা ও রিকশাচিত্র। 

এতে আবারও প্রমাণ হলো, ‘আনন্দভুবন আজ যা ভাবে তা অন্যেরা ভাবে আগামীকাল’।