ইউরোপের ১৫০ দিন -সৈয়দা তাসলিমা আক্তার

19 Dec 2023, 01:19 PM ভ্রমন শেয়ার:
ইউরোপের ১৫০ দিন  -সৈয়দা তাসলিমা আক্তার

[পূর্ব প্রকাশিতের পর]


হোম এক্সাম যে এত জটিল তা আগে জানা ছিল না, বই-খাতা, নোট, ক্লাস লেকচার, রেফারেন্স সবই আছে, তবু যেন কী জানি কী নেই। এত নেই, নেই নিয়েই পরীক্ষা শেষ করলাম। শেষ তো করতেই হতো, কেননা, সময়সীমা যে বেঁধে দেওয়া। তিনদিনের পরীক্ষায় তিনটি প্রশ্নের উত্তর দিতে গলদঘর্ম অবস্থা, উত্তরপত্র সাবমিট করে মনে হলো যেন এক বিশাল যুদ্ধ শেষ করলাম। সেদিন বিকেলটা তাই ঘরে না বসে থেকে আমি আর ফারজানা বেরিয়ে পরলাম, যুদ্ধ শেষে স্বস্তি অবস্থা উদ্যাপন, যুদ্ধ জয় বলতে পারছি না। কারণ, ‘বৃক্ষ তোমার নাম কী ?- ফলে পরিচয়’ সেই ফল পেতে আমাদের কিছুদিন তো অপেক্ষা করতেই হবে। যাই হোক, ফল কী হবে না ভেবে এখনকার সময়টাকে উপভোগ করাই শ্রেয়। বাইরে যথেষ্ট ঠান্ডা সাথে যথারীতি ঝিরঝির বৃষ্টি, কিন্তু আজ আর বৃষ্টিকে তোয়াক্কা করলাম না, আগেই বলেছি তিনদিনের ঘরবন্দি সময়, সাথে পরীক্ষার প্যারা এরপর একটু খোলা আকাশের নিচে কিছুটা সময় বিচরণ আবশ্যকীয় হয়ে দাঁড়ালো। সঙ্গে ছাতা থাকা সত্ত্বেও কিছুটা ভিজলাম তাও হাঁটছি, ভালো লাগছে। জায়গাটার নির্দিষ্ট কোনো নাম নেই ফ্যান্টাপে আমাদের স্টুডেন্ট হাউজের পাশেই একটি ওল্ডহোম তার ঠিক পাশ দিয়েই একটি পাহাড়ি আঁকাবাঁকা পথ, পথটি ঘুরে আবার মূল সড়কে যেখানে বাস স্টপেজ রয়েছে সেখানে গিয়ে মিলেছে। নির্জন পাহাড়ি পথ কোথাও কোনো মোড়ে হয়ত হঠাৎ দু-একটি বাড়ি চোখে পড়ে। তবে, মানুষজন বলতে আমি আর ফারজানা, আর হঠাৎ দেখা এক আগন্তুক যিনি কোনো এক পথের ঠিকানা খুঁজছেন। আমাদের কাছে হদিস চাইলেন, যদিও বারগেনে আমরা প্রায় চারমাস অতিক্রম করে ফেলেছি তবু ফ্যান্টপটাই পুরো চেনা হয়ে উঠলো না। না আমরা আগন্তুককে কোনো সাহায্য করতে পারিনি।

ইউরোপে শীতের বিকেল যেন হাওয়াই মিঠাই এর মতো ছুঁতে না ছুঁতেই মিলিয়ে যায়। আমরা তাই সন্ধ্যা হতেই ফেরার পথ ধরলাম, ততক্ষণে বৃষ্টির ছাট বেড়ে চলেছে, পুরোপুরি কাকভেজা না হলেও প্রায় ভিজে ভিজেই ফেরা। তবে ফেরার পথে আবারও থমকালাম, ফ্যান্টপের লাগোয়া ট্রেন স্টপেজ (লাইট ট্রেন বা বিবান) তার ঠিক পরেই একটি নার্সারি, বেশ সুন্দর সাজানো গোছানো, প্রায়ই ভাবি নার্সারিটা ঘুরে আসবো, এই যাবো যাবো করেই চার মাস কাটিয়ে দিলাম, আজ মনে হলো একটু ঘুরেই যাই, ফারজানারও আগ্রহের কমতি ছিল না। আমি আবার বেশ গাছ পাগল, গাছ দেখলেই নিজের করে নিতে ইচ্ছে করে, তাই সাত-পাঁচ না ভেবে নার্সারিতে ঢুকে পরলাম। ঢুকেই যেটা মনে হলো এটা কি গাছ বিক্রয় কেন্দ্র না ভুল করে কারো ড্রয়িংরুমে ঢুকে পড়লাম ! এত সুন্দর ডেকোরেশন মনেই হয় না এখানে কোনো বিক্রয় বাণিজ্য চলে, অত শান্ত-সুনিবিড় পরিবেশ মনের অজান্তেই এখানে দু’দ- বসে জিরিয়ে নিতে ইচ্ছে জাগবে, সাথে একটু চা বা কফি হলে তো পোয়া-বারো। ছিমছাম ছোট্ট একটা বাড়ি, তিনটে রুম, একটিতে ইন্ডোর প্লান্ট সাজিয়ে রাখা, একটিতে রয়েছে নানান ধরনের শো-পিস, যেগুলোর সাথে আবার গাছের সুগভীর সম্পর্ক রয়েছে, অর্থাৎ গাছ ডেকোরেশনে কাজে লাগে, আর অবধারিতভাবে রয়েছে বাহারি মোমের শো-পিস। আসলে নরওয়েতে এসে আমার মোমের শো-পিসের সাথে পরিচয়, আর এদের বাড়াবাড়িরকমের মোম প্রীতি দেখে আমি রীতিমতো বিস্মিত। নরওয়েতে যেকোনো বাড়িতে, যেকোনো উৎসবে মোম একটি অত্যাবশ্যকীয় অনুষঙ্গ। মোমের যে এত বাহরি রং এবং ডিজাাইন আছে তা-ও জানলাম এখানে এসে। উপহার হিসেবেও এখানে মোম খুব জনপ্রিয়। অন্য যে রুমটি ছিল সেটি মূলত ছিল ওয়ার্কশপ আর বীজের ভা-ার। নার্সারিটির ব্যাকইয়ার্ডেও রয়েছে প্রচুর গাছ, যার মধ্যে অর্কিডই বেশি। আর সবচেয়ে মজার বিষয় ছিল নার্সারিতে ঢুকার মুখে, আগুন পোহানোর ব্যবস্থা। ঝিরঝির বৃষ্টিতে ভিজে আমাদের বেশ ঠান্ডাই লাগছিল তাই আগুন পোহানোর সুযোগটি আর হাত ছাড়া করলাম না। ইতোমধ্যে দিনের সমাপ্তিতে রাতের সূচনা শুরু হয়ে গেছে “সব পাখি ঘরে আসে, সব নদী, ফুরায় এ জীবনের সব লেনদেন” আমরাও আরও একটি দিনের লেনদেন শেষ করে ঘরে ফিরি। ভিজে ভিজে অনেকটা সময় বেড়িয়েছি একটু ভয় ছিল যদি না আবার ঠান্ডাজ্বর এমন কিছু হয়। ভাগ্য ভালোই বলতে হবে, তেমন কিছু হয়নি। প্রথম পরীক্ষার পর দিন পাঁচেকের ছুটি, যে সময়টা আমরা অসলোতে ঘুরে এলাম, সে গল্প করা হয়েছে। এখন দ্বিতীয় পরীক্ষার প্রস্তুতি চলছে পুরোদমে। এই পরীক্ষাটি সনাতন নিয়মে হবে, যথারীতি একদম কেন্দ্রে গিয়ে পরীক্ষা দেওয়া। পরীক্ষার সময় নির্ধারিত ছিল সকাল ৮টায় আমরা পরীক্ষার পনের মিনিট আগেই কেন্দ্রে পৌঁছে গেছি। পরীক্ষার কেন্দ্রটি ছিল ফ্যান্টপের স্টুডেন্ট হাউজের খুব কাছেই, পায়ে হাঁটার দূরত্ব। আমরা যখন কেন্দ্র্রে পৌছলাম তখনো সূর্য উঠতে ঢের দেরি। চারিধার অন্ধকার। তবে, ঝরে পড়া বরফের কারণে অন্ধকার কিছুটা ফিকে। এই পরীক্ষা যদিও কেন্দ্রে গিয়ে দিতে হচ্ছে তবু আমি বেশ টেনশনে ছিলাম। কারণ, পরীক্ষা দিতে হবে অনলাইনে কম্পিউটারে। কর্তৃপক্ষ আগেই জানিয়েছিল পরীক্ষার্থী চাইলে নিজের ল্যাপটপ ব্যবহার করতে পারবে অথবা কর্তৃপক্ষ ল্যাপটপ সরবারহ করবে। তবে, কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে ল্যাপটপ নিতে হলে অন্তত সপ্তাহখানেক আগেই চাহিদা দিতে হবে। যেহেতু সবাই নিজের ল্যাপটপে কাজ করতে স্বছন্দবোধ করে তাই বিশেষ ব্যতিক্রম ছাড়া কেউ ল্যাপটাপের জন্য চাহিদা দেয়নি, আমিও ব্যতিক্রম ছিলাম না। তবে গোল বাঁধলো পরীক্ষার ঠিক আগের রাতে। কোনো কারণ ছাড়াই কিছুক্ষণ পরপর আমার ল্যাপটপটি নিজে নিজেই শাট-ডাউন হয়ে যাচ্ছিল। যেহেতু সেই মহূর্তে আর অন্যকোনো ল্যাপটপ জোগাড় করা সম্ভব হয়নি তাই স্বাভাবিকভাবেই আমি খুব চিন্তিত ছিলাম, নির্বিঘেœ পরীক্ষা শেষ করতো পারবো কি না। পরীক্ষা শুরুর আগেই কেন্দ্রে দায়িত্বরতদের সাথে এ বিষয়ে কথা বলে নিয়েছিলাম, যদি হঠাৎ কম্পিউটার শাটডাউন করে তাহলে যেন ব্যাকআপ সাপোর্ট পাই। তারাও আমাকে আশ্বস্ত করেছিল, যাই হোক, শেষ পর্যন্ত পরীক্ষা শেষ করতে পেরেছিলাম। একদম নির্বিঘেœ না হলেও শেষ পর্যন্ত খুব বেশি খারাপ কিছু হয়নি, যদিও ল্যাপটপ একবার হ্যাং হয়েছিল তবে তা খুব অল্প সময়ের মধ্যেই ঠিক করে নেওয়া গেছে।

এরপর টানা দশদিন সময় পরবর্তী পরীক্ষার। অবশ্য এটাকে পরীক্ষা না বলে অ্যাসাইনমেন্ট বলা ভালো, একটা গবেষণাপত্র যা আন্তর্জাতিক জর্নালে ছাপা হয়েছে এমন একটা গবেষণাপত্র নিজের পছন্দমতো বেছে নিয়ে তার পর্যালোচনা করতে হবে। বিষয়টি বেশ মজার। আর এর একটা ড্রাফ্ট আমরা আগেই ক্লাস প্রেজেন্টেশনে উপস্থাপন করেছিলাম তাই বিষয়টি এখন আর অতো ঝামেলাপূর্ণ নয়। এখন যা করতে হবে ড্রাফট দেখে কোর্স টিচার যে সংশোধনী এবং মতামত দিয়েছেন তার ভিত্তিতে অ্যাসাইনমেন্টটি ফাইনাল করে জমা দিতে হবে। সময় ডিসেম্বরের দশ তারিখ দুপুর ১.০০টা। এদিকে অনেকেরই দেশে ফেরার তোড়জোড় শুরু হয়েছে, যদিও আমাদের ফেরার টিকেট জানুয়ারির ১ তারিখ কনফর্ম করা আছে কিন্তু অনেকেই এ তারিখটি পরিবর্তন করে ডিসেম্বরের ১২ তারিখ এগিয়ে এনেছে। অন্যদিকে আমার আবার ফ্রান্সে যাওয়ার তাড়া আছে, সেখানে আমার কাজিন আছে। আগেই বলেছি, অক্টোবরে দুইদিনের জন্য ফ্রান্সে গিয়ে তার বাসায় ছিলাম কিন্তু এত অল্প সময়ের জন্য যাওয়া, এতে আমাদের কারো মন ভরেনি। সামনে ক্রিসমাস, টিকেটের দাম আকাশচুম্বী তাও পাওয়া যাচ্ছে না। বেশ খুঁেজ পেতে ১০ ডিম্বেরের টিকেট জোগাড় করা গেছে তাও প্রায় দিন বিশেক আগে কনফর্ম করতে হয়েছে। ১০ তারিখ বিকেল ৫টায় ফ্লাইট তাই আমি বেলা ১১.৩০ মিনিটে অ্যাসাইনমেন্ট জমা দিয়ে ব্যাগপত্র গুছিয়ে নিয়ে কোনোরকমে লাঞ্চ করে আড়াইটার মধ্যে বেরিয়ে পড়লাম। সেদিন আর রান্নার ঝামেলায় যাইনি, ফারজানার সাথেই লাঞ্চ করা হয়েছিল, ফারজানা ১২ তারিখ দেশে ফিরে যাবে, তার সাথেও নরওয়েতে আর দেখা হবে না, কেমন যেন একটু মন খারাপ হচ্ছিল। কেননা, আমি আবার ২৭ তারিখ বারগেনে ফিরবো তখন প্রায় অনেকেই থাকবে না বিশেষ করে ফারজানা থাকবে না।

আমি ওর্লে (ঙৎষু) এয়ারপোর্টে যখন চেক আউট করি তখন সন্ধে, প্রায় ৭টা বাজে। এর আগের বার যখন প্যারিসে আসি তখন চার্লস ডি গালে (ঈযধৎষবং ফব এধঁষষব) এরারপোর্ট হয়ে এসেছিলাম। তাই এবার চেক আউট শেষে একটু ধন্দে পড়ে গিয়েছিলাম কোন পথে বের হবো, অবশেষে এক কেরলার আকাশকন্যার সহযোগিতায় পথ খুঁঁজে পেলাম। আমার ভাই সবুজ আগে থেকেই অপেক্ষায় ছিল, সাথে ভাতিজাগণও। আবার সেই প্যারিস, দ্য সিটি অব লাভ (রঃ ধিং)।  [চলবে]