বাড়ি থেকে পালিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন শাহীন সামাদ

19 Dec 2023, 02:23 PM সারেগারে শেয়ার:
বাড়ি থেকে পালিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন শাহীন সামাদ

প্রবাদপ্রতিম নজরুল সংগীতশিল্পী শাহীন সামাদ ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ চলাকালীন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের একজন কণ্ঠযোদ্ধা ছিলেন। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধারা যেরকমভাবে অস্ত্র দিয়ে যুদ্ধ করে পাকহানাদার বাহিনীকে পরাজিত করেছিলেন ঠিক তেমনিভাবে শাহীন সামাদ যুদ্ধ করেছিলেন কণ্ঠ দিয়ে। যুদ্ধ চলাকালীন তিনি ‘বাংলাদেশ মুক্তি সংগ্রামী শিল্পী সংস্থা’য় যোগ দেন। বিভিন্ন রিফিউজি ক্যাম্প এবং মুক্তাঞ্চলে ঘুরে-ঘুরে মুক্তিযোদ্ধা এবং সাধারণ মানুষদের যুদ্ধে উদ্বুদ্ধ করার লক্ষ্যে দেশাত্মবোধক গান পরিবেশন করতেন। তিনি তার কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ পেয়েছেন বিভিন্ন পুরস্কার ও সম্মাননা। শাহীন সামাদকে চলতি বছর মে মাসে বাংলা একাডেমি প্রবর্তিত নজরুল পুরস্কার-২০২৩ প্রদান করা হয়। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে যুক্ত হওয়া এবং সমসাময়িক বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন আনন্দভুবনের সঙ্গে। তার কিছু অংশ তুলে ধরা হলো এবারের সারেগারে আয়োজনে। লিখেছেন শহিদুল ইসলাম এমেল...


শাহীন সামাদ দীর্ঘ পাঁচ দশক ধরে ধ্রুপদী সংগীতচর্চায় বিচরণ করছেন। মুক্তিযোদ্ধা, প্রবাদপ্রতিম সংগীতশিল্পী শহীন সামাদের সংগীতে হাতেখড়ি মাত্র সাত বছর বয়সে। বাবা-মায়ের অনুপ্রেরণায় শাহীন সামাদ ১৯৬৪ খ্রিষ্টাব্দ থেকে নজরুলের গানকে বাংলাদেশের সংগীতপিপাসুদের কাছে সুষ্ঠু-সুন্দরভাবে উপস্থাপনের ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রেখে চলেছেন। তিনি খুব অল্প বয়স থেকে ওস্তাদ রাম গোপাল, ফজলুল হক, ফুল মোহাম্মদ, মোহাম্মদ সগীর উদ্দিন খান, মশকুর আলী খানের মতো খ্যাতিমান প-িতদের কাছে শাস্ত্রীয় সংগীতের তালিম নিয়েছেন। এছাড়া তিনি পরবর্তীসময়ে শেখ লুতফর রহমান, সোহরাব হোসেন, সুধীন দাস, অঞ্জলি রায়, সনজিদা খাতুন, ওয়াহিদুল হক, আজাদ রহমানের কাছেও তালিম নেন।

শিল্পী জীবনের শুরু থেকেই নিজস্ব গায়কি ঢং সৃষ্টিতে সক্ষম। শাহীন সামাদ শুধু নজরুলসংগীত নয়, পুরনো দিনের বাংলা গান পরিবেশনেও সফলতা অর্জন করেন।

শাহীন সামাদ ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের একজন কণ্ঠযোদ্ধা ছিলেন। সেই সময়ে তিনি ৩৬টির মতো দেশাত্মবোধক গানে কণ্ঠ দিয়েছেন। এছাড়া যুদ্ধ চলাকালীন তিনি সংস্কৃতিগোষ্ঠী ‘বাংলাদেশ মুক্তি সংগ্রামী শিল্পী সংস্থা’য় যোগ দেন। তারা বিভিন্ন রিফিউজি ক্যাম্পে এবং মুক্তাঞ্চল ঘুরে ঘুরে মুক্তিযোদ্ধাদের এবং সাধারণ মানুষদের যুদ্ধে উদ্বুদ্ধ করার লক্ষ্যে দেশাত্মবোধক গান পরিবেশন করতেন। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে যুক্ত হলেন কীভাবে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “ওখানে আমরা বাংলাদেশ মুক্তি সংগ্রামী শিল্পী সংস্থার সঙ্গে ছিলাম। তখন ওই সময়ে আমাদের সংগঠনের সঙ্গে বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীরাও ছিলেন। তাদের পাশাপাশি সাংস্কৃতিক অঙ্গনের সঙ্গে জড়িত নামিদামি ব্যক্তিরাও আমাদের সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ফলে আমরা একটা শক্তিশালী সংস্থা হিসেবে পরিচিতি পাই। আমরা পুরো পশ্চিমবাংলা কাভার করেছিলাম। শরণার্থী ক্যাম্পে ঘুরে ঘুরে মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিলাম। তখন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সমর দাস আমাদের ডাকলেন। আমরা প্রথমে ৮টি গান করে দিয়েছিলাম। তারপর আবার ডাক পড়ল। তখন আমরা বাংলাদেশ মুক্তি সংগ্রামী শিল্পী সংস্থার সঙ্গে মুক্তাঞ্চলে যাব। প্রথম মুক্তাঞ্চল যশোহর হওয়ায় যেতে পারিনি। পরে আমরা ১৪টি গান কলকাতার টালিগঞ্জ স্টুডিও থেকে করে দিয়েছিলাম। সেগুলোই ২৪ ঘণ্টা বেজেছে। এরপরেও আবার একবার সমরদা ডেকেছিলেন। তখন বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার তলে আমরা আমাদের জাতীয় সংগীত গেয়েছিলাম। এভাবে আমরা স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলাম।”

শাহীন সামাদ যুদ্ধের পর ১৯৭৩ খ্রিষ্টাব্দে লন্ডন চলে যান। ২২ বছর ছিলেন সেখানে। তবে আসা-যাওয়া ছিল প্রতিবছরই। তিনি যে ঢাকায় নেই সেটা অনেকেই জানতেন না। তিনি যখন দেশে আসতেন তখন বিটিভির জন্য বেশ কিছু গান করে যেতেন। তখন বিটিভি ছাড়া অন্য কোনো চ্যানেল ছিল না। তার গানগুলো তখন একমাত্র টিভি চ্যানেল বিটিভিতে সবসময় প্রচার হতো। যার কারণে কেউ বুঝতে পারেনি তিনি দেশের বাইরে আছেন।

একজন নারী হয়েও যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন তিনি। অবশ্য অনেক নারীই তখন যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল। কিন্তু তার বিষয়টি ছিল ভিন্ন। বাড়ি থেকে পালিয়ে মুক্তিযুদ্ধে চলে যান শাহীন সামাদ। তখন তার বয়স ছিল ১৪ বছর। এতে তার মা-সহ পরিবারের অন্যরা কষ্ট পান। তার বাবা যুদ্ধের আগেই মারা গিয়েছিলেন।

যুদ্ধ শেষে যখন পরিবারের কাছে ফিরে এলেন তখনকার অনুভূতি জানতে চাইলে বলেন, “ওইটা তো ছিল একটা সাংঘাতিক অনুভূতি। কারণ, পরিবারের লোকজন তো বিশ্বাসই করেন নাই আমি বেঁচে আছি। যখন আমি বাড়িতে ঢুকি তখন তো মা-ভাই-বোন সবাই আনন্দে আত্মহারা। ওই আনন্দটুকু এখনো মনে পড়ে। মায়ের আদর করে আনন্দে বুকে টেনে নেওয়ার অনুভূতি এটা কি ভুলবো কখনো।”

শাহীন সামাদ কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েন, তখন থেকেই সংগীতে সফলতা দেখিয়েছেন। কলেজে পরপর দুই বছর সাংস্কৃতিক সপ্তাহে নজরুল ও রবীন্দ্রসংগীতে প্রথম স্থান অধিকার করেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শামসুন নাহার হলের সাংস্কৃতিক সম্পাদিকা ছিলেন। তিনি ছায়ানট সাংস্কৃতিক অঙ্গন, নজরুলসংগীত শিল্পী পরিষদ, সেতুবন্ধন, নজরুল ইন্সটিটিউট-সগ নানা সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত আছেন। তিনি সংগীতে গৌরবময় ও কৃতিত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০১৬ খ্রিষ্টাব্দে একুশে পদকে ভূষিত হন। এ ছাড়া নজরুল ইন্সটিটিউট আজীবন সম্মাননা, ন্যাশনাল প্রেসক্লাব অ্যাওয়ার্ড, বাংলাদেশ হাইকমিশন [কলকাতা] অ্যাওয়ার্ডসহ বহু পুরস্কার ও সম্মাননা লাভ করেন। আগেই জানিয়েছি, সংগীতশিল্পী শাহীন সামাদ বাংলা একাডেমি প্রবর্তিত ‘নজরুল পুরস্কার-২০২৩’ পেলেন কয়েক মাস আগে।

২৪ মে ২০২৩, বুধবার বাংলা একাডেমির আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ মিলনায়তনে এক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে শিল্পীর হাতে পুরস্কার তুলে দেওয়া হয়।

পুরস্কারপ্রাপ্তির অনুভূতি জানিয়ে শাহীন সামাদ বলেন, ‘নজরুল আমাদের সারাজীবনের চর্চা ও সাধনার বিষয়। বাংলা একাডেমি প্রদত্ত নজরুল বিষয়ক এ অমূল্য সম্মাননা আমার শিল্পীজীবনে অত্যন্ত গর্ব ও আনন্দের বার্তা বয়ে এনেছে।’

শাহীন সামাদ ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দের ২৭ ডিসেম্বর তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তান [বর্তমান বাংলাদেশ] কুষ্টিয়া জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম সামসুল হুদা, মায়ের নাম শামসুন নাহার রহিমা খাতুন। তার শৈশবের বেশিরভাগ সময় কাটে পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুঁড়ি জেলায়।