‘কালরাত্রি’ মুক্তিযুদ্ধের একটি কোলাজচিত্র

19 Dec 2023, 02:28 PM রঙ্গশালা শেয়ার:
‘কালরাত্রি’ মুক্তিযুদ্ধের একটি কোলাজচিত্র

বিজয়ের মাসে পদাতিক নাট্যসংসদ [টিএসসি] পরিবেশন করলো তাদের ৩৮তম প্রযোজনা- ‘কালরাত্রি’। লামিসা শিরীন হোসাইনের গল্প অবলম্বনে ও তানভীর আহমেদ সিডনীর নাট্যরূপে ‘কালরাত্রি’র নির্দেশনা দিয়েছেন ওয়াহিদুল ইসলাম।

নাটক দেখতে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির প্রাঙ্গণে আসতেই শোনা গেল মুক্তিযুদ্ধের গান। গানের সুর মাথায় নিয়ে মিলনায়তনে ঢুকতেই মঞ্চে দেখা গেল যুদ্ধের আবহ। ব্যাকড্রপের স্ক্রিনে দাউ দাউ জ্বলছে আগুন আর তারপরেই ভেসে এলো কণ্ঠস্বর যা আমাদের মনে করিয়ে দিল পঁচিশে মার্চ কালরাত্রির কথা- অপারেশন সার্চলাইট নামে যা পরিচিত। কুখ্যাত এই পরিকল্পনার একটি টার্গেট ছিল ঢাকা বিশ্ববদ্যালয় ছাত্রনিবাসে আবাসিক শিক্ষার্থীরা। এ হত্যাকা- ঘটায় পাঞ্জাব রেজিমেন্টের সেনারা। তারা তল্লাসি চালায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনিবাসগুলোতে এবং হত্যা করে নিরস্ত্র ছাত্রসহ অনেক অধ্যাপক ও তাদের পরিবারের সদস্যদের। পরদিন সকালে পাঞ্জাব রেজিমেন্ট পাশের হিন্দু এলাকায়, পুরান ঢাকায় আক্রমণ চালায় এবং পত্রিকা অফিস, মন্দির গুঁড়িয়ে দেয়। পাঞ্জাব রেজিমেন্ট কর্তৃক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও তার আশেপাশের এলাকায় সংঘটিত হত্যাযজ্ঞের ঘটনাই কালরাত্রি নাটকের প্রেক্ষাপট।

যদিও নাটকের ঘটনাকাল শুরু হয়েছে পঁচিশে মার্চের আরো কিছুদিন আগের সময় থেকে। আর যার ফলে কাল-পরিক্রমায় আমরা শুনতে ও দেখতে পাই বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণের ভিডিও চিত্র। বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে সাড়া দিয়ে সক্রিয় হয়ে ওঠে বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ ছাত্র-ছাত্রীর দল। দিনভর এই তরুণদের সময় কাটে একটি মুক্ত-স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নে। আর সেই স্বপ্নকে ঘিরেই কাটে তাদের দিনমান মিছিল-সমাবেশ, পরিকল্পনা, পোস্টার-প্ল্যাকার্ড লেখা নিয়ে নানা কর্মকা-। তার পাশাপাশি আসে প্রেম, চায়ের দোকানের আড্ডা, মধুদার ক্যান্টিনের গরম গরম সিঙ্গারা, বন্ধুদের খুনসুটি এরকম নানা চিত্র। কিন্তু দৈনন্দিন নানা কাজ, বাসনা, ব্যক্তিগত স্বপ্ন ব্যতিরেকে তারা ভুলে যায় না তাদের মূল দায়িত্বের কথা। ব্যক্তিকে ছাড়িয়ে তারা একটি দেশের, একটি প্রজন্মের, একটি জনগোষ্ঠীর। সময় তাদের উপর অর্পণ করেছে এ দায়িত্ব। তারাই তো এই জাতীয় পতাকার ধারক ও বাহক। এই তরুণপ্রাণ ছাত্রদের পাশে দেখা যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক তরুণপ্রাণ শিক্ষককে। যিনি এই তরুণদের সার্বক্ষণিক প্রেরণা জুগিয়ে চলেছেন, স্বাধীনতার মূলমন্ত্রে দীক্ষিত করে চলেছেন।

এই তরুণপ্রাণ শিক্ষক বর্তমানে বয়সের ভারে শারীরিকভাবে কিছুটা দুর্বল কিন্তু তার মনোবল, স্বপ্ন, আদর্শ কিছুই ম্লান হয়নি সময়ের কশাঘাতেও। শিক্ষকের সেই ছাত্ররা সবাই পঁচিশে মার্চের কালরাত্রিতে পাঞ্জাব রেজিমেন্টের সৈন্যদের হাতে শহীদ হন, কিন্তু আহত হয়েও বেঁচে আছে মাত্র একজন ছাত্র। আহত সেই ছাত্র শরীরে আর মননে বয়ে বেড়ায় যুদ্ধদিনের স্মৃতি। বিস্মৃত হয় না ক্ষণিকের জন্য সোনার বাংলা গড়ার প্রত্যয় থেকে। শিবনারায়ণ দাসের নকশায় যে জাতীয় পতাকা মাথা উঁচু করে অস্তিত্ব জানান দিয়েছিল একাত্তরে বিশ্বের দরবারে, তার মান সমুন্নত রাখার দায়িত্ব আজ তো নতুন প্রজন্মের কাঁধেই। স্বপ্নকামী শিক্ষক আজ সেই পতাকাই তুলে দেন নতুন প্রজন্মের প্রতিনিধি, তারই নাতনির হাতে। নতুন প্রজন্মের হাতে পতপত করে ওড়ে বাংলাদেশের পতাকা।

যুদ্ধাহত ছাত্র আর শিক্ষকের কথোপকথন আর স্মৃতির ফ্ল্যাশব্যাকেই মার্চের সেই উত্তাল দিনগুলোর ছবি আর কালরাত্রির ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞটি উঠে আসে ‘কালরাত্রি’ নাটকে। কোরিওগ্রাফি, কবিতা, ভয়েস ওভার, ভিডিওচিত্র, প্রামাণ্যচিত্র, ছবি, জাগরণের গান, যুদ্ধকালীন নানা ঘটনার কোলাজ প্রভৃতির সমন্বয়ে একাত্তরের সেই সময়টিকে মঞ্চে তুলে ধরতে সচেষ্ট থেকেছেন নাটকের নির্দেশক। নাটকের ঘটনা প্রবাহের সঙ্গে ‘তীর হারা এই ঢেউয়ের সাগর পাড়ি দিব রে’, ‘দাম দিয়ে কিনেছি বাংলা’ কিংবা ‘ধনধান্য পুষ্প ভরা’ এই গানগুলোর ব্যবহার দর্শকমন আন্দোলিত করে। বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ার দৃশ্যায়নগুলো বেশ ভালো লেগেছে। রেনুমালার বয়ানে ‘কালরাত্রি’তে হিন্দু মেথরপট্টিতে পাকিস্তানি হানাদারদের অত্যাচার, ড. গোবিন্দ্র চন্দ্র দেব [ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের অধ্যাপক]-এর পালিত কন্যা রোকেয়ার বয়ানে কালরাত্রিতে তাদের পরিবারের উপর অত্যাচারের বর্ণনা ছিল বেশ মর্মস্পর্শী। অভিনেতারা অনেকেই অভিনয় নিপুণতায় ঘটনাগুলো নিখুঁতভাবে তুলে ধরেছেন। পাক অফিসার, ছাত্র, রেনুমালা, রোকেয়া, নাতনি, মুক্তিযোদ্ধার চরিত্রে রূপদানকারী অভিনেতা-অভিনেত্রীরা ছিলেন বেশ সাবলীল। তবে অনেকের মধ্যে অতি অভিনয় করার একটা প্রবণতা ছিল। কথা বলা, অভিব্যক্তি, নড়ন-চড়নগুলো স্বাভাবিক হলে অভিনয় আরো হৃদয়গ্রাহী হতো। সংলাপ বলার সময় ছোটাছুটিগুলো কমিয়ে আনা যেতে পারে। সংগীত প্রক্ষেপণের দায়িত্বে যিনি ছিলেন তাকেও আরেকটু ধৈর্যের সাথে শব্দ বাড়ানো বা কমানোর কাজটি করতে হবে। আবহসংগীত হঠাৎ বাড়িয়ে দেওয়া, আবার হঠাৎ কমে যাওয়া নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। আহত মুক্তিযোদ্ধাকে ধরতে শিক্ষক মঞ্চ ছেড়ে বাইরে চলে গেলেনÑ মঞ্চ অভিনেতাহীন শূন্য পড়ে থাকলো কিছুক্ষণ। তবে, ভালো লেগেছে অভিনেতাদের ব্লকিং এবং আলোর উপস্থিতির কথা মাথায় রেখে অভিনয় করার দক্ষতার বিষয়টি।

‘কালরাত্রি’ নতুন প্রজন্মের জন্য ইতিহাস জানার একটি কার্যকর প্রয়াস। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে দেশকে এগিয়ে নেওয়ার বার্তা ছড়িয়ে পড়–ক ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে। নতুন প্রজন্মের কাছে ইতিহাস তুলে ধরার ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নেওয়ার আহ্বানের এই প্রয়াসের জন্য ‘পদাতিক নাট্যসংসদ’ প্রশংসার দাবিদার। শুধু ঢাকার মঞ্চে নয়, ঢাকার বাইরে ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও এই নাটকের মঞ্চায়ন অব্যাহত থাকবেÑ পদাতিক নাট্যসংসদের কাছে এমনটাই প্রত্যাশা।

মঞ্চে

শাখাওয়াত শিমুল, সৃজা, ইমরান খান, ইকরামুল ইসলাম, জিনিয়া আজাদ, সালমান শুভ, এস এম লিমন, কাজী সোহেল, ওয়াহিদ জিতু, পাপিয়া, ফরহাদ সুমন, শরিফুল ইসলাম, পলাশ, রাবেয়া, জেনি, জীবন, শ্রেষ্ঠা, শোভন, আবির, মসিউর রহমান। 

লেখা : ধীমতি শুচিস্মিতা

নেপথ্যে

গল্প : লামিসা শিরীন হোসাইন

নাট্যরূপ : তানভীর আহমেদ সিডনী

নির্দেশনা : ওয়াহিদুল ইসলাম

নির্দেশনা উপদেষ্টা : সৈয়দ ইশতিয়াক হোসাইন টিটো

আলোক প্রক্ষেপণ : রহমান জীবন

আবহ নিয়ন্ত্রণ : তন্ময় বিশ্বাস

প্রজেক্টর নিয়ন্ত্রণ : মাহাদী হাসান সিমি

পোশাক সংগ্রহ : ইমরান, জিনিয়া, নাসির খান

সেট সংগ্রহ : লিমন, পলাশ মিয়া

দ্রব্য সংগ্রহ : ফরহাদ সুমন

রূপসজ্জা : মহিউদ্দিন জুয়েল, কামরুল ইসলাম

নেপথ্যেকণ্ঠ : মাহিদুল ইসলাম, তাসমী চৌধুরী, সঞ্জীব কুমার দে

প্রচার : শাখাওয়াত হোসেন শিমুল

পোস্টার ডিজাইন : নাসরীন মুস্তাফা

প্রকাশনা : মাহাদী হাসান সিমি

মঞ্চব্যবস্থাপক : ইকরামুল ইসলাম

প্রযোজনা অধিকর্তা : মমিনুল হক দিপু

প্রযোজনা উপদেষ্টা : কাজী রফিক, শেখ মোসলেহ উদ্দিন রুমু, নিহাদ কবির, আব্দুর রাজ্জাক

প্রধান প্রযোজনা উপদেষ্টা : সৈয়দ তাসনীন হোসাইন

প্রযোজনা : পদাতিক নাট্য সংসদ [টিএসসি]