ইউরোপের ১৫০ দিন -সৈয়দা তাসলিমা আক্তার

21 Jan 2024, 04:10 PM ভ্রমন শেয়ার:
ইউরোপের ১৫০ দিন  -সৈয়দা তাসলিমা আক্তার

[পূর্ব প্রকাশিতের পর]


প্যারিসে এসেছি দিন চারেক হলো, এবারের প্যারিস কেমন যেন বিষণ্ণ। আকাশ মেঘলা সূর্যের দেখা নেই বললেই চলে। তাই বাধ্য হয়ে ঘরবন্দি সময় পার করতে হচ্ছে। কিন্তু কত সময় আর বন্দি থাকা যায়, দু’দিন / তিন দিন, না আর না, ‘থাকবো নাকো বদ্ধ ঘরে’ Ñএই মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে চারদিনের দিন প্রকৃতির বিষণœতাকে উপেক্ষা করে বেরিয়ে পড়লাম, আগের বারের অসম্পন্ন কাজটি সম্পন্ন করবো বলে। ভাবছেন, প্যারিসে আমার আবার কী কাজ ? গেছি তো বেড়াতে। বেড়ানোও তো একটা কাজ, এই যে পৃথিবীকে জানা নানান মানুষ আর তাদের জীবন সম্পর্কে জানা এটা কি কম নাকি। জীবনের চলমান প্রবাহকে প্রতিনিয়তই জানা যায় এর জন্য বাড়তি কোনো সময় বা শ্রম দিতে হয় না কিন্তু যে-জীবন বা সময় অতীত তাকে জানতে সময়, শ্রম এবং অর্থ ব্যয় করতেই হয়। ভূমিকা ছেড়ে আসল কথায় আসি, আজ আমরা মিউজিয়মে যাবো, ঠিক ধরেছেন প্যারিসের ল্যু’ভর মিউজিয়াম। অক্টোবরে যখন প্যারিসে এসেছিলাম তখন আইফেল টাওয়ার আর ল্যু’ভর মিউজিয়াম এই দুটি বিখ্যাাত জায়গা দেখবো এটা একদম নিশ্চিত ছিল। যেহেতু সেবার মাত্র দুইদিনের জন্য প্যারিস এসেছিলাম তাই যেদিন প্যারিস এসে পৌঁছাই সেদিন বিকেলেই আইফেল টাওয়ার দেখতে চলে যাই। যেহেতু তখন বিকেল এতো ছোটো ছিল না তাই পড়ন্ত বিকেলে আইফেল টাওয়ারে সৌন্দর্য উপভোগের পাশাপাশি এর রাতের সৌন্দর্যও আমরা উপভোগ করতে পেরেছিলাম। তথ্যগত বিভ্রান্তির কারণে পরদিন ল্যু’ভর মিউজিয়াম গিয়েও তা দেখতে পারিনি। কেননা, সেদিন ল্যু’ভর সাপ্তাহিক ছুটি ছিল। এবার আর সে চান্স নেই তবে আমার বাকি তিন ট্যুরমেট যারা অক্টোবরে আমার সফর সঙ্গী ছিল তাদের জন্য একটু মন খারাপ হচ্ছিল বৈ কি। যা হোক, মোটমুটি সারাদিনের পরিকল্পনা হাতে দিয়ে সকাল সকালই আমরা বেরিয়ে পড়লাম। ল্যু’ভর মিউজিয়ামটি এত বিশাল যে সারাদিনেও এর পুরোটা ঠিকঠাক ঘুরে দেখা সম্ভব কি না সে ব্যাপারে আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে।

টিকেট কাউন্টার সব সময়ই খুব বিরক্তিকর, একঘেয়ে লম্বা লাইন, আর বিশ্ব বিখ্যাত মিউজিয়াম যা অনেকটা স্বপ্নের মতো বা অনেকের কাছে এটি একটি লালিত স্বপ্ন যে ল্যু’ভর মিউজিয়াম দেখবে সে ক্ষেত্রে এখানে ভিড় থাকা খুবই স্বাভাবিক। আমার কাজিন সবুজ ভাই টিকেট কাটতে গেল এই ফাঁকে আমরা মিউজিয়ামের বাহিরটা ঘুরে দেখতে লাগলাম। এর বাহিরের অংশও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়, চমৎকার স্থাপত্য শৈলী আর আলোর খেলায় মুগ্ধ হওয়ার মতোই সাজসজ্জা, সাম্প্রতিক সময়ে এর মূল ফটকের সামনে কাচ নির্মিত পিরামিডের সৌন্দর্যে আলাদা মাত্রা যোগ করেছে। এখন সময় ডিসেম্বরের মাঝামাঝি, ক্রিসমাসের কাউন্ট-ডাউন ইতোমধ্যে শুরু হয়ে গেছে, সারা ইউরোপ এখন আলোর সাজে ঝলমলে ল্যু’ভর মিউজিয়ামও এর বাইরে নয়। মিউজিয়ামের স্বাভাবিক সৌন্দর্যের সাথে উৎসবের এই আলো ট্যুরিস্টদের জন্য বাড়তি পাওনা। অনেক কাউন্টার থাকা সত্ত্বেও টিকেট কাটতে বেশ খানিকটা সময় লেগে গেল সাথে শিশু থাকায় বেবি স্ট্রলার নিতে হলো এর জন্যও কিছু সময় ব্যয় হলো। তবে, টিকেট কেটে মিউজিয়ামে ঢুকতে ঢুকতে যে মজার বিষয়টা জানলাম তা হলো এই টিকেটের মেয়াদ সারাদিন অর্থাৎ আজ যে সময় পর্যন্ত মিউজিয়াম খোলা থাকবে তার মধ্যে আমি যতবার ইচ্ছা মিউজিয়াম থেকে বাইরে বের হতে পারবো আবার ইচ্ছা হলেই মিউজিয়ামে ঢুকতে পারবো। আমাদের দেশে যেমন দেখা যায় কোথাও টিকেট কেটে ঢুকলাম এরপর কোনো কারণে সেখান থেকে বের হয়ে গেলে আবার ঢুকতে চাইলে আবার নতুন করে টিকেট কাটতে হয়। যা হোক সকল আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে অবশেষে আমরা ল্যু’ভর বিশাল সা¤্রাজ্যে প্রবেশ করলাম। ঢোকার গেটটিও বেশ মজার অনেকটা গোলকধাঁধার আদলে করা, শিশুরা বেশ মজা পাচ্ছিল, ও বলা হয়নি, আমরা আজ পাঁচজন আছিÑ আমি, আমার চাচাত ভাই, ভাবি আর তাদের দুই ছেলে। মিউজিয়ামের গোলকধাঁধার গেট পার হয়ে একটি ছোটো সরু সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতেই মনে হলো যে শতাব্দী পেছনে ফেলে চলে এসেছি।

মূল মিউজিয়ামে ঢোকার আর কোনো গেট আছে কি না আমার জানা নেই, তবে আমরা যে গেট দিয়ে ঢুকেছি আমার মনে হলো আমি টাইম মেশিনে চড়ে অতীতে চলে গেছি। শুধু অতীতে পৌঁছেই ক্ষান্ত ছিলাম না, অতীত, দূর অতীত, নিকট অতীত অর্থাৎ অতীতের বিভিন্ন ধাপ পেরিয়ে গেছি। কেননা, এই মিউজিয়ামে মোট আটটি সংগ্রহশালা রয়েছে যেখানে প্রচীন মিশরীয় পুরাতত্ত্ব থেকে শুরু করে এট্রাস্কান, গ্রিক, রোমান এবং মুসলিম সভ্যতার নানান নিদর্শন, চিত্রকলা ও ভাস্কর্য সংরক্ষিত আছে। আগেই বলেছি মিউজিয়ামটি এত বড় যে, গোটা একটা দিনও এর জন্য যথেষ্ট নয় আর কিছুক্ষণ তো আমরা ধন্দেই ছিলাম যে কোন দিক থেকে শুরু করব। তারপর দিশা না পেয়ে হাতের ডান দিক থেকে হাঁটতে শুরু করলাম। আসলে কি দেখলাম আর কি দেখলাম না সেটা আমার মতো আনাড়ি মানুষের পক্ষে বলা সম্ভব না, তবে ল্যু’ভর ঘুরতে এসে যেটা মনে হলো আগে থেকে ভালো মতো হোমওয়ার্ক করে, রোডম্যাপ তৈরি করে আসা দরকার ছিল। এই মিউজিয়ামের অনন্য বৈশিষ্ট্য হচ্ছে বিচিত্র সব চিত্রকর্মের ভা-ার, ইতিহাসকে ধারণ করে এ রকম বিভিন্ন তৈজসপত্র, আসবাব এবং গয়নার মধ্যে চিত্রকর্মের প্রধান্যই এখনে বেশি, অথবা বলা যায়, আমি মিউজিয়ামের যে দিকটাতে বিচরণ করেছি সে দিকটা মূলত চিত্রকর্মের সংগ্রহশালা। আর হবে নাই-বা কেন, এটি পৃথিবীর অন্যতম আর্ট মিউজিয়াম। আমরা মূলত মোনালিসাকে লক্ষ্য করে এগিয়েছি। সেসময় সাময়িকভাবে মোনালিসার আবাস পরিবর্তন হয়েছে। কেননা, যেখানটায় তার স্থায়ী আবাসন ছিল সেখানেটায় রিনোভেশনের কাজ চলছিল। বহু কষ্টে মোনলিসার সন্ধান পেলেও তার দর্শন পাওয়া ছিল রীতিমতো যুদ্ধ জেতার সামিল, মনে হচ্ছিল যেন যারা লু’ভর মিউজিয়ামে আসে তাদের একমাত্র লক্ষ্যই হচ্ছে মোনলিসার সাথে সাক্ষাৎ। মাঝারি আকৃতির একটি কক্ষের কিছু অংশ রেসটিকটেড এরিয়া করে সেখানে মোনালিসাকে রাখা হয়েছে, বেশ খানিকটা দূরত্ব বজায় রেখে মোনালিসাকে দেখতে হয়। খুব ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও শুধু মোনালিসার সাথে কোনো ছবি তোলা সম্ভব হয়নি, তাই আপাতত সে আশা অপূর্ণ রেখেই আমরা ছবির রাজ্য ছাড়িয়ে মমির দেশে চলে গেলাম।

মমির রাজ্যে প্রবেশ করে সারি সারি মমির কফিন দেখে ভাবলাম, বুঝি এর সবকটিতেই মমি ঘুমিয়ে, কিন্তু না এই বাহারি কফিনগুলোর সব কটিই খালি, পুরো রাজ্যে একটি মাত্র মমি রয়েছে এবং তা দেখে আমি হতাশ। কেননা, আমার কল্পনায় মমির যে চেহারা বা মাম্মি রিটার্নসে মমির যে আদল তার সাথে এর কোনো মিল নেই। যা হোক, মমির রাজ্যেই এক কল্পনার রাজপ্রসাদ সাজানো, যেখানে রয়েছে এক রাজপ্রসাদের ডামি চিত্র, যেখানে রাজা-রানি আমর্ত্যবর্গ সবই আছে। মমির দেশে ঘোরাঘুরি শেষ করে আমরা গল্পের পাতাল পুরিতে প্রবেশ করলাম যেখানে রয়েছে নানানরকম হীরে জহরতের ভা-ার, প্রাচীন মূল্যবান অলংকারের তেজস্বী জ্যোতিতে কিছুক্ষণ ধন্দে থেকে আমরা ফিরে এলাম মর্ত্যরে পৃথিবীতে।

আমি আসলে ধারাবহিকভাবে বলতে পারবো না যে, কোন সেকশনের পর কোনটি দেখেছি। তবে, যা যা দেখেছি তারই একটি সংক্ষিপ্ত চিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করছি। প্রতিটা মিউজিয়ামের একটি বড়ো অংশজুড়ে থাকে প্রাচীন তৈজস ও আসবাবের সমারোহ ; ল্যু’ভর মিউজিয়ামও এর ব্যাতিক্রম নয়। আর এটি আমার খুব পছন্দের একটি বিষয়। বেশ সময় নিয়ে আসবাব এবং তৈজসপত্র দেখে ইচ্ছেমতো ছবি তুলে বেশ খানিকটা সময় এখানে কাটিয়ে দিলাম। অবশ্য অন্য একটি কারণও ছিল, আসলে মিউজিয়ামে ঘুরতে ঘুরতে আমরা ততক্ষণে বেশ ক্লান্ত আর এ অংশটিতে ভিড় বেশ কম হওয়ায় আমরা এখানে খানিকক্ষণ বিশ্রামও নিয়ে নিলাম। মিউজিয়ামের সংগ্রহশালার মধ্যে একটি মজার বিষয় ছিল, কাল্পনিক বা অতিপ্রাকৃত কল্পনার রূপায়িত চিত্র বা ভাস্কর্যের সমাহার, যেখানে কল্পনার ড্রাগনের চিত্র যেমন ছিল, তেমনি ছিল অর্ধেক নারী অর্ধেক ঈশ্বরীর আদলে তৈরি ভস্কর্য, ছিল মানুষ মুখের ঘোড়া। আমি চমকিত হয়েছি ক্যালিগ্রাফির ভা-ার দেখে, ইসলামি চিত্রকলার এ নান্দনিক রূপটি যেমন একদিকে সমৃদ্ধ মুসলিম সভ্যতার প্রতিনিধিত্ব করছে তেমনি অতি আদিম চিত্রকলার পাশাপাশি চিত্রকলার এ রূপটি দৃষ্টিকে বেশ আরাম দেয়। মূলত ক্যালিগ্রাফি ছাড়া অধিকাংশ চিত্রকলাতে নারীর রূপ আর শারীরিক সৌন্দর্যকে প্রধান্য দেওয়া হয়েছে, চিত্রিত হয়েছে নারী-পুরুষের আদিমতম সম্পর্কের রূপ ; যে কারণে চিত্রকর যা বোঝাতে চেয়েছেন সাধারণ দর্শকের দৃষ্টি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তার থেকে সরে যায়, অথবা চিত্রের মাধমে যে সময় বা ঘটনাকে ব্যাখ্যা করতে চেয়েছেন সেটা অনেকটা উহ্য হয়ে যায়, এটা আমার নিজস্ব পছন্দ বা অভিমত।

[চলবে]