সংগীত : ২০২৩

21 Jan 2024, 04:41 PM সারেগারে শেয়ার:
সংগীত : ২০২৩

ভালো-মন্দ মিলিয়ে দেখতে দেখতে চলে গেল আরো একটি বছর। গেল কয়েক বছর করোনা মহামারির কারণে সংগীতাঙ্গনে ছিল মন্দাভাব। করোনার মন্দাভাব পুরোপুরি কাটিয়ে ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দে সংগীতাঙ্গনে ফিরেছে প্রাণচাঞ্চল্য। এই প্রাণচাঞ্চল্যের মধ্যেই শেষ হয়ে গেল ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দ। সামনে চলে এসেছে নতুন বছর ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ। আগের বছরগুলোতে প্রযুক্তির সহজ ব্যবহারের কারণে গানে সেরকম প্রাণ ছিল না। যার কারণে দুয়েকটি গান ছাড়া তেমন সাড়া ফেলতে পারেনি। এর কারণ হিসেবে বলা যায়, বিগত বছরগুলোতে গানে ছিল শুধুই মজা-মনোরঞ্জন আর অধিক ‘ভিউ’ পাওয়ার উদ্দেশ্যে করা। সে তুলনায় ২০২৩-এ গানে যেমন ছিল প্রাণ, তেমনি ছিল শ্রোতা-দর্শকদের মধ্যে উচ্ছ্বাস-উন্মাদনা। এ বছর বিভিন্ন মাধ্যমে বেশকিছু গান ভাইরাল হয়েছে এবং একইসঙ্গে শ্রোতাদের প্রশংসাও পেয়েছে। এ বছর নতুন মৌলিক গান রেকর্ড করার পাশাপাশি শিল্পীরাও স্টেজ শো নিয়েও বেশ ব্যস্ত ছিলেন। ২০২৩-এর সংগীত সালতামামি নিয়ে থাকছে এবারের সারেগারে আয়োজন। লিখেছেন শহিদুল ইসলাম এমেল...



২০২৩ খিষ্টাব্দে মূলধারার গানের প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান ছিল বলতে গেলে নীরব। অথচ কয়েক বছর আগেও গান নিয়ে প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানগুলো ছিল সরব। ওই সময়ে দেশের বড়ো বড়ো প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকতে হতো শিল্পীদের। কখন শিল্পীদের ডাক পড়বে। এরপর সিডি-ক্যাসেটের যুগ পেরিয়ে সামনে চলে এলো ইন্টারনেট, ইউটিউব ও মিউজিক ভিডিওর যুগ। ক্যাসেট-সিডির যুগে বড়ো বড়ো প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানগুলো সংগীতাঙ্গনে রাজত্ব করে গেছে। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রযুক্তির সহজ ব্যবহারের কারণে শিল্পীদের বোধোদয় হতে শুরু হয়। আর তখনই ক্রমান্বয়ে প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের ব্যবসা হারাতে শুরু করল। বর্তমান যুগে এসে শিল্পীরা এখন নিজেরাই ইউটিউব চ্যানেল খুলে মিউজিক ভিডিও বানিয়ে আপলোড করতে শুরু করে। যার কারণে প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানগুলোও গান প্রকাশ কমিয়ে দিয়ে নাটক তৈরি ও সিনেমা প্রকাশ করতে থাকেন তাদের ব্যবসায়িক স্বার্থে। গত কয়েক বছর ধরে এ প্রক্রিয়া চলমান থাকায় মূলধারার প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানগুলোও দিন দিন জনপ্রিয়তা হারিয়েছে। ২০২৩-এ সেটা ছিল চোখে পড়ার মতো। আলোচ্য বছর সংগীতের প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে সেভাবে কোনো গান প্রকাশিত কিংবা আলোচিত হতে দেখা যায়নি। যেগুলো প্রকাশ হয়েছে সেটাও একেবারেই হাতেগোনা। যার কারণে স্বভাবতই এসব প্রতিষ্ঠান ছিল নীরব। বর্তমানে অনেক শিল্পীই তাদের নিজস্ব ইউটিউব চ্যানেলে গান আপলোড করে রীতিমতো ভাইরাল হচ্ছেন।


ইউটিউব চ্যানেলে আলোচিত এবং সর্বাধিক ভিউ হওয়া কিছু গান

কালাচান : গেল বছর সব থেকে বেশি ভাইরাল হয়েছে তসিবার কণ্ঠে ‘কালাচান’ গানটি। এতে তার সঙ্গে র‌্যাপ গেয়েছেন এফ এ প্রিতম। গানটির ভিউ ১২ কোটি ছাড়িয়েছে। সালাউদ্দিন সাগরের কথায় গানটির সংগীতায়োজন করেন এফ এ প্রিতম। গানটি বার্নবী রেকর্ডসের ব্যানারে ৮ মাস আগে প্রকাশিত হয়েছে।

ঝুমকা : জেফারের কণ্ঠে ‘ঝুমকা’ শিরোনামের একটি গানের ভিউ হয়েছে প্রায় ১০ কোটি। গানটি এখন সবার মুখে মুখে। বছরের শুরুতেই মোজা ইউটিউব চ্যানেলে গানটি প্রকাশিত হয়।


দেওরা : কোক স্টুডিও বাংলায় ৭ মে প্রকাশিত হয় দেওরা গানটি। এই গানটি নতুন করে নিয়ে এসেছেন প্রীতম হাসান এবং লোকসংগীতশিল্পী ইসলাম উদ্দিন পালাকার। গানটিতে আরো রয়েছেন আরমিন মুসা এবং তার কয়্যার ‘ঘাসফড়িং’। গানটি লিখেছেন ফজলু মাঝি [ফজলুল হক] এবং প্রীতম হাসান। গানটির কথায় মাঝিদের আবেগ ফুটে উঠেছে। দেওরা গানটিতে ভিউ হয়েছে ৫ কোটি ৮০ লাখ।


কথা কইও না : কোক স্টুডিওর এ গানটিও দর্শক-শ্রোতাদের কাছে দারুণ প্রশংসা পেয়েছে। গানটিতে কণ্ঠ দেন শিবলু মৃধা ও আলেয়া বেগম। এ গানে আলেয়া বেগমের পারফর্মেন্স বেশ আলোচনায় আসে। ৬ মাস আগে প্রকাশিত হওয়া এই গানটির ভিউ হয়েছে ৪ কোটি ৮০ লাখ।

রাগ কইরো না মনের মানুষ : শিল্পী বিশ্বাসের কণ্ঠে এ গানটির ভিউ প্রায় ৪ কোটি। এই গানটি প্রকাশ করেন শিল্পী তার নিজস্ব ইউটিউব চ্যানেলে। গানটির কথা ও সুর করেছেন কাব্যিক পলাশ, সংগীতায়োজনে ছিলেন ইয়াসিন হোসেন নেরু।

বাজার গরম : ২০২৩-এ দ্রব্যমূল্যের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ে আলী হোসেনের কণ্ঠে র‌্যাপ গান ‘বাজার গরম’ ছিল বেশ আলোচনায়। গানটির বাস্তবতানির্ভর উপস্থাপনা দর্শকের মন কেড়েছে। জি সিরিজের ব্যানারে ৪ মাস আগে গানটি প্রকাশিত হয়। এই গানটির ভিউ হয়েছে ২ কোটি ২০ লাখ।


চোখ লাল কিসে : সংগীতশিল্পী খায়রুল ওয়াসীর কণ্ঠে এ গানটির ভিউ দুই কোটি ৬০ লাখ। এতে শিল্পীর সঙ্গে আরো কণ্ঠ দিয়েছেন কামরুজ্জামান রাব্বি, এম আর মানিক, রাজু ম-ল ও এসডি সাগর। ৩ মাস আগে জোছনালোক মিউজিকের ব্যানারে গানটি প্রকাশিত হয়েছে।


ভুল সবই ভুল : দীর্ঘ বিরতির পর চলতি বছর চমক নিয়ে ফিরেছিলেন নগরবাউলখ্যাত ব্যান্ডসংগীত শিল্পী জেমস। চলতি বছর জেমসের ‘আই লাভ ইউ’ শিরোনামের একটি গান প্রকাশিত হয়। ওই গানটির পর ‘ভুল সবই ভুল’ শিরোনামের আরো একটি গান শ্রোতাদের উপহার দেন তিনি। এই গানটি ইউটিউবে ৭০ লাখের বেশি মানুষ দেখেছে। গানটি লিখেছেন বিশু শিকদার ও জেমস। সুর ও সংগীত করেছেন জেমস নিজে। বসুন্ধরা ডিজিটালের ব্যানারে ৮ মাস আগে গানটি প্রকাশিত হয়েছে।


ওরে জান : জামাল হোসেনের কথায় ইমরান ও মারুফা তৃষার ‘ওরে জান’ গানটিও এ বছর বেশ আলোচিত হয়েছে। ছয় মাসে এটির ভিউ ১ কোটি ৬১ লাখের বেশি। রঙ্গন মিউজিকের ব্যানারে এটি প্রকাশিত হয়েছে।


ওরে মন : ৬ বছর পর আরফিন রুমী ও সাবরিনা পড়শী ‘ওরে মন’ গানের মিউজিক ভিডিও প্রকাশ করেন। পড়শীর ইউটিউবে গানটি প্রকাশিত হয়। কণ্ঠ দেওয়ার পাশাপাশি এ গানের সুর ও সংগীত পরিচালনাও করেছেন আরফিন রুমী। এ গানটির ভিউ প্রায় ৬০ লাখ।


বিদায়ী বছর সিনেমার গানও বেশ সাড়া ফেলেছে

গেল বছর সিনেমার গান নিয়েও স্রোতারা মেতে ছিল। এ বছর সিনেমার গানে সুদিন ফিরে এসেছে এমনটি বলা যায়। ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দে মুক্তিপ্রাপ্ত সিনেমার মধ্যে বেশ কয়েকটি গান আলোচনার শীর্ষে রয়েছে।

এরমধ্যে ‘লিডার আমিই বাংলাদেশ’ মুক্তির পরপরই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল গীতিকবি জাহিদ আকবরের লেখা ‘সুরমা সুরমা’ শিরোনামের গানটি। গানটিতে কণ্ঠ দিয়েছেন ইমরান মাহমুদুল ও কোনাল। সুর ও সংগীত পরিচালনা করেছেন নাভেদ পারভেজ।

২০২৩-এ ভাইরাল হওয়া আরেকটি গান হলো প্রিয়তমা ছবির ‘ও প্রিয়তমা’। ছবি মুক্তি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শ্রোতাদের মাঝে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায় ‘ও প্রিয়তমা’ গানটি। গানটি এখন সবার মুখে মুখে। গানটি রেডিও এবং টেলিভিশনেও শ্রোতাদের পছন্দের শীর্ষে ছিল। সংগীতশিল্পী বালাম এ গানটি গাওয়ার মধ্যে দিয়ে দীর্ঘদিন পর গানে ফিরেছেন। গানটিতে বালামের সঙ্গে কণ্ঠ দিয়েছেন গায়িকা কোনাল। গানটির কথা লিখেছেন আসিফ ইকবাল। সুর ও সংগীত পরিচালনা করেছেন কলকাতার সংগীত পরিচালক আকাশ সেন।

‘প্রিয়তমা’ সিনেমার ‘ঈশ্বর’ শিরোনামের আরো একটি গান শ্রোতাপ্রিয়তা লাভ করেছে। ‘ও প্রিয়তমা’র মতো ‘ঈশ্বর’ গানটি সবার মুখে শোনা যায়। গানটির সুর ও সংগীত পরিচালনা করেছেন প্রিন্স মাহমুদ। অসাধারণ কথামালার গানটি লিখেছেন গীতিকার সোমেশ্বর অলি। এতে কণ্ঠ দিয়েছেন সংগীতশিল্পী রিয়াদ।

২০২৩-এ মুক্তিপ্রাপ্ত ‘প্রহেলিকা’ সিনেমার ‘মেঘের নৌকা’ গানটিও ছিল শ্রোতাদের পছন্দের তালিকায়। গানটির কথা লিখেছেন আসিফ। কণ্ঠ দিয়েছেন কোনাল ও ইমরান। এবছর মুক্তি পাওয়া ‘সুড়ঙ্গ’ সিনেমার গান ‘গা ছুঁয়ে বলো’ জনপ্রিয়তার তালিকায় রয়েছে। বছরের শেষ দিকে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘মুজিব : একটি জাতির রূপকার’ সিনেমার ‘অচিন মাঝি’ গানটিও বহু শ্রোতা পছন্দ করেছেন। ‘অচিন মাঝি’ গানটি লিখেছেন গীতিকবি জাহিদ আকবর।

২০২৩ খ্রিষ্টাব্দে বেশকিছু গান শ্রোতামহলে জনপ্রিয়তা লাভ করার কারণে সিনেমা সংশ্লিষ্টরা প্রত্যাশা করছেন সিনেমার গানেও আবার সুদিন ফিরে আসবে।