‘চোখ যে মনের কথা বলে’... বলা হয়ে থাকে চোখ এমন একটি অঙ্গ যা নাকি মনের কথা বলতে পারে, এদিকে চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয় চোখ-ই মানবদেহের একমাত্র অঙ্গ যা দিয়ে সরাসরি মস্তিষ্কের অংশ দেখা যায়। সে কারণে ত্বক ও চুলের সঙ্গে শীতকালে চোখেরও প্রয়োজন বাড়তি যত্ন। আসুন, শীতকালে চোখের যত্ন , বিভিন্ন রোগ ও তার প্রতিকার সম্পর্কে জানি...
শীতে চোখের যত্ন কেন জরুরি
অনেকেরই মনে হতে পারে গ্রীষ্ম ও বর্ষকালে আমরা যেভাবে চোখের যত্ন নিই, শীতকালে সেভাবে চোখের যতœ নেওয়া জরুরি নয়। কিন্তু এসময়ও প্রয়োজন এক্সট্রা কেয়ার। কারণ এ সময়ে আবহাওয়া থাকে অত্যন্ত শুষ্ক। তাছাড়া শুষ্ক আবহাওয়ার কারণে বাতাসে ধূলাবালিও প্রচুর থাকে এবং সূর্যের ‘আল্ট্রাভায়োলেট রে’ বা ‘অতিবেগুনি রশ্মি’ বছরের অন্যান্য সময়ের তুলনায় শীতকালে মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। তাহলে আসুন, জেনে নিই কীভাবে আমরা শীতকালীন শুষ্ক আবহাওয়ায় আমাদের চোখ রক্ষা করতে পারি।
শীতে চোখের যত্নে করণীয়
রোদচশমা : প্রথমতই আমরা জানি শীতে শুষ্ক আবহাওয়ায় অতিবেগুনি রশ্মি বেশি থাকে। তাই এই অতিবেগুনি রশ্মি থেকে চোখ বাঁচাতে সর্বপ্রথমেই করণীয় হলো বাইরে রোদচশমা বা সানগ্লাস ব্যবহার করা। কারণ, এই অতিবেগুনি রশ্মি নানাভাবে আমাদের দৃষ্টি কমিয়ে দিতে পারে। যেমন- চোখের ছানি পড়া ত্বরান্বিত করা, এমনকি চোখের রেটিনার ক্ষতি করে ‘ম্যাকুলার ডিজেনারেশন’ [macular degeneration] ও করতে পারে।
চোখের আর্দ্রতা : চোখের পানির তিনটি অংশ রয়েছে- লিপিড বা চর্বি, অ্যাকুয়াস বা পানি এবং মিউসিন বা পিচ্ছিলকারক। শীতকালে শুষ্ক আবহাওয়ায় অনেকেরই চোখের পানির এই তিনটি অংশের একটি অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বিশেষ করে যাদের চোখে আগে থেকেই শুষ্কতা বা ‘ড্রাই আই’-এর সমস্যা আছে তাদের এসময়ে এ সমস্যা আরো বেড়ে যায়। চোখের আর্দ্রতা ধরে রাখতে প্রচুর পানি পান করতে হবে। সকালে ঘুম থেকে উঠে ও রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে চোখে পানির ঝাপটা দিতে হবে। বাইরে থেকে এসে চোখ পরিষ্কার করতে হবে। তাছাড়া যারা দীর্ঘক্ষণ ল্যাপটপ, টিভি, মোবাইল দেখে তাদের প্রতি ২০ মিনিট পরপর, ২০ মিনিটের জন্য কমপক্ষে ২০ ফুট দূরে তাকিয়ে থাকতে হবে। এরপরও যাদের চোখের শুষ্কতার সমস্যা থাকবে তারা ‘কৃত্রিম চোখের পানি অথবা আর্টিফিশিয়াল টিয়ার’ ব্যবহার করতে পারেন যা অবশ্যই একজন চক্ষুবিশেষজ্ঞের পরামর্শে ব্যবহার করতে হবে।
শীতে চোখের রোগ
শীতকালে চোখের প্রদাহজনিত সমস্যা ‘এলার্জিক কনজাংটিভাইটিস’-এর প্রকোপ বেড়ে যায়। এ রোগের উপসর্গগুলো হচ্ছেÑ চোখের সাদা অংশ লাল হয়ে যাওয়া, ব্যথা, চোখ দিয়ে পানি পড়া, চোখে হলুদ অথবা সাদা পিচুটি বা ময়লা জমা যা স্বাভাবিকের তুলনায় অতিরিক্ত, ঘুম থেকে উঠে চোখের পাতা খুলতে না পারা ইত্যাদি। এই অবস্থা থেকে বাঁচতে সেসব জিনিস এড়িয়ে চলতে হবে। যেমন, এই রোগটি খুবই ছোঁয়াচে। তাই আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে আসা, একই টাওয়েল ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকতে হবে। চোখে বারবার হাত দেওয়া থেকেও বিরত থাকতে হবে। এ রোগে আক্রান্ত হয়ে গেলে অতিদ্রুত একজন চক্ষুবিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে হবে।
শীতকালেও যারা ‘কন্টাক্ট লেন্স’ পরেন তাদের নিতে হবে বাড়তি সতর্কতা। অবশ্যই ভালো কোম্পানির ভালো মানের কন্টাক্ট লেন্স পরতে হবে। এক্সপায়ার ডেট পার হওয়ার পর কোনোভাবেই কন্টাক্ট লেন্সটি আর পরা যাবে না। প্রতি দুইদিন অন্তর অন্তর কন্টাক্ট লেন্সের পানি পরিবর্তন করতে হবে। তাছাড়া সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো প্রতিবার কন্টাক্ট লেন্স পরার সময় ও খোলার আগে ভালোভাবে হাত ধুয়ে পরিষ্কার করে নিতে হবে। মেয়েদের ক্ষেত্রে সাজগোজের সময় সাজার শুরুতে ও খোলার ক্ষেত্রে মেকাপ মুছে ফেলার আগে কন্টাক্ট লেন্স খুলতে হবে। তাছাড়া কন্টাক্ট লেন্স পরে কখনোই আগুনের কাছে যাওয়া যাবে না। এ কয়টি বিষয় খেয়াল রাখলে চোখের অনেক সমস্যা এড়ানো সম্ভব। এছাড়া আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট হলো কখনোই ৫-৬ ঘণ্টার বেশি কন্টাক্ট লেন্স পরে থাকা যাবে না ও এটি পরে ঘুমানো যাবে না।
অতএব, শুধু ত্বক আর চুল নয়, শীতে আমরা চোখেরও যত্ন নেব। সর্বোপরি পুষ্টিকর খাবার খেতে হবে চোখ ভালো রাখতে হলে। বিভিন্ন শীতকালীন সবজি যেমন ফুলকপিতে রয়েছে চোখের জন্য প্রয়োজনীয় বিভিন্ন ভিটামিন। তাছাড়া চোখের পুষ্টির ‘পাওয়ার হাউজ’ বলা হয় মিষ্টিকুমড়াকে। এছাড়া সামুদ্রিক তৈলাক্ত মাছের ওমেগা-থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড চোখের জন্য খুবই উপকারী। আমরা খাদ্যাভাস পরিবর্তন ও সহজ কিছু নিয়ম মেনে খুব সহজেই চোখের যত্ন নিতে পারি।
মডেল : ইভা আফরোজ
লেখক : এমবিবিএস, এমএস [ফেইজ-বি], চক্ষুবিদ্যা বিভাগ, বারডেম জেনারেল হাসপাতাল