ইউরোপের ১৫০ দিন -সৈয়দা তাসলিমা আক্তার

13 Feb 2024, 12:52 PM ভ্রমন শেয়ার:
ইউরোপের ১৫০ দিন  -সৈয়দা তাসলিমা আক্তার

[পূর্ব-প্রকাশিতের পর]


ল্যু’ভর মিউজিয়াম ট্যুরটি ছিল সারাদিনের। সকালে নাশতা খেয়ে বেরিয়েছিলাম, সাথে টুকটাক খাবারও নেওয়া হয়েছিল। আর বলা বাহুল্য, মিউজিয়ামে ঘোরা মানে অনেক পরিশ্রম, পুরো সময় দুই পায়ের ওপর ভর করে চলা। খিদা লাগাই স্বাভাবিক। মিউজিয়ামের ভেতরে যেহেতু খাবারের কোনো ব্যবস্থা নেই, তাই সঙ্গে আনা খাবারই আপাতত ভরসা। সকাল দুপুর গড়িয়ে বিকেল কিন্তু আর পোষালো না, পেট তখন মানবে না আর কোনো অজুহাত- এই পর্যয়ে চলে গেছে। বাধ্য হয়ে আমরা খাবারের খোঁজে বের হলাম। মিউজিয়ামের ভবন লাগোয়া একটি ভবন, যার ভেতরের অংশ বেশ অত্যাধুনিক, এখানে রয়েছে শপিং প্লেস আর ফুড কোর্ট, আমার মনে হলো যেন কোনো নাট্যমঞ্চের পেছনের দরজা দিয়ে বের হয়ে আমরা সেখানে পৌঁছুলাম। অন্ধকার একটি পথ বেশ খানিকটা হেঁটে আলো ঝলমলে ফুড কোর্ট। সেখানে প্রচণ্ড ভিড়, পাঁচ জনের একসাথে বসার সিট পেতে সময় লাগল, এরপর হালাল খাবারের দোকান খুঁজে নিয়ে খাবার অর্ডার করে প্রায় আধঘণ্টাা তীর্থের কাকের মতো অপেক্ষা, পেটের মধ্যে খিদায় যেন ইঁদুর-বেড়াল রেস চলছে। যাহোক অবশেষে খাবারের ডাক এলো, আমার কাজিন আর ভাতিজা টোকেন দিয়ে খাবার নিয়ে এলো। খেতে বসে যেন খিদে আরো চনমনিয়ে উঠলো, খাওয়ার পাট চুকিয়ে কিছু সময় সেখানেই জিরিয়ে নিলাম। এরপর আবার কিছু সময় আমরা মিউজিয়ামের ভেতরে উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘোরাঘুরি করে সন্ধ্যার সমাপ্তি ঘটিয়ে ঘরে ফিরে এলাম।

ইউরোপের আবহাওয়ার মেজাজ আমার কাছে বেশ জটিল মনে হয়, স্বাভাবিকভাবেই এ সময় তাপমাত্রা কম থাকবে, তাই বলে সূর্যের সঙ্গে সকল সম্পর্ক ছেদ করতে হবে এ আবার কেমন কথা। গত দিনতিনেক ধরে এমনই হচ্ছে সকাল-দুপুর আর সন্ধের ফারাক ঘড়ির কাঁটায় বুঝে নিতে হচ্ছে, সূর্যের যে কার সাথে এতো অভিমান বোঝাই দায়, তার ওপর ছিচকাঁদুনে আকাশ অকারণে কেঁদেই চলেছে। আকাশের কান্না খানিকটা ধরে এলে এক বিকেলে আমি আর ইরফান [ভাতিজা)] একটু বের হলাম হাত-পায়ের জং ছাড়ানোর জন্য। টানা ঘরে শুয়ে-বসে থেকে হাতে পায়ে জং-ই ধরে যাচ্ছিল, খুব দূরে কোথাও না, কাছেই শহররের উপকন্ঠে মন্টমার্ত্রে [montmartre] নামের একটি জায়গায়। মন্টমার্ত্রে মূলত প্যারিসের একটি উঁচু পাহাড়, এটি ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক ও সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে বেশ বিখ্যাত। saint pieree de montmartre একটি মর্যাদাপূর্ণ গির্জা, যা ১১৪৭ খ্রিষ্টাব্দে মন্টমার্ত্রে পাহাড়ের চূড়ায় নির্মাণ করা হয়। ১৫৯০-এ ফরাসি ধর্মযুদ্ধের সময় এখানে একটি সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করা হয়, পরবর্তীসময়ে ফরাসি বিপ্লবের সময় এখানকার সকল স্থাপনা ধ্বংস করা হয়। অবশ্য পরে গির্জাটি পুণঃনির্মাণ ও সংস্কার করা হয়। এর সামরিক গুরুত্বও কম নয়, ১৮১৪ খ্রিষ্টাব্দে প্যারিস যুদ্ধের সময় রাশিয়ান সৈন্যরা এটি দখল করে। উঁচুতে অবস্থান হওয়ায় পুরো শহরকে নজরদারীর আওতায় আনা এবং শহরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় বোমা নিক্ষেপের জন্য এটি একটি উপযোগী স্থান ছিল।

উনিশ শতকের শেষ দিক থেকে শুরু করে বিশ শতকের গোড়ার দিকে এখানে বরেণ্য চিত্রকরদের আনাগোনা ছিল। বিখ্যাত চিত্রশিল্পী পাবলো পিকাসো, ক্যামিল পিসারো, পিয়ের অগ্যুস্ত রনোয়ার, এডগার দেগাস এবং ভিনসেন্ট ভ্যান গগ-এর মতো বিখ্যাত সব চিত্রকরদের বসবাস ছিল এই মন্টমার্ত্রে। যেখানে এখন পাবলো পিকাসোর স্মৃতি সংরক্ষণাগার রয়েছে, রয়েছে বেশ কিছু আর্ট স্টুডিও, এছাড়া রয়েছে আড্ডা দেওয়ার জন্য উন্মুক্ত চত্বর। এর আবহ এখন অনেকটা আমাদের নাটক সরণির [বেইলি রোড] মতো অথবা বলা যায় চারুকলার আশপাশ নিয়ে যেমন একটা পরিবেশ। উঠতি কবি-সাহিত্যিক বা চিত্রশিল্পীদের কাছে এটি অনেকটা তীর্থস্থানের মতো আর যারা শিল্প-সাহিত্য ভালোবাসে তাদের কাছেও মন খুলে আড্ডা দেওয়ার জন্য জায়গাটি বেশ জনপ্রিয়। এখানে পাহাড় আর সমতলের মিশ্রণে পুরো এলাকাটিই যেন শিল্পীর তুলিতে আঁকা এক ছবি। আমরা যখন মন্টমার্ত্রে পৌঁছি তখন সময় সন্ধ্যা ছুঁঁইছুঁই, তাই আমরা সরাসরি অনেক সিঁড়ির ধাপ অতিক্রম করে পাহাড়চূড়ায় উঠে যাই, ইচ্ছে ছিল সেখান থেকে সূর্যাস্ত দেখার, যদিও ইচ্ছেপূরণ হয়নি। কারণ, সূর্য তখন বাড়ির পথে অনেকটা এগিয়ে গেছে আমরা শুধু পড়ন্ত বেলার রক্তিম আভাটুকু পেলাম, তাও-বা কম কীসে ! এক অপার্থিব কমলা আলো যার রেশ রয়ে গিয়েছিল অনেকক্ষণ। এখান থেকে পুরো প্যারিস শহর পাখির চোখে ধরা দেয়, যদিও আলো নিভু নিভু তারপরও যতটুকু পারলাম পাহাড়ের উচ্চতা থেকে দেখে নিলাম। সেখানে এখনো saint pieree de montmartre সগৌরবে দাঁড়িয়ে আছে। এর পাশাপাশিই স্বেতশুভ্র রূপ নিয়ে শুভ্রতা ছড়াচ্ছে মন্টমার্ত্রের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় উপাসনালয় ‘পবিত্র হৃদয়’ [Sacré Coeur de Montmartre] এটি মন্টমার্ত্রের মনমাতানো স্থাপনা। কথিত আছে, ১৮৭০ খ্রিষ্টাব্দে ফ্রান্সের পরাজয়কে ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে ফরাসি বিপ্লবপরবর্তী ফ্রান্সের নৈতিক অবক্ষয়কে চিহ্নিত করে যিশুর পবিত্র হৃদয়কে উৎসর্গ করে এই নতুন প্যারিসীয় গির্জা নির্মাণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। পরবর্তীসময়ে ১৮৭৫ খ্রিষ্টাব্দে এর নির্মাণ কাজ শুরু হয়, প্রায় চল্লিশ বছর ধরে চলতে থাকা এর নির্মাণ কাজ শেষ হয় ১৯১৪ খ্রিষ্টাব্দে। ১৯১৯-এ এটি উপাসনার জন্য উন্মুক্ত করা হয়। এর অন্য নাম Sacré-Cœur Basilica, এটি প্যারিসের দ্বিতীয় জনপ্রিয় পর্যটক-গন্তব্য। পুরো সন্ধ্যা আমরা Montmartre চূড়ায় কাটিয়ে নিচে নেমে এলাম। উপর থেকে বোঝার উপায় নেই যে, এর ধাপে ধাপে রয়েছে কত বৈচিত্র্য। নান্দনিক সব প্রাসাদসদৃশ বাড়ি, মানে আস্ত এক জনপদ পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে গেঁথে আছে। পথ চলে গেছে উপর থেকে নিচে, যাতায়াতের সুবিধার জন্য রয়েছে সিঁড়ির ব্যবস্থা, ইট পাথরের পথ যে নেই তা না। তবে, সেগুলো দিয়ে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে যান্ত্রিক বাহন চলাচল করে। আমরা খানিকক্ষণ সিঁড়ির ধাপে ধাপে হেঁটে বের হলাম, এরপর একটি সিঁড়ি ধরে অনেক নিচে চলে গেলাম, মনে হলো যেন অন্য কোনো জগতে চলে এসেছি। পথ কোথায় গিয়ে শেষ তা যেন অজানা, চাঁদের মেটে আলোয় চারদিক যেন রূপকথার রাজ্য। অচেনা পথে খুব বেশিক্ষণ কিন্তু ভালো লাগে না তাই আবার চেনা পথে ফিরে এলাম। যে পথে একসময় হেঁটেছেন ভ্যান গগ, পাবলো পিকাসো, হাঁটতে হাঁটতে আমরা পৌঁছে গেলাম মুসি ডি মন্টমার্ত্রে [Musée de Montmartre], কোনো একসময় এই ভবনে চিত্রশিল্পী পিয়ের অগ্যুস্ত রনোয়ার, সুজান ভ্যারাদন-সহ বিশ্ববরেণ্য চিত্রশিল্পীগণ বাস করতেন। তাদের এই স্মৃতি ধরে রাখতেই ভবনটিকে মিউজিয়ামে রূপান্তর করা হয়। তিন শতাব্দী পুরানো এই মিউজিয়ামে সংরক্ষিত আছে বিখ্যাত সব পেইন্টিং, ফটোগ্রাফ, পোস্টার এবং পাণ্ডুলিপি। রাত্রি তখন বোধ করি ন’টা হবে, স্বাভাবিকভাবেই সেখানে প্রবেশের সুযোগ নেই। তবে, বিশাল কাচের দরজা দিয়ে আবছা আলোয় যতটুকু দেখা সম্ভব তাই দেখার চেষ্টা শেষে সেখানে খানিকটা সময় এমনি কাটিয়ে দিলাম। 

শীতের রাত কনকনে বাতাস। এর মধ্যে দিয়ে আঁকাবাঁকা উচু-নিচু পথে হাঁটতে মন্দ লাগছে না। আগেই বলেছি, এ এলাকায় বেশ কিছু আর্ট স্টুডিও আছে, যার প্রায় সবকটিতেই আলো জ্বলছে, রাস্তার নিয়ন বাতিগুলো একটা টিমটিমে আলো ছড়াচ্ছে ; দু’পাশে সুভ্যেনির দোকানগুলো তখনো তাদের সাজের পসরা খুলে রেখেছে, কোথাও কোথাও নিচু স্বরে গান বাজছে। যদিও গানের সুর ও শব্দ দুটোই অচেনা কিন্তু শুনতে বেশ লাগছে। অচেনা সুরে রেশ কানে নিয়ে আমরা হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে গেলাম বুলেভার্ড দে ক্লিচি (Boulevard_de_Clichy) রোডে, আমরা আসলে ফিরতি পথে চলছিলাম, আমাদের মেট্রো ধরতে হবে তাই এখানে আসা। তবে এই সাবওয়েতে ঢুকার মুখে বাড়তি পাওনা হিসেবে দেখা হলো মুলাঁ রোজ (Moulin Rouge) নামের স্থাপনাটি, এটি একটি উইন্ড মিল যা রেড মিল নামে পরিচিত। এটি একটি ক্যাবারেট, মুলাঁ রোজ ক্যাবরেটটি মূলত ক্যান ক্যান নাচের জন্য বিখ্যাত। মূলত নাচের এ ধরন এবং ক্যাবারেটকে ইউরোপব্যাপী জনপ্রিয় করে তুলছে মুলাঁ রোজ। এটি সংগীত-নৃত্য পিয়াসী পর্যটকদের কাছে বেশ আকর্ষণীয় একটি স্থান। এখানে মজার ব্যাপার আছে, সেটি হচ্ছে ১৯৫৫ খ্রিষ্টাব্দে মারলিন মনরো [Marilyn Monroe] অভিনীত The Seven Year Itch মুভিতে মারলিন মনরো সেই বিখ্যাত পোজ, যেখানে তিনি একটি সাদা গাউন পরে সাবওয়ের ঝাঁঝরির উপর দাড়িয়ে ছিলেন, চলন্ত ট্রেনের বাতাসে তার গাউন উড়ে যাচ্ছে আর তিনি প্রাণপণে তা ধরে রাখার চেষ্টা করছেন। এই সাবওয়েতে এমনি একটি ঝাঁঝরি আছে, পর্যটকরা বিশেষ করে রমণীরা চাইলে গাউন উড়িয়ে মারলিন মনরো পোজে ছবি তুলতে পরেন। তবে ডিসেম্বরের এই কনকনে শীতে সে চেষ্টা না করাই ভালো। [চলবে]