মেহেদির রঙে রঙিন উৎসব

21 Apr 2024, 12:56 PM ফিচার শেয়ার:
মেহেদির রঙে রঙিন উৎসব

প্রাচীনকাল থেকেই বিয়েসহ বিভিন্ন উৎসবে মেহেদির নানাবিধ ব্যবহার প্রায় সকলেরই জানা। মেহেদির নাম শুনলেই কেন যেন একটা উৎসব উৎসব আমেজ চোখে-মুখে ফুটে ওঠে। মেহেদির সুন্দর নকশায় হাত রাঙানো ছাড়া কোনো উৎসব উদ্যাপনই যেন শতভাগ পরিপূর্ণতা পায় না। তাই বহুকাল আগে থেকেই যেকোনো ধর্মীয় উৎসব বিয়ে-শাদিসহ বিভিন্ন পালাপার্বণে মেহেদির ব্যবহার হয়ে আসছে। মেহেদির রং-রূপ-বিভা ও ব্যবহার নিয়ে বিস্তারিত লিখেছেন শহিদুল ইসলাম এমেল...

মেহেদির ইতিহাস

পৃথিবীর নানান জায়গায় খুঁজে পাওয়া বিভিন্ন ধরনের ফসিল নৃবিজ্ঞানিরা প্রতœতাত্ত্বিক গবেষণার মাধ্যমে নিশ্চিত হয়েছেন প্রায় ১৫ হাজার বছর আগে নর-নারীরা প্রকৃতির বিভিন্ন ধরনের উপাদান দিয়ে অঙ্গসজ্জা করে তাদের রূপ-সৌন্দর্য বৃদ্ধি করতেন। কেউ কেউ আবার শরীরে সুঁই ফুটিয়ে স্থায়ীভাবে অলঙ্করণ করতেন, যাকে আমরা ট্যাটু বলি। ছেলেমেয়েরা এই ট্যাটু করতেন মূলত দুটি কারণে। একটি হচ্ছে অঙ্গসজ্জা বৃদ্ধি করার জন্য অন্যটি হচ্ছে নিজের পরিচিতির জন্য।

পৃথিবীর সভ্যতার ইতিহাস যদি ধরা হয় ৫ হাজার বছর তাহলে মেহেদির ইতিহাস এর থেকেও পুরানো। লিওলিথিক বা নবপ্রস্তর যুগ [১০০০০-৪০০০ খ্রি.পূ.] থেকে মেহেদির প্রথম ব্যবহার করতে দেখা যায় উত্তর আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন মরু অঞ্চলে। মরুবাসীরা প্রায় ৯ হাজার বছর আগে প্রচ- গরম থেকে বাঁচার জন্য তাদের পা মেহেদি পেস্ট দিয়ে প্রলেপ দিয়ে রাখতেন। এই প্রলেপের কারণে সারা শরীরই ঠান্ডা থাকতো। বিশেষ করে যারা যুদ্ধ করতেন তাদের মধ্যে এই প্রচলন বেশি ছিল।

এরপর তারা যখন লক্ষ্য করলো মেহেদি শুকিয়ে উঠে গিয়ে চমৎকার একটি রং ধারণ করেছে সেটা দেখে তারা আরো অবাক হয়ে যায়। এরপর থেকেই মূলত শুরু হয় অঙ্গসজ্জায় মেহেদির ব্যবহার। সে সময় ওই অঞ্চলগুলোতে ৪টি প্রধান সভ্যতা গড়ে উঠেছিল। মিশরীয় সভ্যতা, ব্যাবিলনীয় সভ্যতা, সুমেরীয় সভ্যতা এবং এসিরিয় সভ্যতা। সেগুলোতে রঞ্জন হিসেবে মেহেদির ব্যবহার দেখতে পাওয়া যায়। চিত্রকলার ইতিহাস বিশেষজ্ঞ মার্কিন অধ্যাপক ড. মেরিলিন সিভিটেনিকের মতে গত পাঁচ হাজার বছর ধরে আরববিশ্বে মেহেদি স্বাস্থ্য, সৌভাগ্য আর কামোদ্দীপনার প্রতীক হিসেবে সমাদৃত। এছাড়া দক্ষিণ চীনে প্রায় ৩ হাজার বছর ধরে প্রাচীন দেবী সংস্কৃতির সময় থেকে মেহেদি প্রেম-ভালোবাসাসহ বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানের সঙ্গে ব্যাপকভাবে যুক্ত রয়েছে। প্রাচীন মিশরের হাসি-আনন্দ ও ভালোবাসার প্রতীক রানি নেফারতিতি [খ্রি. পূ. ১৩৭০-১৩৩০] ও ইতিহাসের সর্বকালের সেরা সুন্দরী ও আবেদনময়ী রানি ক্লিওপেট্রা [খ্রি. পূ. ৬৯-৩০] নিয়মিত মেহেদি ব্যবহার করতেন। তার কন্যা সেলেনাও মেহেদির বিভিন্ন রকমের ব্যবহার জানতেন। এছাড়া মিশরের পিরামিডে ফারাও স¤্রাটদের মমিতে মেহেদি ব্যবহার করা হতো। মধ্যযুগীয় কিছু চিত্রকলায় দেখা যায় কিং সলোমানের সঙ্গে রানি সেবা যখন দেখা করতে যেতেন তখন তিনি মেহেদি পরতেন। ভারতের অজন্তা গুহাচিত্রেও মেহেদির ব্যবহার দেখা গেছে। উপমহাদেশে ১২ শত খ্রিষ্টাব্দ থেকে মেহেদির বিভিন্ন রকম ব্যবহার শুরু হয় এবং মোঘল আমল থেকে প্রাকৃতিক প্রসাধনী হিসেবে মেহেদির ব্যবহার ব্যাপকভাবে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে যার কারণে মেহেদির চাহিদা বেড়ে যায়।

জানা যায়, মোঘল সম্রাট শাহজাহান পতœী মমতাজকে মিশরের রাজা রাষ্ট্রীয় উপহার হিসেবে মেহেদি ও মেহেদির চারা উপহার দিয়েছিলেন। প্রায় ১ হাজার ৫ শত বছর ধরে মুসলিম নারীরা মেহেদি পরার মাধ্যমে নিজের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে আসছে। আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ [সা.] মুসলিম নারীদের হাতে মেহেদির নকশা করাকে উৎসাহিত করতেন। নবীজির কন্যা ফাতেমা [রা.] নিয়মিতভাবে হাতে মেহেদির নকশা করতেন। নবীজি নিজেও তার দাড়িতে মেহেদি লাগাতেন। ইসলামি খেলাফতের সময় থেকেই মুসলিম বিশ্বে ধর্মীয় রীতি হিসেবে মেহেদির ব্যবহার প্রতিষ্ঠা পায়।


মেহেদির পরিচিতি

বিভিন্ন জয়গায় মেহেদির রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন নাম। বাংলা শব্দ মেহেদি, কোথাও মেদি আবার কোথাও মেন্দি, কোথাও মৌকা নামে আমাদের দেশে পরিচিত। বাংলাসাহিত্যে নিরি মুল্লকা, মদয়ন্তিকা, গিরিমল্লিকা, নখ রঞ্জিকা, বনমল্লিকা নামে মেহেদির বেশ কিছু কাব্যিক নাম পাওয়া যায়। এছাড়া হিন্দি ও উর্দুতে মেহেন্দি, ইংরেজিতে হেনা, মধ্যপ্রাচ্যে হেন্না, মধ্য এশিয়ায় আল-খান্না নামে পরিচিত। মেহেদির আরবি শব্দ আল-হিন্না। মেহেদির ইউনানী নাম হেনা, আয়ুর্বেদিক নাম মদয়ন্তিকা, বোটানিক্যাল নাম লসোনিয়া ইরামিস। যা লেসরেসিয়া পরিবারের অন্তর্ভুক্ত। মেহেদি গাছ গুল্ম বা ছোটো বৃক্ষ প্রজাতির সপুষ্পক উদ্ভিদ। মেহেদি গাছ ঘন শাখা ও পাতাবিশিষ্ট। মেহেদি গাছের উচ্চতা সাধারণত ২ থেকে ১০ ফুট পর্যন্ত হয়ে থাকে। পাতাগুলো সুন্দরভাবে সাজানো থাকে। পাতার উপরিভাগ সুঁচালো। মেহেদি পাতায় বিশেষ ধরনের একটি গন্ধ পাওয়া যায়। এর কা- ছোটো এবং আংশিক কাঁটাযুক্ত। ছোটো ছোটো ফুল গুচ্ছাকারে ফোটে। ফুলের রং হালকা হলুদ, সাদা বা হালকা গোলাপি। ফুলের পাপড়িগুলো ভাজবিশিষ্ট। পুংকেশরগুলো থাকে জোড়ায় জোড়ায় সাজানো। মেহেদির ফল আকারে মটর দানার সমান এবং ধূসর বর্ণের হয়ে থাকে। ফলের মধ্যে ছোটো ছোটো প্রায় ৮০ থেকে ৯০ টির মতো বীজ থাকে।


মেহেদির ব্যবহার

মেহেদির ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায় ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে মেহেদির ব্যবহার শুরু হয়েছিল। বর্তমানে মেহেদির ব্যবহার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রথা হিসেবে সারাবিশ্বে পরিচয় লাভ করেছে। ইসলামসহ পৃথিবীর প্রায় সব ধর্মেই মেহেদির পবিত্রতা, ঔষধিগুণ এবং মেহেদির বহুল ব্যবহারের কথা উল্লেখ রয়েছে। বিশেষ করে ভারতীয় উপমহাদেশ যেমন, বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানে ব্যাপকভাবে মেহেদির ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। আমাদের দেশে মেহেদির ব্যবহার কতটুকু গুরুত্বপূর্ণ সেটা বিয়ে, ঈদ, পূজা, বৈশাখসহ বিভিন্ন উৎসব অনুষ্ঠানের সময় বোঝা যায়। বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বহু দেশে এটিকে উৎসবের একটি অবিচ্ছেদ্য অনুষঙ্গ মনে করা হয়। বহুকাল থেকেই পারিবারিক ও সামাজিক বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে মেহেদির নানাবিধ ব্যবহার হয়ে আসছে। এছাড়া চীনসহ দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশেই ইউনানী, আয়ুর্বেদীসহ বিভিন্ন প্রকার অর্গানিক চিকিৎসায় ব্যবহার হয়ে থাকে মেহেদি।


যুগে যুগে মেহেদির ডিজাইন

যুগে যুগে মেহেদির ডিজাইনে পরিবর্তন এলেও মেহেদির নজরকাড়া সুন্দর কারুকার্যশোভিত আকর্র্ষণীয় ডিজাইনের আবেদন কিন্তু কখনোই কমেনি। কে মেহেদি পরতে পারবে আর কে পারবে না এমন কোনো বিধিনিষেধ নেই। শিশু থেকে বৃদ্ধ সব বয়সের মানুষই মেহেদি পরতে পারে। তবে, বয়সের কথা চিন্তা করে ডিজাইনেও ভিন্নতা থাকা খুবই দরকার। মুসলিম, হিন্দু, খ্রিষ্টান, বৌদ্ধ, ইহুদি, শিখসহ বিভিন্ন ধর্ম এবং সংস্কৃতিতে মেহেদির বিভিন্ন ডিজাইনের আলাদা অর্থ রয়েছে।


বাজারে টিউব মেহেদি

বহুকাল আগে থেকে বিভিন্ন উৎসবে মেহেদির পাতা ভালো করে বেটে তা হাত এবং পায়ের নখ ছাড়াও হাতের তালুতে লাগানো হতো। মেহেদির পাতা বেটে ব্যবহার করা এখনো আমাদের সমাজে বেশ জনপ্রিয়। গ্রামগঞ্জে অনেকেই মেহেদির পাতা পাটায় বেটে ব্যবহার করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। বর্তমানে বাজারে বিভিন্ন কোম্পানির টিউব মেহেদি সহজেই পাওয়া যাওয়ায় মানুষ টিউব মেহেদির দিকেই দিন দিন বেশি আগ্রহী হয়ে উঠছে। তারা মেহেদি বাটার ঝামেলা এড়াতে বাজারে টিউবের মেহেদি কিনে লাগাতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। বর্তমানে বাজারে দুই ধরনের মেহেদি কিনতে পাওয়া যায়। তার একটি হলো তৈরি করা বা ইনস্ট্যান্ট মেহেদি, সেটা লাগানোর ৫ মিনিটের মধ্যেই রং হয়ে যায়। তবে প্রতিবার ধোয়ার সঙ্গে সঙ্গে রং উঠতে থাকে। আরেকটি হলো প্রাকৃতিক বা অর্গানিক মেহেদি। অর্গানিক মেহেদি যেকোনো উৎসবে ব্যবহার করা ত্বকের জন্য সবচেয়ে ভালো। অর্গানকি মেহেদি হাতে তৈরি করা হয়ে থাকে, যার কারণে এই মেহেদিতে রাসায়নিকের ব্যবহার একেবারেই থাকে না। এটা ত্বকের ক্ষতি করে না। রং হয় গাঢ় এবং দীর্ঘস্থায়ী।


মেহেদি ব্যবহারে কিছু টিপস

ষ অনেকেই মেহেদি লাগানের আগে হাত ভালোভাবে ধুয়ে পরিষ্কার করে নেন না। যার কারণে হাতে মেহেদির রং শতভাগ আসে না। মনে রাখতে হবে মেহেদি লাগানোর আগে অবশ্যই হাত ভালো করে ধুয়ে ময়লা পরিষ্কার করে শুকিয়ে নিতে হবে। যে স্থানে মেহেদি লাগানো হবে সেই স্থানে ময়েশ্চারাইজার বা লোশন জাতীয় কিছু লাগানো যাবে না।

ষ মেহেদি রাতে লাগিয়ে সকালে তুলে নিলে রং বেশি গাঢ় হবে। আমাদের দেশে ঈদের আগের রাতে মেহেদি লাগানোর রীতি রয়েছে।

ষ অনেকেরই বিভিন্ন জিনিসে এলার্জি আছে। তাই টিউব মেহেদি লাগানোর আগে একটু লাগিয়ে দেখে নিতে পারেন এলার্জি হয় কি না। যদি না হয় তাহলে নিশ্চিন্তে মেহেদি দিয়ে আপনার হাত রাঙিয়ে তুলুন। বাজারে নামিদামি ব্র্যান্ডের টিউবের পাশাপাশি কিছু নি¤œমানের টিউব পাওয়া যায়। সেগুলো এড়িয়ে চলুন।

ষ যদি দেখেন মেহেদি লাগানোর পরপরই উঠে যাচ্ছে তাহলে লেবুর রস ও চিনি গোলা পানি তুলোয় ভিজিয়ে মেহেদির প্রলেপের উপর আলতো করে লাগিয়ে দেবেন। এতে পেস্ট ঝরে পড়বে না, অনেকক্ষণ লেগে থাকবে।

ষ অনেকে মেহেদি লাগিয়ে কিছুক্ষণ পরই তুলে ফেলেন কাপড়ে লাগার ভয়ে। এটা করবেন না। মেহেদি লাগিয়ে অন্তত ১ থেকে ৪ ঘণ্টা রেখে দিন। পুরো পেস্ট শুকিয়ে যাওয়ার পর ভোঁতা ছুরি বা চামচ দিয়ে তুলে ফেলুন।

ষ মেহেদি উঠানোর পরে হাতে একটু চিনি গোলা পানি লাগিয়ে নিলে মেহেদির রং ভালো হয়। এরপর কিছুক্ষণ সাবধানে আগুনে হাত শুকিয়ে নিন। হাত পুরোপুরি শুকিয়ে গেলে হাতে সরিষার তেল মেখে নিন। যদি সম্ভব হয় তাহলে পরবর্তী ৪ থেকে ৬ ঘণ্টা হাতে পানি লাগাবেন না। সাবান পানি থেকে হাত যতটা দূরে রাখবেন ততই ভালো।

ষ চুলে মেহেদি লাগানোর আগে অবশ্যই চুলে ভালো করে শ্যাম্পু করে শুকিয়ে নিতে হবে।

ষ বাজারে অনেক ব্রান্ডের মেহেদি পাওয়া যায়। তাই বাজার থেকে অবশ্যই একটি ভালো মানের এবং মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখ দেখে তারপর কিনবেন। ছবি : সংগ্রহ