একটি রচনা বিষয়ক রচনা

21 Apr 2024, 01:02 PM ফিচার শেয়ার:
একটি রচনা বিষয়ক রচনা

নারীদের সংগ্রাম আর বাধা ডিঙিয়ে বেঁচে থাকার গল্প শোনেন নিয়মিত রচনা ব্যানার্জি। শোনেন কোন প্রেরণায় এগিয়ে চলেছেন তারা। রচনা নিজেও হয়ে ওঠেন কখনো কখনো সেই নারীদের অনুপ্রেরণা। এইসব গল্প শোনার আর নানারকম খেলার আয়োজন নিয়ে প্রতিদিন জি-বাংলায় হাজির হন রচনা ব্যানার্জি। অনুষ্ঠানের নাম দিদি নাম্বার ওয়ান। ঈদ আনন্দ-আয়োজনে আজ শুনবো এই দিদির নিজের সফলতা-ব্যর্থতা তথা একজন রচনা ব্যানার্জি হয়ে ওঠার গল্প।

বাই দ্য পিপল, ফর দ্য পিপল

রচনা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এখন এটাই সবচেয়ে গরম খবর লোকসভার নির্বাচনের প্রার্থিতা। ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দে লোকসভা নির্বাচনে হুগলি কেন্দ্র থেকে তৃণমূল দল থেকে প্রার্থী হয়েছেন তিনি। নিজ দলকে জেতানোর জন্য দলের প্রার্থী হয়ে ব্যস্ত সময় পার করছেন। তাহলে এতদিনের রচিত ক্যারিয়ারের কি এখানেই ঘটবে ইতি ? দিদি নাম্বর ওয়ানে দর্শক দেখবে রচনার জায়গায় অন্য কোনো নতুন মুখ ? রচনা ব্যানার্জি এটা মানতে রাজি নন। বলেন, ‘একটু ক্ষতিগ্রস্ত হবে হয়ত, তবে দিদি নাম্বার ওয়ান চলবে। রাজনীতি মানে প্রচারের ফাঁকে-ফাঁকে রাতে এসে শুটিং করতে হবে- এই আর কি।’


একজন দিদি নাম্বার ওয়ান

কথায় বলে- যে রাঁধে, সে চুলও বাঁধে। অর্থাৎ যে কর্মঠ এবং দায়িত্বের প্রতি আন্তরিক, সে সব কাজেই পারদর্শী। এত বছর যে ব্যক্তি কাগজের পৃষ্ঠায় লেখা সংলাপ পড়ে বুঝতে চেষ্টা করে গেছেন অদেখা সেইসব চরিত্রের দুঃখ, বেদনা, কষ্ট, বাসনাকে- আপন কল্পনায় গড়ে তুলেছেন একেকটি চরিত্রকে, ফুটিয়ে তুলেছেন অভিনয়ের মধ্য দিয়ে রঙিন পর্দায়, আর হাসিয়েছেন, কাঁদিয়েছেন, প্রেমে আপ্লুত করেছেন দর্শক হৃদয়কে, এবার সরাসরি নানা মানুষের কাছে গিয়ে তাদের দুঃখ মোচানোর সাধ তার মনে জাগতেই পারে।

অভিনয় থেকে দূরে থেকেছেন অনেকদিন। এরপর আপন করে নিলেন টেলিভিশনের জনপ্রিয় অনুষ্ঠান দিদি নাম্বার ওয়ানের প্লাটফর্মকে। কিন্তু তাই বলে রাজনীতির মাঠে নেমেও নিজের সেই পোডিয়ামটির মায়া ছাড়তে কি তিনি পারবেন এত সহজেই ? যেই স্থানে এসে দাঁড়ালেই সকলের আপন দিদি হয়ে ওঠেন তিনি। দূরদূরান্ত থেকে আসা মেয়েরা- নানা বয়সের, নানা পেশার, নানা যুদ্ধক্ষেত্রের যুদ্ধাহত নারীগণ অকপটে মন খুলে দেন দিদির কাছে এসে। কেঁদে-হেসে, গর্বিত হয়ে, নিজেকে খুঁজে পেয়ে নতুন আত্মবিশ্বাসে দিদির কাছ থেকে বিদায় নেন সেই নারীগণ। এই যে এত মানুষের ভালোবাসা আর শ্রদ্ধার যে জায়গাটা- তা সত্ত্বেও উষর রাজনীতির মাঠে দাপিয়ে বেড়াতে চান তিনি। কিন্তু কেন ? রচনা বলেন, ‘আমার সব সময় মনে হতো যে, আমি শুধু শুনছি। কিছু করে উঠতে পারছি না। সেটা করতে গেলে একটা জায়গা দরকার, সেটা রাজনীতি ছাড়া অন্য কিছু হতেই পারে না।’

২০১১ খ্রিষ্টাব্দ থেকে একযুগেরও বেশি সময় ধরে নিয়মিতভাবে সঞ্চালনা করে আসছেন দিদি নাম্বার ওয়ান। সেই ব্যস্ততায় অভিনয়ই এখন যেন দূরে সরে পড়েছে। তবে এই যে একটা অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে নানারকম মানুষের গল্প শোনা আর সরাসরি তাদের কাছে আসার, ভালোবাসা পাবার যে সুযোগ তিনি পাচ্ছেন, সিনেমা হিট বা ফ্লপ হওয়ার টেনশন নিয়ে দিনাতিপাত করার চেয়ে এই-ই তো ঢের ভালো, না ?! এমনই মনে করেন রচনা ব্যানার্জি।


আমি আপন মনের মাধুরী মিশায়ে

তোমারে করেছি রচনা

রচনা ব্যানার্জির বাবার নাম রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। বিশ্বকবির নামে নাম যাঁর, অন্তরে কাব্যময়তা তার থাকাই স্বাভাবিক। জন্মের পর মেয়ের নাম রাখলেন তিনি ঝুমঝুম। ঝুমঝুম ব্যানার্জি। বাবা-মায়ের আদরের একমাত্র সন্তান। মেয়ে বড়ো হওয়ার পর পিতা রবীন্দ্রনাথ একদিন ঝুমঝুমকে নিয়ে গেলেন পশ্চিমবঙ্গের নামকরা চলচ্চিত্র নির্মাতা সুখেন দাসের কাছে। ঝুমঝুম নাম শুনে সুখেন বলেছিলেন, ‘এই নামটা আগে পাল্টাতে হবে। ঝুমঝুম নাম শুনলে সকলে বলবেন, মুনমুনের বোন [মুনমুন সেন]। তাই আগে পাল্টাতে হবে নামটা।’ তারপর পরিচালক নিজেই রবীন্দ্র রচনাবলী নিয়ে বসলেন নাম খোঁজার অন্বেষণে। পাতার পর পাতা, চরণের পর চরণ, স্তবকের পর স্তবকে চোখ হাতড়েও পেলেন না মনেরমতো কোনো নাম। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে খোঁজাখুঁজি খান্ত করে বইটা কোল থেকে টেবিলের উপর নামিয়ে রাখতেই বইয়ের নামটায় চোখ আটকালো সুখেনের। রবীন্দ্র রচনাবলী... রচনাবলী... রচনা... অতঃপর ‘ইউরেকা’ বলে তুড়ি ছুড়ে দিলেন ঝুমঝুমের দিকে এবং ঘোষণা করলেন ফিল্মি দুনিয়ায় অভিষেক হতে যাচ্ছে নতুন নায়িকার, যার নাম ‘রচনা ব্যানার্জি’। এভাবেই ১৯৯৩-এ সুখেন দাসের ‘দেনা পাওনা’ সিনেমার মধ্য দিয়ে অভিষেক ঘটে আজকের ‘দিদি’ হয়ে ওঠা রচনার।


তেজস্বিনী নারী তুমি দেবী দুর্গার রূপ

ওডিয়া অভিনেতা সিদ্ধান্ত মহাপাত্রকে বিয়ে করেছিলেন ২০০৪-এ। কিন্তু সে বিয়ে টেকেনি বেশিদিন। ২০০৭-এ বিয়ে করেন প্রবাল বসুকে। তাদের ঘর আলো করে এলো একমাত্র সন্তান রৌনাক ওরফে প্রণিল। কিন্তু স্বামীর সঙ্গে আবারো ঘটল দূরত্ব। তাহলে বর্তমান স্ট্যাটাস কী রচনার ? সিঙ্গেল, ম্যারেড, হ্যাপিলি ম্যারেড, সিঙ্গেল ওয়েটিং টু মিঙ্গেল... কী ? এসব প্রশ্নের স্পষ্ট জবাব দিলেন অভিনেত্রী। রচনা বলেন, আমি ম্যারেড... আই অ্যাম নট হ্যাপিলি ম্যারেড। আই অ্যাম নট ডিভোর্সড। ‘ছেলের জন্য ডিভোর্সটা করিনি। কারণ, আমি কখনো চাইনি যে আমার ছেলেকে এই ট্যাগটা দেওয়া হোক যে, তার বাবা-মা ডিভোর্সড। এটা আমার এবং আমার স্বামীর মিলিত সিদ্ধান্ত। আমরা বন্ধু হিসেবেই থাকব। তাই আমরা ডিভোর্সড নই। আমরা একসঙ্গে থাকি না। কিন্তু আমরা বন্ধু।’ তিনি আরো জানালেন, তার জীবনে কোনো পুরুষের প্রয়োজন নেই। অন্য কারো সঙ্গে সেটেল করতে চান না। ছেলে প্রণিলকে নিয়েই তার জীবন। আর মা হিসেবে ভীষণ কড়াও তিনি। শুটিং শেষে চটজলদি বাড়িতেই ফিরে আসতেন ছেলের দেখ-ভাল করার জন্য।

এসবের বাইরেও রচনা একজন বিজনেস ওম্যান। শাড়ি আর বিউটি প্রোডাক্ট ‘রচনা’জ কেয়ার’ নিয়ে এখন তিনি বেজায় ব্যস্ত। নারীকে সাজাতে শাড়ি আর প্রাকৃতিক উপাদানে তৈরি বিউটি প্রোডাক্ট বিক্রি করেন। তবে তার বিউটি প্রোডাক্ট ছেলেরাও ব্যবহার করতে পারবেন- ভক্তকুলের জন্য এটাও জানালেন তিনি।

বসন্ত ছুঁয়েছে

রচনা ব্যানার্জির জন্ম ১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দের অক্টোবরের ২ তারিখে, পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায়। সেই হিসেবে আসন্ন অক্টোবরে তার বয়স হবে পঞ্চাশ। একজন পরিণত, সম্পূর্ণা মানবী হিসেবে পঞ্চাশকে করবেন বরণ আর ক’মাস পরেই। ৫ ফুট ৭ ইঞ্চি উচ্চতার রচনা ব্যানার্জির ওজন ৫৩ কেজি। এই বয়সেও একদম তরুণীদের মতো কীভাবে নিজের রূপের জেল্লা ধরে রেখেছেন তিনি ? রচনা বলেন, ‘আমরা এমন একটা পেশার সঙ্গে যুক্ত, যেখানে দিনের অনেকটা সময় ক্যামেরার চড়া আলোর মধ্যে কাটাতে হয়। সেই সঙ্গে মেকআপ তো রয়েছেই। এসবের মধ্যে ত্বক ভালো রাখা সত্যিই চ্যালেঞ্জের। তবে, আমি সারাজীবন ঘরোয়া টোটকাতেই ভরসা রেখেছিলাম বলে কোনো সমস্যা হয়নি। প্রতিটি প্যাক আমি নিজের হাতেই বানাতাম।’ এছাড়াও রচনা দিনে প্রচুর পরিমাণে পানি পান করেন। নিজেকে সুস্থ রাখার জন্য খাদ্য তালিকা থেকে বাদ দিয়েছেন জাঙ্ক ফুড। শাক-সবজি এবং ফল খান প্রচুর পরিমাণে। অন্যদিকে নিজেকে সর্বদা টেনশনমুক্ত রাখেন। কেননা চেহারার সৌন্দর্য অনেকাংশে মনের উপরেও নির্ভর করে। মন ভালো থাকলে চেহারায় তা ফুটে ওঠে- বলেন চির তরুণ রচনা ব্যানার্জি।

ব্যবসা, টিভি শো, রাজনীতি, সংসার- এরকম ব্যস্ততা দিয়ে রাঙিয়ে তুলতে চান রচনা তার পঞ্চাশে শুরু হওয়া নতুন জীবনকে। জীবনের নানা পরতে যে রূপ, লাবণ্য ছড়িয়ে আছে, আকণ্ঠ তা পান করে যেতে চান। কেননা এ জীবনটা সম্পূর্ণ তার নিজের আর তিনি একজন সম্পূর্ণা নারী হিসেবেই বেঁচে থাকতে চান বাকি জীবন। হ

লেখা : ইভা আফরোজ খান