তন্ত্র মন্ত্র বা অলৌকিক কিছু নয়, স্রেফ কৌশল এবং উন্নত বুদ্ধির কৌশলের দক্ষতায় মঞ্চে পরিবেশিত এই নান্দনিক উপস্থাপন বিজ্ঞানের নামই ম্যাজিক বা জাদু। জাদু দেখে মুগ্ধ হননি এমন মানুষ পৃথিবীতে বিরল।
বাংলাদেশের জাদুবিদ্যার ইতিহাস বহু দিনের, আর এই ইতিহাস ক্রম বিবর্তনের ইতিহাস। সম্রাট জাহাঙ্গীরের আমল থেকে পিসি সরকার এবং জুয়েল আইচ পর্যন্ত বাংলাদেশের জাদুকরেরা মুগ্ধ করেছেন দেশ বিদেশের বহু মানুষকে, সেই বাংলার গতানুগতিক জাদুকে ভিন্ন আঙ্গিকে আধুনিক রূপে পরিবেশন করেছেন ম্যাজিক আইকন অব বাংলাদেশ আলীরাজ। তার মতে জাদুশিল্প একটি সম্মন্বিত কলারূপ। ১৯৯৫ খ্রিষ্টাব্দের দিকে দেশে প্রথম তিনি ফ্যাশান শো, গ্ল্যামার ও মডার্ন ডান্সের সমন্বয়ে ভিন্ন রূপে জাদুশিল্পকে উপস্থান করেছিলেন। ভিন্ন আঙ্গিকে জাদু পরিবেশন করাই তার শিল্প দক্ষতার পরিচয়। বর্তমান আধুনিক ফ্ল্যাশ ডান্স-এর নামকরণ তিনি করেছিলেন।
নিজস্ব প্রদর্শন ভঙ্গির জন্য টেলিভিশন, বিভিন্ন দূতাবাস, বহুজাতিক কোম্পানি, পারিবারিক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে তার একচ্ছত্র আধিপত্য এবং তিনি দাপটের সাথে প্রদর্শনী করে চলেছেন।
২০০৩ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ম্যাজিশিয়ান্স সোসাইটি অব বাংলাদেশ নামে জাদুর সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। যার বর্তমান সভাপতি জাদুকর জুয়েল আইচ। দেশ বিদেশের বিভিন্ন চটকদার অনুষ্ঠানের ভিড়ে দেশের স্থানীয় জাদুশিল্প যখন মুখ থুবড়ে পড়েছিল তখন ২০০৫ খ্রিষ্টাব্দে একক প্রচেষ্টায় শিল্পকলা একাডেমির মঞ্চে উপহার দিয়েছিলেন দেশের প্রথম বিশ্বের ৭টি দেশের সেরা তারকা জাদুকরদের নিয়ে তিনদিনব্যাপী আন্তর্জাতিক জাদু উৎসব ও জাদুর কর্মশালা। যা দেশের অবহেলিত জাদুশিল্পীদের মাঝে আলোর সঞ্চয় করে এবং ভিন্ন মাত্রা যোগ করেছিল দেশের জাদুশিল্পে।
এই খাতে অনবদ্য অবদান এবং বাংলার জাদুকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য ২০০৫ খ্রিষ্টাব্দে বিশ্ব বিখ্যাত জাদুকর আমেরিকার ফ্রাঞ্জ হারারির কাছ থেকে পেয়েছেন গোল্ডেন উইজার্ড অ্যাওয়ার্ড এবং ম্যাজিক আইকন অব বাংলাদেশ খেতাব।
আলীরাজ চীনের সিসিটিভি-৭ চ্যানেলের সবচেয়ে জনপ্রিয় রিয়েলিটি শোতে আমন্ত্রিত হয়ে প্রদর্শনী উপহার দেন এবং তার প্রদর্শনীতে মুগ্ধ হয়ে চীনের জনপ্রিয় চলচ্চিত্র নায়ক চেই মায়েকার জাদুর প্রতি আকৃষ্ট হন। বিশেষ অনুরোধে তাকে জাদুর প্রশিক্ষণ দেন আলীরাজ।
২০০৭ খ্রিষ্টাব্দে সিসিটিভি-৭ চ্যানেলে তার সম্মিলিত প্রদর্শনীটি চীনের সর্বোচ্চসংখ্যক দর্শক দ্বারা ভোটে নির্বাচিত হয় এবং চীনা মুদ্রায় অর্জিত ৯ কোটি ৮৯ লক্ষ আরএমবি বিরল রোগাক্রান্ত শিশুদের জন্য প্রদান করা হয়। শুধু তাই নয়, ২০০৭ থেকে ২০২৩ পর্যন্ত এশিয়ায় আয়োজিত বিভিন্ন আন্তর্জাতিক জাদু প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশ থেকে প্রথম এবং একমাত্র বিচারক হিসেবে আলীরাজকে জুরি বোর্ডে বহুবার আমন্ত্রণ জানানো হয়। এটি দেশের জাদুশিল্পের জন্য অনন্য অর্জন। ২০০৯ খ্রিষ্টাব্দে চীনের বেইজিংয়ে অনুষ্ঠিত এফআইএসএম অলিম্পিক অব ম্যাজিকের জন্য বাংলাদেশ থেকে একমাত্র গ্রুপ অর্গানাইজার হিসেবে আমন্ত্রিত হয়ে যোগ দেন আলীরাজ। সেইসাথে এশিয়ার বৃহৎ জাদু সংগঠন এশিয়ান ম্যাজিক অ্যাসোসিয়েশনের বাংলাদেশ শাখার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন।
২০১১ খ্রিষ্টাব্দে আমেরিকার জাদু সংগঠন ইন্টারন্যাশনাল ম্যাজিশিয়ানস সোসাইটি [ইউএসএ] থেকে জাদুর অস্কার খ্যাত মার্লিন অ্যাওয়ার্ড অর্জন করেন এবং ২০১২ খ্রিষ্টাব্দে পৃথিবীর বৃহৎ ইউরোপীয় সংগঠন এফআইএসএম-এর সাথে বাংলাদেশকে সংযুক্ত করে বাংলাদেশ শাখার প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হন। ২০১৯ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশের জাদুশিল্পীদের উন্নয়ন এবং সম্প্রসারণের জন্য বিদেশি প্রশিক্ষকদের সমন্বয়ে আধুনিক জাদুর কর্মশালা উপহার দেন তিনি।
দেশের ইভেন্ট শিল্পেও সর্বপ্রথম জাদুর সংযোজন ঘটিয়েছিলেন এই সৃজনশীল শিল্পী। তিনি আইসিসি ওয়ার্ল্ড কাপ, বাটেক্সপো, শাহরুখ খান বিগ শো, সালমান খান শো, এ আর রহমান কনসার্ট, ইন্দো- বাংলা গেমস, এশিয়া কাপ ও বিপিএলের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে পাইরোটেকনিকস ইফেক্টসসহ জাদু প্রদর্শন করে দেশের জাদুশিল্পকে পৌঁছে দিয়েছেন বিশ্বদরবারে। দেশের বিভিন্ন বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের পণ্যের প্রচারেও প্রথম জাদুশিল্পের সংযোজন ঘটান।
আলীরাজ এককভাবে বাংলাদেশে প্রথম এবং একমাত্র ৩৫০ আসনবিশিষ্ট আন্তর্জাতিক মানের ব্যয়বহুল মঞ্চ সমেত পুর্ণাঙ্গ জাদুর প্রেক্ষাগৃহ ম্যাজিক থিয়েটার প্রতিষ্ঠা করেন ঢাকার ফ্যান্টাসি আইল্যান্ড পার্ক, দিয়াবাড়ি, উত্তরায়।
অভিজাত পরিবারে বেড়ে ওঠা প্রচার বিমুখ এই জাদুশিল্পীর অবদান বাংলার জাদুর অঙ্গনে অস্বীকার করার উপায় নেই। দিনে দিনে তিনি বর্তমান প্রজন্মের দর্শক ও নবীন জাদু শিল্পীদের কাছে আলীরাজ এখন একজন আইকন। একটি অবিস্মরণীয় ও অত্যুজ্জ্বল নাম।
বাংলার পতাকা নিয়ে দেশের প্রতিনিধিত্ব করে বহুবার প্রদর্শনী করেছেন তুরস্ক, লন্ডন, আমেরিকা, চীন, জাপান, ফিলিপিন, ইন্দোনেশিয়া, হংকং, ভারত, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, ফ্রান্স, ইতালি এবং ইউরোপের বহু দেশে।
আলীরাজ বলেন, ‘জাদু একটি ব্যায়বহুল শিল্প। বিশ্বের উন্নত দেশের জাদুশিল্পের তুলনায় আমরা পিছিয়ে নেই ; তবে তাল মেলানো সত্যি কঠিন। যেই দেশের শিল্প এবং সংস্কৃতি যত উন্নত সেই দেশটি ততটাই উন্নত। আমাদের দেশে সময় থাকতে সৃজনশীলতা এবং কর্মের সঠিক মূল্যায়ন হয় না। আমি মনে করি, প্রতিটা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে জাদুকে সম্পৃক্ত করা প্রয়োজন। বিভিন্ন কোম্পানি এবং মিডিয়ার অনেক বড়ো ভূমিকা রয়েছে এক্ষেত্রে। হ
লেখা : শেখ সেলিম