বিখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ, গায়ক, গীতিকার এবং গিটারবাদক আইয়ুব বাচ্চুকে নিয়ে আনন্দভুবন ৩ বর্ষ ২২-২৩ সংখ্যায় [১৬ এপ্রিল ১৯৯৯] প্রথমবর প্রচ্ছদ প্রতিবেদন প্রকাশ করে। শিরোনাম ছিল : ‘চলো বদলে যাই’। এতে তার সম্পর্কে লেখা হয়েছে :
জ্ঞানী কীরকম ? ঠাকুর শ্রী রামকৃষ্ণ বলেন, জ্ঞানীর ভেতর গঙ্গা একটানা বইতে থাকে, একদিকে যাচ্ছে। তার জীবনে খুব একটা বৈচিত্র্য নেই। একটা ভাবকে অবলম্বন করে সে চলেছে, একটানা। তার পক্ষে সব স্বপ্নবৎ। ঠিক যেমন আমাদের আইয়ুব বাচ্চু, কেবল গান নিয়েই আছেন। ’৭৫ খ্রিষ্টাব্দে গিটার হাতে পাওয়ার পর থেকে এবং এক বছরের মধ্যে গিটার পাগল হওয়া থেকে আজতক আছেন গিটার আর গান নিয়েই। গোটা আইয়ুব বাচ্চু-জুড়ে আছে গান। শ্যাম তন, শ্যাম মন, শ্যাম হৈ হামারো ধন-এর মতো ব্যাপার। আমাদের এই বঙ্গদেশে যখন সরকারি আমলা হওয়া আর স্বর্গ হাতে পাওয়া সমান কথা তখন আইয়ুব বাচ্চু রীতিমতো প্রফেশনাল মিউজিশিয়ান। নিজেই বলেন, দশটা পাঁচটা অফিস করে সন্ধ্যায় শখের সংগীতচর্চার সময় এখন আর নেই। তাই পথ তার একটাই, কেবল গান আর গান ...
লেখা : নজরুল ইসলাম
পরবর্তীসময়ে
আইয়ুব বাচ্চু ১৯৬২ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ আগস্ট চট্টগ্রাম জেলার পটিয়া উপজেলার খরনা ইউনিয়নে একটি সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা ইশহাক চোধুরী এবং মা নূরজাহান বেগম। আইয়ুব বাচ্চু ১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দে সরকারি মুসলিম উচ্চবিদ্যালয়ে ভর্তি হন। ১৯৭৯ খ্রিষ্টাব্দে ওই স্কুল থেকে এসএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এরপর চট্টগ্রাম কলেজ থেকে স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। চট্টগ্রামে কলেজে পড়াকালীন সহপাঠী কয়েকজন বন্ধুকে নিয়ে একটি ব্যান্ডদল গড়ে তোলেন। ব্যান্ডদলটির নাম ছিল ‘গোল্ডেন বয়েজ’। পরে নাম বদলে রাখা হায় ‘আগলি বয়েজ’। সেই ব্যান্ডদলের গায়ক ছিলেন কুমার বিশ্বজিৎ আর গিটারিস্ট ছিলেন আইয়ুব বাচ্চু। সেই সময়ে তারা মূলত চট্টগ্রামের পটিয়ায় বিভিন্ন বিয়ের অনুষ্ঠান এবং শহরের বিভিন্ন ক্লাবে গান করতেন। পরবর্তীসময়ে ১৯৮০ খ্রিষ্টাব্দে আইয়ুব বাচ্চু ও কুমার বিশ্বজিৎ সোলসে যোগদান করার কারণে ব্যান্ডদলটি ভেঙে যায়। তারপর ১৯৭৭ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ‘ফিলিংস’ [বর্তমানে ‘নগর বাউল’ নামে পরিচিত]-এ যোগদান করেন এবং ব্যান্ডদলটির সঙ্গে ১৯৮০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত কাজ করেন। একইবছরে তিনি জনপ্রিয় রক ব্যান্ডদল সোলস-এর প্রধান গিটারবাদক হিসেবেও কাজ করেন। সোলসের সঙ্গে তিনি বেশ কয়েকটি অ্যালবামে কাজ করেন। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য : সুপার সোলস [১৯৮২], কলেজের করিডোরে [১৯৮৫], মানুষ মাটির কাছাকাছি [১৯৮৭] এবং ইস্ট অ্যান্ড ওয়েস্ট [১৯৮৮] প্রভৃতি। এরপর ১৯৯১ খ্রিষ্টাব্দের ৫ এপ্রিল তিনি তার নিজের ব্যান্ডদল ‘লিটল রিভার’ গঠন করেন, যা পরবর্তীকালে ‘লাভ রান্স ব্লাইন্ড’ নামে বা সংক্ষেপে এলআরবি নামে জনপ্রিয়তা লাভ করে। তিনি তার মৃত্যু অবধি ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত ২৭ বছর ধরে ব্যান্ডদলটির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তাছাড়া একজন একক শিল্পী হিসেবেও তিনি সফলতার চূড়ায় পৌঁছেছিলেন। তার প্রথম একক অ্যালবাম ‘রক্ত গোলাপ’, যা ১৯৮৬ খ্রিষ্টাব্দের সেপ্টেম্বরে প্রকাশিত হায়। এবং দ্বিতীয় অ্যালবাম ‘মায়না’ [১৯৮৮] দিয়ে তিনি তার একক কর্মজীবনের সফলতা অর্জন করেন। তারপর কষ্ট [১৯৯৫] অ্যালবামটি প্রকাশ করেন, যা সেই সময়ে প্রচুর সফলতা অর্জন করে। ২০০৭ খ্রিষ্টাব্দে তিনি দেশের প্রথম বাদন অ্যালবাম ‘সাউন্ড অব সাইলেন্স’ প্রকাশ করেন। আইয়ুব বাচ্চু তার বান্ধবী ফেরদৌস চন্দনাকে বিয়ে করেন ১৯৯১ খ্রিষ্টাব্দের ৩১ জানুায়ারি। তাদের দু’টি সন্তান আছে। মেয়ে ফাইরুজ সাফরা আইয়ুব এবং ছেলে আহনাফ তাজওযার আইয়ুব। আইয়ুব বাচ্চু দীর্ঘদিন ফুসফুসে পানি জমা অসুস্থতায় ভোগার পর ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দের অক্টোবর মাসে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ঢাকায় তার নিজ বাসভবনে মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর দুইদিন আগে তিনি রংপুরে তার শেষ কনসার্ট করেন। আইয়ুব বাচ্চুকে চট্টগ্রামের চৈতন্য গলিতে তাদের পারিবারিক কবরস্থানে মায়ের কবরের পাশে দাফন করা হয়।
এই গুণী শিল্পীকে শ্রদ্ধা জানানোর জন্য চট্টগ্রামের প্রবর্তক মোড়ে ১৮ ফুট উচ্চতার একটি গিটারের ভাস্কর্য স্থাপন করা হয়। রুপালি গিটার আইয়ুব বাচ্চুর একটি জনপ্রিয় গানের শিরোনাম অনুসারে এই ভাস্কর্যের নাম রাখা হয় ‘রুপালি গিটার’। হ লেখা : শহিদুল ইসলাম এমেল