চলচ্চিত্র অভিনেতা মান্নাকে নিয়ে আনন্দভুবনের ৪ বর্ষ ২১ সংখ্যা [১৬ মার্চ ২০০০]-সহ আরো কয়েকটি সংখ্যায় প্রচ্ছদ প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে। তার সম্পর্কে লেখা হয়েছে :
টাঙ্গাইলের বিখ্যাত তালুকদার বংশে তাঁর জন্ম। আরফান খান কোম্পানি এবং এস এম মুসা কোম্পানির মালিক ছিলেন তার দাদা প্রয়াত এস এম মুসা তালুকদার। সে সূত্রে ব্যবসায়ী বাবার সন্তান মান্নার শৈশবের পুরোটাই কেটেছে টাঙ্গাইলে। বিন্দুবাসিনী বয়েজ স্কুল থেকে এসএসসি আর ভূয়াপুর ইব্রাহীম কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর স্নাতকে ভর্তি হয়েছিলেন জিওলজি নিয়ে। এরই মাঝে জেলাপর্যায়ে স্কুল থেকে টেবিল টেনিস খেলে চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন, দীর্ঘদেহী হওয়ার কারণে ক্যাপ্টেন পদটা পেতেন বরাবর আর অসম্ভব সৌখিন তরুণটির সতর্ক দৃষ্টি থাকতো নতুন ফ্যাশনেবল পোশাকের দিকে। কানাডায় সেটলড আত্মীয়ের সূত্রে ‘সবচাইতে প্রিয় হয়ে উঠেছিল লিভাইস আর র্যাংলার কোম্পানির জিন্স। আর ছিলেন গানের পোকা, সবার ছোটো আর স্নেহধন্য হওয়ার সুবাদে সালামি অল্প অল্প জমিয়ে সাড়ে তিন হাজার টাকার বিনিময়ে কিনে ফেলেছিলেন ন্যাশনাল প্যানাসনিক সেট। সেসময় থেকেই তিনি পিংক ফ্লয়েড-এর দারুণ ভক্ত, সেই সাথে রুটিন ছিল দরজা বন্ধ করে মাইকেল জ্যাকসনের গানের সাথে উদ্দাম নাচ। আবার কিশোর কুমার, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কষ্টের গান কেন জানি হৃদয় ছুঁয়ে যেত।
রাজ্জাক অভিনীত একটি ছবির অংশবিশেষ দেখিয়ে তিনি মুগ্ধ করলেন সদস্যদের। রাজ্জাকেরই সুপারিশে ‘তওবা’ ছবিতে মান্না পেলেন তিন নম্বর নায়কের ছোট্টো পরিসরের চরিত্র। নতুন মুখের নির্বাচিত শিল্পীদের নিয়ে এফডিসিতে আয়োজিত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে মান্না দেখালেন মাইকেল জ্যাকসনের নাচ। পরিচালক কাজী হায়াত তাকে ডাকলেন। বরাবরের মতো উত্তেজিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন তাঁর নাম, দেশের বাড়ি কোথায়, সেইসাথে প্রস্তাব দিলেন পাগলী ছবিতে অভিনয় করার। সে ছবিতে মান্না পেলেন দ্বিতীয় নায়কের চরিত্র, প্রথম নায়ক ছিলেন সাত্তার আর নায়িকা ছিলেন ফারজানা ববি। কাজী হায়াতের যন্ত্রণা ছবিতে তিনি ছিলেন অঞ্জু ঘোষের নায়ক, দাঙ্গা ছবিতে এলেন সুচরিতা আর এমনি করে মান্না পেলেন একক নায়কের স্বীকৃতি। মনতাজুর রহমান আকবরের প্রেম দিওয়ানা আরেকটি মাইলস্টোন, ইলিয়াস কাঞ্চনকে নিয়ে সিপাহী-র পর কাজী হায়াতের বক্তব্যধর্মী ছবির একমাত্র তারকা হয়ে উঠলেন তিনি...
লেখা : সৈকত সালাহউদ্দিন
পরবর্তীসময়ে
২০০৮ খ্রিষ্টাব্দে না-ফেরার দেশে চলে গেছেন মান্না। ক্যালেন্ডারের ১৭ ফেব্রুয়ারি তারিখটি আজও কাঁদায় তার ভক্তদেরকে। তার লাশ একনজর দেখতে লাখ লাখ ভক্তের ঢল প্রমাণ করে, আমজনতার কত কাছের কত আপন ছিলেন মান্না। মৃত্যুর পর তিনি হয়েছেন ‘মহানায়ক’। গোটা জীবন নিরন্ন মানুষের জন্য পর্দায় স্লোগান দিয়েছেন মান্না। মজুরের হয়ে প্রতিবাদ করেছেন সেলুলয়েডে। তার মুখে প্রতিবাদের বাণী শুনে উত্তেজিত, বিক্ষুব্ধ হয়েছে তারুণ্য। দর্শক দেশকে ভালোবাসতে শিখেছে তার ছবির ভেতর দিয়ে। দেশকে পরিবর্তনের শপথ নিয়েছে তার ছবির সংলাপের সঙ্গে একাত্ম হয়ে। বাণিজ্যিক সিনেমা নতুন এক মাত্রা পেয়েছিল মান্নার অভিনয়ে। ‘দাঙ্গা’, ‘ত্রাস’, ‘যন্ত্রণা’, ‘সিপাহী’, ‘দেশদ্রোহী’, ‘তেজী’ ইত্যাদি ছবিতে মান্না বলেছেন সন্ত্রাসমুক্ত দেশের কথা, ছাত্রজনতার রুখে দাঁড়াবার কথা, শ্রমিকের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার কথা। একারণেই মান্না ছিলেন শেকড়শ্রেণির নায়ক। আর মান্নার এই রোল মডেল হওয়ার পেছনে অবদান পরিচালক কাজী হায়াতের। তিনিই ধারালো সংলাপ তুলে দিতেন মান্নার মুখে। পরে নির্মাতা নাদিম মাহমুদ, মনতাজুর রহমান আকবর-সহ অন্যন্য পরিচালক সামিল হন মান্নাকে প্রথম কাতারে নিয়ে আসতে। একসময় সংগ্রামী নায়ক থেকে দেশের শীর্ষ নায়কে পরিণত হন মান্না। ১৯৮৪ খ্রিষ্টাব্দের নতুন মুখে যে সংগ্রামের শুরু, ১৯৯৭ খ্রিষ্টাব্দে প্রযোজক হওয়ার মধ্য দিয়ে তার পূর্ণতা। তারপর জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার থেকে শুরু করে ইন্ডাস্ট্রির অভিভাবক হিসেবে আত্মপ্রকাশ- তার ভূমিকা ছিল বিচিত্র। এখনো সিনেমাশিল্পে নিবেদিতপ্রাণ চলচ্চিত্রকর্মী হিসেবে তাকে শ্রদ্ধার সঙ্গে দেখা হয়। তার মতো চলচ্চিত্রকর্মীর অভাব প্রচ- অনুভব করেন সিনেমাওয়ালারা।
লেখা : মাহফুজুর রহমান