ইউরোপের ১৫০ দিন -সৈয়দা তাসলিমা আক্তার

11 Jun 2024, 01:35 PM ভ্রমন শেয়ার:
ইউরোপের ১৫০ দিন  -সৈয়দা তাসলিমা আক্তার

[পূর্ব প্রকাশিতের পর]


নেদারল্যান্ডের সূর্য তখন ডুবি-ডুবি করছিল, একটা লালচে আভা ছড়িয়ে পড়েছে চারিধারে। আমরা তখনো চলতি পথের পথিক, আমাদের আবাস শহর ছাড়িয়ে অনেকটা ভেতরে। যে শহরটার পাশ দিয়ে আমরা চলেছি তা নেদারল্যান্ডের রাজধানী আমস্টারডাম। ডুবে যাওয়া সূর্যের রেশ তখনো বিদ্যমান, একটি মায়াবী আলোয় দূর থেকে শহরটা একদম স্বপ্নের মতো দেখতে। এর মধ্যে আমরা গাড়ি থেকে নেমে এদিক- সেদিক দেখছিলাম। একটু হাঁটাহাটি করে হাত-পায়ের জং ছাড়িয়ে নিচ্ছিলাম। আমাস্টারডাম যেন পটে আঁকা ছবি, ছোট্ট বেলায় ঘরের দেয়ালে ক্যালেন্ডারের পাতায় যেসব অতিসুন্দর স্বপ্নময় ছবি শোভা পেত তাই এখন চোখের সামনে। এখন যদি কোনো ছবি তুলি তবে আমিও তেমনি ক্যালেন্ডারের পাতায় শোভা পাওয়া কোনো একটি ছবির অংশ হয়ে যাবো। কী, খুব আবোল-তাবোল বকছি, আসলে কল্পনার অতীত কোনো সৌন্দর্য যদি হঠাৎই হাতের মুঠোয় চলে আসে তবে, একটু এলোমেলো বকাই যায়। পুরো শহরটি জলের উপর। রাস্তাগুলো তুলনামূলক বেশ সরু, কেননা এখানে পাবলিক ট্রান্সর্পোটগুলো মূলত জলের উপর দিয়েই চলে। আপত দেখে মনে হয় যে এক একটা প্রমোদতরী তবে আদতে এগুলোই সাধারণ পরিবহণ। আর স্থলের বাহন বলতে গেলে সাইকেল আর মেট্রো। এখানকার মেট্রোগুলোর আকার বাসের থেকে একটু বড়ো। আমরা মূল শহরে না ঢুকে বাইপাস ধরে শহরের বাইরে একটা রেস্টুরেন্টে ঢুকলাম, এখানে অবশ্য খাওয়ার মতো তেমন কিছু না থাকায় কেক আর কফি খেয়ে আমরা বেরিয়ে পড়লাম। টানা জার্নি আর অস্বাভাবিক জ্যামে সবাই বেশ ক্লান্ত।

শহর ছেড়ে আমরা চলছি তো চলছিই আমাদের ক্যাম্পের হদিস নেই, ততক্ষণে চারিধার ঘুটঘুটে অন্ধকার শহরের বাইরে বলে আলোগুলো বেশ দূরে দূরে। আমরা যখন আমাদের ক্যাম্পে পৌঁছালাম মনে হচ্ছিল রাত তখন তার কয়েক পহর অতিক্রম করে ফেলেছে। এদিকে ক্যাম্পের আনুষ্ঠানিকতাও ব্যাপক, সব শেষ করে আমাদের রুমে পৌঁছুতে পৌঁছুতে আরও আধ ঘন্টা সময় লাগলো। যদিও নাম ক্যাম্প স্টে তবে পৌঁছে মনে হলো একেকটি ক্যারাভ্যান শুধু ইঞ্জিন আর চাকা থাকলেই চলতে শুরু করবে। ছোটো ছোটো তিনটা খুপরি, এর এককেটির মধ্যে আমরা সুবিধা মতো ঢুকে গেলাম। খুপরিতে ঢুকে একটু গড়াগড়ি করে ফ্রেস হয়ে নিলাম তারপরই মনে হলো খুব খিদে পেয়েছে। আর তখন থেকেই আমার কাজিনের আফসোস আসার পথে খেয়ে নিলে ভালো হতো এখন এই পাড়াগাঁয়ে খাবারের দোকান কোথায় পাওয়া যাবে, যদিও থাকে হালাল খাবার পাওয়া যাবে না নিশ্চত ইত্যাদি ইত্যাদি। তার এই ঘ্যানঘ্যানানিতে অতিষ্ট হয়ে বললাম চলো আগে খুঁজে দেখি, নেটে সার্চ দিতে তো অসুবিধা নাই। এ কথায় তার মাথা অনেকটা ঠান্ডা হলো বলে মনে হলো, তার পরামর্শমতো ‘কাবাব স্টোর’ লিখে সার্চ দিতে বেশ কিছু দোকানের লিস্ট এলো যেগুলো তখনো খোলা ছিল, কিন্তু লোকেশন দেখে রীতিমতো ধাক্কা খেতে হলো, সেগুলো এতটাই দূরে অবস্থিত যে, আমাদের আবার অর্ধেক পথ পিছিয়ে যেতে হবে। এর মধ্যে বেশ কাছাকাছি একটি লোকেশন থাকায় আমার কাজিনকে সেখানে যেতে বললাম, কিন্তু সে খুব একটা উৎসাহ দেখালো না, তার ধারণা এটা ফলস্ হবে, তার এত বছরের অভিজ্ঞতায় দেখেছে শহরতলীতে হালাল খাবারের দোকান সাধারণত থাকে না। যেহেতু আমাদের হাতে আর কোনো অপশন নেই তাই একটু দেখে নিতে দোষ কী ? এই ভেবে আমরা পথে বেরিয়ে পড়লাম।

শীতের রাতের অন্ধকার যেন একটু বেশিই গাঢ় হয়, একে তো এলকাটা শহর ছাড়িয়ে অনেকটা ভেতরে স্বাভাবিকভাবেই গাছপালার অধিক্য বেশি, সাথে কুয়াশারা যেন নিজেদের সীমানা বাড়িয়ে দিয়ে পথচারীদের দৃষ্টিসীমাকে বেঁধে দিতে বদ্ধপরিকর। আর সেই সাথে বিজলীবাতির চমক থেকেও এলাকাটা মুক্ত। তাই পথে নেমে চলছি তো চলছিই যেন অন্ধকারে চারপাশের সবটাই অদৃশ্য, শুধু গাড়ির হেড লাইটের আলোতে পথ যতটা দৃশ্যমান। আমার কাজিন গাড়ি চালাচ্ছে আর আমি পেছনে বসে ম্যাপ দেখে পথের নিশানা বলে চলেছি, বাকিরা গাড়িতে বসেই ঝিমুচ্ছে। অনেকটা যাওয়ার পর ছোটোমতো একটা গ্রামীণ বাজার চোখে পড়লো। আর বাজারটা দেখে আমার ছোটো বেলার নানিবাড়ির এলাকার কথাও মনে পড়ে গেল। বাস্তবে দৃশ্য দুটির মধ্যে যোজনযোজন তফাৎ থাকলেও যেন একই আবহ প্রকাশ পাচ্ছিল। গ্রামীণজীবনের একটি চালচিত্র। অল্প কিছু দোকানপাট যার মধ্যে রয়েছে, সেলুন, ¯েœকসের দোকান, একটি হার্ডওয়ারের দোকান। কিন্তু খাবারের কোনো দোকান তখন অবধি আমাদের চোখে পড়েনি। আমার ভাই গাড়ি ঘুরিয়ে নিচ্ছিল, তখনই একটি সরু গলি দেখতে পেয়ে আমি সেদিকে টার্ন নিতে বললাম। সেখানে একটু আলোর আভাস পাওয়া যাচ্ছিল আমার ভাই [কাজিন] যদিও ভরসা পাচ্ছিল না তবুও সেদিকে গাড়ি ঘুরালো। না এবার আর আমরা হতাশ হইনি। একটি ছোটোখাটো একটি তার্কিশ দোকান, তখনো তাদের পাট গুছায় নি। আমার ভাইয়ের ইচ্ছে ছিল আমাকে স্পেশাল তার্কিশ খাবার খাওয়ানোর, ভাগ্য সুপ্রসন্ন মেন্যুতে তা বর্তমান থাকায় আমরা তাই অর্ডার করলাম। যেহেতু সময় আর পরিবেশের বিবেচনায় এখন বেশ রাত তাই দোকানে ভিড়বাট্টাও তেমন নেই, কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতেই খাবার হাজির। একেই বুঝি বলে ঘ্রাণে অর্ধ ভোজন, আসলে সারাদিন মুখরোচক কোনো খাবার পেটে পড়েনি আর তার্কিশ এই খাবারের ঘ্রাণ এতই চমৎকার ছিল যে, মনে হলো পেটের ভেতরটা চনমনিয়ে উঠলো। আর সবচেয়ে বড়ো কথা ক্ষিদা লেগেছিল চূড়ান্ত। বিশাল বিশাল প্লেটে এতো খাবার দেখে আমার তো চক্ষু চড়কগাছ। দিলাম তো মোটে একটি খাবরের অর্ডার তাতে এতো কিছু কেন। ভাবি বলল, এজন্যই তো এটা স্পেশাল মেন্যু, এটাকে ‘দুরুম’ বলে। না আমারা পাঁচ জনের কেউই পুরো প্লেট সাবাড় করতে পারিনি। অবশ্য তাতে আমাদের যে খুব লস হলো তা নয় বরং লাভই হলো আমরা প্রত্যেকের বেঁচে যাওয়া খাবারই প্যাক করে ক্যাম্পে নিয়ে এলাম, ফ্রিজে প্রিজার্ভ করে রাখলে সকালের নাশতা নিয়ে আর চিন্তা করতে হবে না।

ক্যাম্পে ফিরে কেউই আর রাত জাগলো না, যে যার মতো ঘুমুতে চলে গেল। পরদিন ঘুম থেকে উঠে দরজা খুলে বারান্দায় আসতেই আমরা অবাক, কোন জাদুর ছোঁয়ায় সমস্ত চরাচর যেন রূপকথার তুষার রাজ্যে পরিণত হয়েছে। মনে একটু আফসোস হলো ইশ যদি তুষারপাতটা দেখতে পারতাম। তবে হঠাৎ পেয়ে যাওয়া এই অভূতপূর্ব পরিবেশ থেকে আনন্দের নির্যাসটুকু নিতে আমরা কার্পণ্য করিনি। কিন্তু অন্য দিকে আমার ভাইকে দেখি কিছুটা চিন্তিত আমাদের গোছগাছ করার কথা বলে সে চলল গাড়ির খোঁজে। আমি অনেকটা অবাক হয়েই বললাম, একেবারে ব্যাগপত্তর নিয়েই বের হই, তখন সে জানালো গাড়ি খুঁজে পাওয়া এখন বেশ ঝামেলার কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমি তার কথার মানে না বুঝে ভাতিজাদের নিয়ে তারপিছু নিলাম। আসলেই দেখি জাটিল অবস্থা, যদিও রাতের অন্ধকারে আমরা এখানে এসেছি তবু কিছু তো আন্দাজ ছিল যে, আমরা কোথায় পার্কিং করেছি। রাতের তুষারপাতে পুরো ল্যান্ডস্ক্যাপই যেন বদলে গেছে। অনেক সময় লাগলো গাড়ি খুঁজে পেতে। তারপর সেটার উপর থেকে বরফ সরানো পাক্কা ঘণ্টাখানের ধাক্কা। এরপর আমরা রুমে ফিরে রাতের বেঁচে যাওয়া খাবার গরম করে নিয়ে সকালের নাশতা সারলাম। এর পরপরই ব্যাগপত্তর গুছিয়ে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। এবারের গন্তব্য রাজধানী আমাস্টারডাম।

আমাস্টারডাম শহর সম্পর্কে আর নতুন কী বলবো, আসলেই ছবির মতো সুন্দর ছিমছাম একটি শহর। রাতের তুষারপাতের পর পুরো শহরের উপরই যেন বরফের একটি আস্তরণ পড়ে আছে, শহরে ঢুকেই আমরা একটা যুতসই পার্কিং খুঁজে নিলাম যেখানে মোটামুটি সারাদিনের জন্য আমরা গাড়ি রাখতে পারবো। এরপর মূলত হেঁটেই আমাদের আমস্টারডাম দেখা শুরু, মাঝে-মাঝে মেট্রোতে উঠেছি। নৌযানে চড়ে শহর পরিভ্রমণের ইচ্ছে থাকলে এ যাত্রায় সে সুযোগ হয়নি। তবে, হেঁটে এবং ট্রামে চেপে একসময় আমরা আনা ফ্রাংকের বাড়িতে চলে গেলাম, আমি তো বেশ এক্সাইটেড কিশোরী বেলায় পড়া আনা ফ্রাংকের ডাইরি এখনো স্মৃতিতে উজ্জল। বাড়িটি এখন মিউজিয়াম রূপে গড়ে উঠেছে। আমি মিউজিয়ামটি দেখতে খুবই উৎসুক, অতি উৎসাহে লাইনে দাঁড়িয়ে গেলাম। কিন্তু কোথাও যেন খটকা লাগছিল, এদিকে কিছু লোকজন লাইনে না দাঁড়িয়ে ট্যাব হাতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কয়েকজন মেয়ের আশপাশে ভিড় জমাচ্ছে। কৌতূহল থেকেই ভাবিকে লাইনে রেখে এগিয়ে গেলাম, গিয়ে যা জানলাম তা অতিউৎসাহের আগুনে পানি ছিটিয়ে দিল। এখনে সরাসরি কোনো টিকেট বিক্রি হয় না। অনলাইনে টিকেট কাটতে হয় এবং ট্যাব হাতে দাঁড়িয়ে থাকা ভলেন্টিয়ারেরা দর্শনার্থীদের অনলাইনের টিকেট কাটতে সাহায্য করে থাকে। আমি কিছুটা আশা নিয়ে একজনকে সেদিনের টিকেট কেটে দিতে বলায় সে মিষ্টি একটি হাসি দিয়ে বলল, সরি ম্যাম”। যদি চাই তো আগামী কালের টিকেট দিতে পারে কিন্তু আগামীকাল তো আমরা আর এখানে থাকছি না। তাই আনা ফ্যাংকের বাড়িটা বাইরে থেকে দেখেই আমাদের চলে আসতে হলো।