শামীম সাগর একজন অভিনেতা, নির্দেশক, নাট্যকার, প্রশিক্ষক সর্বোপরি একজন থিয়েটার অন্তঃপ্রাণ মানুষ। থিয়েটার ঘিরেই তার সকল চিন্তা-চেতনা। কখনো লেখেন, কখনো নির্দেশনা দেন, কখনো অভিনয় করেন বা কখনো প্রশিক্ষণ দেন- এভাবেই চলে তার দিন-রাত। বলেন, “আমি খুব ইন্ট্রোভার্ট মানুষ। মানুষের সাথে মিশতে পারতাম না, গুছিয়ে কথা বলতে পারতাম না, ঘর-গৃহস্থালির কাজও জানতাম না। কিন্তু থিয়েটার করতে করতে যখন থিয়েটারে জুতা সেলাই থেকে চণ্ডী পাঠ সবই করতে হয়েছে, মেঝে ঝাড়– দেওয়া থেকে সমবেতভাবে কাজ করা পর্যন্তÑ আমাকে জীবনের পথে চলার অনেক কিছু শিখিয়েছে থিয়েটার। এমনকি থিয়েটার করেছি বলেই চাকরি পাওয়া ও চাকরিতে উন্নতি করা সহজ হয়েছে। পড়াশোনা করার ক্ষেত্রেও কম সময়ে আমি পড়া ধরে ফেলতে পারতাম।” থিয়েটার থেকে প্রাপ্তির কথা বলতে গিয়ে এভাবেই বলেন শামীম সাগর। আর মানুষের ভালোবাসার স্বীকৃতি পাওয়া তো তার কাছে অমূল্য বিষয়।
কুষ্টিয়ার সন্তান শামীম সাগরের থিয়েটারের ভিত বড়ো মজবুত। বুঝতে শেখার পর থেকেই দেখেছেন চারপাশে নাটক, গান, সাংস্কৃতিক চর্চা চলছে। পাড়ায় পাড়ায়, স্কুলে, কলেজে, ঋতুর পালা বদলের সঙ্গে সঙ্গে, কী জাতীয় দিবসে ছেলেমেয়েরা, ছাত্র-ছাত্রীরা মহড়া করছে, নাটক করছে। বাবা, চাচারাও নাট্যচর্চার সঙ্গে ছিলেন জড়িত। তাই থিয়েটারে যুক্ত হওয়া বা যুক্ত থাকাটা কোনো আকস্মিক ঘটনা নয় তার। ছেলেবেলা থেকেই করতেন সংগঠনÑ নবীন চেতনা শিশু-কিশোর সংগঠন, চক্রবাক আবৃত্তি সংগঠন, সপ্তসুর শিল্পীগোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত থেকে করেছেন অভিনয়, আবৃত্তি, গান সবকিছুই। শিল্পকলায় ২ বছর নাট্যশিক্ষার কোর্স করেছেন, গান শিখেছেন, কুমারখালী সংগীত বিদ্যালয়ে একবছর নাচ শিখে চতুর্থ স্থানও পেয়ে গেছেন। তবে যা কিছু করেছেন সবকিছু থিয়েটারের জন্যই। কারণ, থিয়েটার করতে এধরনের সব বিদ্যাই জানতে হয় কিছু কিছু। তারপর একটু বড়ো হলে কুষ্টিয়ার বোধন থিয়েটারে যুক্ত হয়ে থিয়েটার চর্চার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ফেলেন নিজেকে। কিন্তু চাকরি করার জন্য পাড়ি জমাতে হয় মহানগর ঢাকায়। ঢাকায় এসে নিজেকে সম্পৃক্ত করেন ‘পালাকার’ নাট্যদলের সঙ্গে ২০০২-এর আগস্ট মাসে।
পালাকারে তখন তিনি নতুন। পালাকারের কর্ণধার আমিনুর রহমান মুকুল দায়িত্ব দেন ক্লাস অ্যাক্ট পরিচালনার জন্য। দু’জন-তিনজনের দল করে শিশুদের পাঠ্যপুস্তক থেকে গল্প নিয়ে ছোটো প্রযোজনা তৈরি করা যা বিভিন্ন স্কুলের ক্লাসরুমে শিক্ষার্থীদের সামনে পরিবেশিত হবে। এই প্রজেক্টে টুনটুনি ও কোলাব্যাঙ, হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা, দৈত্য ও খেলার সাথি এবং অনারেবল টাইগার নামে ৪টি প্রযোজনা দাঁড় করান যা পরবর্তীসময়ে একটি বিদ্যালয়ের ক্লাসরুমে এবং পরে নানা ইভেন্ট ও সামাজিক অনুষ্ঠানে প্রদর্শিত হয়। এরপর পালাকারের মুক্তাঙ্গন প্রযোজনা ‘তাইরালির বুকে মিজু মুন্সির পাও’ নাটকে অভিনয় করেন এবং মঞ্চনাটক ‘মানগুলা’র কাজ শুরু হলে সেখানে ইংরেজ দারোগা, পাকিস্তানি পুলিশ, হাজং সম্প্রদায়বাসীসহ বেশ কয়েকটি চরিত্রে অভিনয় করেন। দিলু রোডে পালাকারের নিজস্ব স্টুডিও থিয়েটারের জন্যও নাটক লেখা, নির্দেশনা দেওয়া ও অভিনয় করা চলতে থাকে সমান তালে, যা প্রতি বৃহস্পতি ও শুক্রবারে পালাকারের নিজস্ব স্টুডিওতে টিকেটের বিনিময়ে প্রদর্শন করা হতো। পালাকারের নিয়মিত নাট্যপাঠ আয়োজনে তখন রবীন্দ্রনাথের ‘ডাকঘর’, সেলিম আলদীনের ‘বাসন’-এর পাঠ ও আলোচনা চলার সময় একদিন আমিনুর রহমান মুকুল ‘ডাকঘর’ নাটকের নির্দেশনা দিতে বললেন।
শুরু হলো নতুনভাবে রবীন্দ্রনাথ ও ‘ডাকঘর’ পড়া। রবীন্দ্রনাথের যত লেখা ‘ডাকঘর’ লেখাকালীন বা অন্যরা যে যা লিখেছেন ‘ডাকঘর’ নিয়ে এবং রবীন্দ্রনাথের অন্যান্য আর যত কাছাকাছি বিষয়বস্তুর নাটক সব কিছু গভীরভাবে পড়া, আলোচনা করা ও তর্কবিতর্কে মেতে গেল শামীম সাগরের নেতৃত্বে পালাকার বাহিনী। শামীম সাগর বেশ কিছু নাট্যকর্মশালা ও বোধন থিয়েটারে নাট্যচর্চার অভিজ্ঞতা থেকে জেনেছেন কীভাবে একটা টেক্সটকে ভিন্ন ভিন্ন আঙ্গিক থেকে দেখা যেতে পারে। সাবটেক্সট নিয়ে কাজ করা কিংবা রবীন্দ্রনাথ কোন ভাবনা থেকে লিখেছেন এসব নিয়ে ভাবতে ভাবতে আবিষ্কার করলেন এ নাটক তো মোটেই কষ্টের নাটক নয়, বরং মৃত্যুর মধ্য দিয়ে মুক্তিকেই বোঝানো হয়েছে। তেমনি ঠাকুরদার একটি সংলাপ থেকে মাথায় এলো সব চরিত্র আসলে ঠাকুরদা নিজেই এবং রাজা হিসেবেই ঠাকুরদার আবির্ভাব যদি হয় শেষে ? রবীন্দ্রনাথের অন্যান্য নাটকে রাজার ভূমিকা কী সে নিয়েও তারা বিস্তর আলোচনা করেছেন। যেহেতু রূপক নাটক তাই রিয়েলিস্টিক কোনো উপস্থাপনে যাবেন না এমনই ভেবে নিলেন। বেইলি রোডের পালাকার স্টুডিও থিয়েটারের যে স্পেস সেটাকে থ্রাস্টের মতো করে কীভাবে নতুন আঙ্গিকে ব্যবহার করা যায়, নির্দেশনার সময় এ বিষয়টিও ভাবনার মধ্যে রেখেছেন। আর রবীন্দ্রনাথের রঙ্গমঞ্চের কনসেপ্ট নিয়ে যে অভিমত যে ইউরোপীয় আঙ্গিক নয় বরং আমাদের দেশীয় যাত্রার ঢঙে যে মঞ্চসজ্জা, যেখানে ভাব, ভঙ্গি অভিনয়ই মূল শক্তি দৃশ্যকে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার জন্য, সেখানে মঞ্চ আয়োজন যত কম পরিমাণে রাখা যায়Ñ এ সমস্ত চিন্তার এবং আয়োজনের যে সম্মিলিত ফসল ডাকঘর নাটক, তা দেশে বিদেশে নাট্যবোদ্ধা ও দর্শকদের মনে স্থান করে নেয়। অভিনেতা আর কলাকুশলীদের আন্তরিক প্রচেষ্টায় শামীম সাগরের ডাকঘর হয়ে ওঠে হৃদয়গ্রাহী ও অনন্য এক প্রযোজনা।
পালাকারের হয়ে এরপর নির্দেশনা দেন সেলিম আলদীনের ‘বাসন’, রবীন্দ্রনাথের ‘রথের রশি’ ও সৈয়দ ওয়ালিউল্লার লেখা ‘উজানে মৃত্যু’ নাটকের। পাশাপাশি পালাকারের সবক’টি প্রযোজনায় অভিনয় করে চলেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের ‘ছিন্নপত্র’ অবলম্বনে সৈয়দ শামসুল হকের লেখা ‘বাংলার মাটি বাংলার জল’ নাটকে রবীন্দ্রনাথের চরিত্রে অভিনয় করে বাংলাদেশ ও ভারতে বহুল সুনাম অর্জন করেন। পালাকারের ‘বায়ান্ন বাজার তেপ্পান্ন গলি’, ‘কালবেলা’, ‘নারীগণ’, ‘রুদ্র রবি ও জালিয়ানয়ালাবাগ’ প্রভৃতি নাটকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় অভিনয় করছেন।
পালাকার ছাড়াও শামীম সাগর ঢাকা ও ঢাকার বাইরের বিভিন্ন নাট্যদলে নাট্যনির্দেশনার কাজ করে চলেছেন নিয়মিত। নিয়মিত প্রশিক্ষণ ও নির্দেশনা দিচ্ছেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইইউবিতেও।
প্রায় ৩০ বছর ধরে থিয়েটারে যুক্ত থেকে শামীম সাগর নির্দেশনা দিয়েছেন অনেক নাটকের। লিখেছেন এবং অভিনয়ও করেছেন প্রচুর, যার তালিকা দিয়ে এখানে শেষ করা যাবে না। নির্দেশনা দিয়েছেন ৩৬টি নাটকের, লেখা ও নাট্যরূপ ২৮টি নাটকের এবং অভিনয় করেছেন ২৩টি প্রযোজনায়। টেলিভিশন মিডিয়ার জন্যও লিখেছেন বেশকিছু ধারাবাহিক ও একক নাটক। সুযোগ পেলে লেখেন নাট্যসমালোচনাও।
বাংলাদেশে থিয়েটারচর্চা নিয়ে বলতে গিয়ে প্রসঙ্গত বেশ কিছু আক্ষেপের সুর কানে বাজলো। ছেলেবেলায় যে পরিম-লে বড়ো হয়েছেন শামীম, সেই সাংস্কৃতিক পরিবেশ এখন কুষ্টিয়া কেন, দেশের কোনো জায়গাতেই নেই, এমনকি স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষও উদাসীন এসব কর্মকা-ের প্রতি আর সরকারের উদাসীনতা তো রয়েছেই। সাংস্কৃতিক-চর্চার অভাবে সেখানে আজ জায়গা নিয়েছে ধর্মান্ধতা ও আত্মকেন্দ্রিকতা। থিয়েটারচর্চাও যেভাবে চলছে দেশে এভাবে কিছুতেই চলতে পারে না। কোনো সাংস্কৃতিক চর্চাই পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া টিকে থাকতে পারে না। সম্রাট আকবরের পৃষ্ঠপোষকতায় যেমন ছিলেন নবরত্নে তেমিনি দেশের খেলাধুলা, থিয়েটার এসব ক্ষেত্রেও দরকার সরকারি ও বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতা। পুঁজিবাদী সমাজে সবই যখন পণ্য, তখন এই বাস্তবতাকে এড়িয়ে না গিয়ে বরং সময়োপযোগী চিন্তার সাথেই চলতে হবে। নীতিবাক্য দিয়ে আসলে কোনো কাজ হবে না। এ প্রজন্মকে যুক্ত করতে হলে তাদের মতো করেই ভাবতে হবে। আর তা না হলে থিয়েটারের ধস ঠেকানো যাবে না। তবে শামীম সাগর এটাও বলেন, দুটো মানুষ যতদিন থাকবে [একজন দর্শক, একজন অভিনেতা] ততদিন থিয়েটার বেঁচে থাকবে, থিয়েটার এমনই এক জাদুকরী জায়গা।
লেখা : ইভা আফরোজ খান
সাগরসমগ্র
নির্দেশক, নাট্যকার, মঞ্চাভিনেতা
জন্ম : ১৯ জুন ১৯৭৪, কুষ্টিয়া
বাবা : শামসুল হুদা [বীর মুক্তিযোদ্ধা, আইনজীবী ও সমাজসেবী]
মা : আনজিয়া বানু
শিক্ষা : স্নাতকোত্তর, হিসাব বিজ্ঞান ও উন্নয়ন বিদ্যা
স্ত্রী : আজিজুন্নাহার রূপা
সন্তান : শেখজাদা প্রিয়ঙ্কর শুদ্ধ
থিয়েটার দল : পালাকার [ঢাকা], বোধন থিয়েটার [কুষ্টিয়া]