ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো ছিলেন আর্জেন্টিনার একজন বিখ্যাত বুদ্ধিজীবী, উঁচু মানের লেখক, সাহিত্য সমালোচক এবং নারীবাদী আন্দোলনের অন্যতম নেতৃ। ওকাম্পো স্প্যানিশ ভাষায় প্রকাশিত আর্জেন্টিনার বিখ্যাত সাহিত্য পত্রিকা ‘সুর’-এর প্রতিষ্ঠাতা ও সম্পাদক ছিলেন। তিনি লাটিন আমেরিকার মতো এত বড়ো একটি জায়গায় ‘সুর’ ও তার নিজের কর্মে হাজারো মানুষকে উজ্জীবিত করেছিলেন। সুর পত্রিকার সংস্কৃতির সকল ভূমিকায় তার গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। এ পত্রিকায় যারা লিখেছেন গ্যাব্রিয়েলা মিস্ত্রালের, ওয়ান্ডো ফ্রাংক, হেনরি মিলার, টি.এস. এলিয়ট, টমাস মান, আঁর্দ্রে মালরো-এর মতো লেখকগণ।
আমেরিকাতে এমন কাজ এর আগে কেউ করেননি। ল্যাটিন আমেরিকায় সাহিত্য-আন্দোলনকে কেন্দ্র করে বহু পত্রপত্রিকা বের হয়েছে কিন্তু সাহিত্য-আন্দোলনের পত্রিকা হিসেবে আর কোনো পত্রিকা এভাবে উচ্চাঙ্গে পৌঁছায়নি। যারা সে সময়ে ‘সুর’-এর সাথে জড়িত ছিলেন একনিষ্ঠভাবে তারা প্রায় সকলেই বিশ্বব্যাপী পরিচিতি পেয়েছেন। এদের ব্যক্তি, সামাজিক, সর্বোপরি বিশ্ববোধ, ব্যক্তি রুচিবোধ এবং মনন গঠনে ‘সুর’-এর ভূমিকা ছিল যথেষ্ট। সংস্কৃতির বিভিন্ন জগতে রবীন্দ্রনাথ যেভাবে কাজ করেছেন মানুষের সৃষ্টিশীল লেখার পাশাপাশি মানুষের রুচি গঠনে, একই ভাবে ওকাম্পো ও সৃষ্টিশীল লেখা, রুচি ও মনন গঠনে কাজ করে গেছেন নিরন্তর। এ জায়গায় তাদের যথেষ্ট মিল রয়েছে, যা সুদূরের ইঙ্গিত করে। কবি রবি এবং ওকাম্পো দুজনেই বেড়ে উঠেছিলেন তথাকথিত প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার বাইরে বৃহৎ পরিম-লে সংস্কৃতির শিক্ষণ ও দীক্ষণের মধ্য দিয়ে। কবি রবি ও ওকাম্পো দু’জনেই নিজেদের দীক্ষা নিজের মধ্যে পুষে রাখেননি অহং বোধে। যে দান পেয়েছিলেন সে দান অকাতরে বিলিয়ে দিয়েছিলেন মানুষের মাঝে জাতি, ধর্ম নির্বিশেষে। দু’জনের মধ্যে আরো একটি মিল ছিল যে, তারা দু’জনেই বনেদি পরিবারের ছিলেন।
রবির সাথে ওকাম্পোর প্রথম সাক্ষাৎ ১৯২৪ খ্রিষ্টাব্দে হলেও, আত্মা ও মননে রবীন্দ্রনাথকে যেমন গ্রহণ করেছেন তেমনি চেতনে, হাড়ে, মজ্জায় কশেরুকায় বুনেও নিয়েছিলেন বহুদিন আগে। তিনি বহু লেখকেরই ভক্ত ছিলেন, আর এদিকে গান্ধী, নেহেরু আর রবির ভক্তও ছিলেন বেশ। তিনি বিশেষভাবে ভার্জিনিয়া ওলফ ও গ্যাব্রিয়েল মিস্ত্রাল-এরও ভক্ত ছিলেন। তিনি নিজ জীবনে দান্তের দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। তিনি যখন দান্তে, বেয়াত্রিচকে নিয়ে লিখতে শুরু করলেন তখন তার নিজের জীবনই সংঘাতের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল।
এমন সময়েই রবির ‘গীতাঞ্জলি’ ওকাম্পোর জীবনে এক আশীর্বাদ নিয়ে এলো। সেটা ১৯১৪ হবে। রবীন্দ্রনাথের আধ্যাত্মিক কবিতাগুলো তার এলোমেলো জীবনে একটা শান্তির পরশ ছুঁইয়ে দিলো। তারপর জীবনের বহু বছর কেটে গেছে রবির বইয়ের ওপর মাথা নুইয়ে পড়তে পড়তে। মাথা তুলে দেখতেই লা নেশন পত্রিকায় চোখ পড়ে নোবেল বিজয়ী ভারতীয় লেখক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পেরুর জাতীয় উৎসবে যোগদানের জন্য আর্জেন্টিনা হয়ে যাবার পথে কয়েকদিন বুয়েন্স এয়ার্সে থাকবেন। সংশ্লিষ্টগণ এভাবেই আশা পোষণ করছিলেন।
লা নেশন পত্রিকায় ওকাম্পো সাহিত্য নিয়ে লেখালেখি করেন। তিনি দান্তে, রাসকিন ও গান্ধীকে নিয়ে লিখেছিলেন। তিনজনই ছিলেন তার শ্রদ্ধার।
তিনি জানতে পারলেন সেপ্টেম্বরে রবি বুয়েন্স এয়ার্সে আসবেন। তখন থেকেই তিনি ভাবছেন এত অল্প সময়ে তার সাথে কি দেখা হবে! প্রত্যাশায় যেন চির ধরে যায় তবুও বিশ্বাস রবির সাথে দেখা তো হতেই হবে। ওকাম্পো নিজেকে বইয়ের মধ্যে ডুবিয়ে দেন। নিজেকে প্রস্তুত করতে বসে যান রবীন্দ্রনাথের সামনে কীভাবে নিজেকে উপস্থাপন করবেন। ঘরের দরজা বন্ধ করে রবীন্দ্রনাথের রচনা পড়ে যাচ্ছেন। আর অপেক্ষায় আছেন কখন আসবে সে মাহেন্দ্রক্ষণ। সেসময় সান ইসিদ্রোজুড়ে বসন্ত, স্বচ্ছ চারদিক, গোলাপের গন্ধ শুঁকে আরাধ্য কবি রবির লেখায় মনোযোগ। তার কথা ভেবে যেন তাকে সামনে রেখেই সকালের সময়টা কাটিয়ে দিত সে কক্ষে। কবির কাছে কল্পিত চিঠি লিখতে বসে যেতেন। সে চিঠিতে থাকতো কবির লেখাসমস্তের ব্যাখ্যা। সব শেষে লেখা নিবন্ধগুলো লা নেশনে পাঠাতেন। এভাবেই রবিকে আত্মস্থ করতে লাগলেন। তার ‘গীতাঞ্জলির’ কবিতা ওকাম্পোর কাছে অমৃত হয় উঠলো এবং রবির কবিতাসমূহ মানুষের জীবনে স্বস্তি ও শান্তির বাণী মনে করলেন। বিশেষ করে রবীন্দ্রনাথের আধ্যাত্মিক কবিতাগুলো ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোকে এক মোহময় প্রাণশক্তি দিয়েছিল।
মূলত রবীন্দ্রসাহিত্যের গুণমুগ্ধ পাঠকা ছিলেন ওকাম্পো বহু আগে থেকেই। রবির ‘গীতাঞ্জলি’কাব্য ততদিনে বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে। ওকাম্পো একাধারে ইংরেজি, ফরাসি ও স্পেনিশসহ এ তিন ভাষাতেই পারদর্শী। ফলে ‘গীতাঞ্জলি’ পড়ে ফেলেছেন, বেশ কিছু কাব্যও একাধিকবার পড়েছেন। আঁদ্রে জিদের ফরাসি ভাষায় অনুবাদকৃত ‘গীতাঞ্জলি’ তার দারুণ প্রিয়। ওকাম্পো তার কবিতা পড়ে উত্তেজনায় শিহরিত হতেন, থরথর করে কেঁপে উঠতেন। কখনো কেঁদে ফেলতেন। এ প্রসঙ্গে ওকাম্পো বলছিলেন, ‘আমার গানের শিক্ষক বললেন কেন কাঁদছ, তাকে কি করে বোঝাই, কেন কাঁদছি। কিছুই তো হয়নি’।
এখানেই রবীন্দ্রনাথের লালিত লাবণ্যের সৌকুমার্য। ‘সত্যি তো কিছু হয়নি’ মানে...
রবি’র সেই গান
কাঁদালে তুমি মোরে, ভালোবাসারই ঘায়ে...
নিবিড় বেদনাতে...
তোমার অভিসারে.... চলিতে পথে পথে...
পরাণে বাজে বাঁশি, নয়নে বহে ধারা।
গমন যদি যাওয়া হয়, অগম মানে যেখানে যাওয়া যায় না। অভিসার অর্থ যদি হয় যাওয়া [গোপনে মিলন বা দেখা হওয়া] কিন্তু যাওয়া ততটা নয়, যতটা যেতে চাওয়া। তাই তো কিছু বলার নেই। মন তো চাইছে কিন্তু...
এ মনস্তত্ত্বের দুঃখ ও আনন্দের নান্দনিক রসবোধ।
পেরুর উদ্দেশে রবীন্দ্রনাথের যাত্রা এবং ওকাম্পোর সাথে দৈব সাক্ষাৎ
পেরুর স্বাধীনতা-সংগ্রামের শতবার্ষিক অনুষ্ঠানে নিমন্ত্রিত অতিথি রবীন্দ্রনাথ অনুষ্ঠানে যোগ দিতে হারুনা মারু জাহাজে চেপে বসেন, দিনটি ছিল বৃহস্পতিবার (৬ নভেম্বর ১৯২৪)। বুয়েন্স এয়ার্সে ডক ভিড়লো ঠিকই কিন্তু পথের মাঝেই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়াতে তাকে আর্জেন্টিনার বুয়েনোস আইরেসের একটি হোটেলে উঠতে হলো। ওকাম্পো জানতে পেরে তার এক বন্ধুকে নিয়ে হোটেলে উপস্থিত হন, রবির সাথে দেখা করেন এবং তাকে দেখে স্তম্ভিত হয়ে যান। রবির চোখ, সরু নাক, ঠোঁট, দাড়ি, গোঁফে ঢাকা শুভ্র পাকানো সাদা চুল, চওড়া কাঁধে প্রায় ছ’ফুট লম্বা এক শুদ্ধ বহু কাক্সিক্ষত আরাধ্য মানুষ তার সামনে। সব কিছুই যেন ঘোর লেগে গেল।
সেক্রেটারি এলমহার্স্টের সাথেও কথা বলেন, এলমহার্স্ট রবির সাথে দেখা করিয়ে বাইরে চলে যান। এটা রবি’র সাথে প্রথম দেখা ওকাম্পোর। লজ্জায় কী বলবেন বুঝে উঠতে না পারায় মনে হচ্ছিল তার এখনি পালিয়ে যাই। কিন্তু না পালিয়ে রবির কথা শোনেন।
যেহেতু রবি অসুস্থ সেহেতু এলমহার্স্টকে তাৎক্ষণিকভাবে সিদ্ধান্ত দেন যে, রবীন্দ্রনাথের এ মুহূর্ত শহরের কোলাহল থেকে একটু দূরে শান্তিময় কোনো আশ্রয় স্থল প্রয়োজন, যেখানে তিনি স্বস্তি বোধ করবেন। ওকাম্পো বেরিয়ে যান হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়ান। স্বর্গ, মর্ত্য একাকার করে ফেললেন বাড়ি দেখতে দেখতে। কিন্তু বাড়ি পাওয়া মুশকিল হয়ে ওঠে, বিশেষ করে ওকাম্পো যেমন বাড়িটি মনে করে আছেন রবির জন্য, তেমন বাড়ি।
অগত্যা না পেয়ে তিনি মা-বাবাকে বলেন, কিন্তু মা-বাবা বাড়ি ছাড়তে চান না অবশেষে তার এক কাজিনের বাড়ি পাওয়া গেল। বুয়েন্স এয়ার্সে সেখানেই একরকম জোর করে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে উঠলেন। বাড়িটির নাম ‘মিরালরিও’। মাত্র দু’দিনের মধ্যে এত বড়ো বাড়ির সাদা রং থেকে শুরু করে বাগানসহ সব, সবকিছু সাজিয়ে ফেললেন ওকাম্পো। বাড়িটি উঁচু খাড়া পাহাড়ে, দু’পাশে সবুজ ঘাসে মোড়ানো মাঠ, যার সৌন্দর্য অতুলনীয়। বাড়ি থেকে কয়েক পা আগালে প্লাতা নদীর তীর, অবর্ণনীয় সৌন্দর্য। এবাড়িতে প্রায় দু’মাস কাটিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। বাড়ির প্রাঙ্গণটি অপূর্ব সুন্দর। “প্রাঙ্গণে মোর শিরিশ শাখায় ফাগুন মাসে কি উচ্ছ্বাসে... ক্লান্তি বিহীন... ফুল ফোটানোর খেলা...”
১২ নভেম্বর রবিকে নিয়ে এ বাড়িতে যখন প্রবেশ করলেন সেদিন ওকাম্পোর কাছে পরিবেশের রূপ ছিল অপরূপ, সে বিকেলটা ছিল আকাশে ঘন মেঘ, কোথাও ধূসর, কোথাও কালো, কোথাও হলুদ থেকে ক্রমান্বয়ে কমলা রঙে ডুবে যাচ্ছে, কোথাও উজ্জ্বল সাদা, কোথাও মৃদু কোনো রঙের দোলা তার মধ্যে নদীটা হয়ে রইল আকাশের একমাত্র আয়না। এভাবেই প্রাঙ্গণ জুড়ে ক্লান্তিবিহীন ফুল ফোঁটানোর খেলা চলছিল বুয়েন্স এয়ার্সে। রবি আর বিজয়া এ বাড়িতেই দুই-আড়াই মাস কাটিয়েছেন, এখানেই ‘পূরবী’র সৃষ্টি, এখানেই পুরানো কাটাকুটি নতুন করে নব উদ্দ্যমে ছবি আঁকতে শুরু করা, এখানেই গভীর স্বরে গম্ভীর আলাপ, এখানেই, এই বাড়ির গাছতলা ছায়াশীতল সবুজ বাগানেই বহু কথোপকথন। এবাড়ির অলিন্দে বসেই প্লাতা নদীর রূপ অন্তরে গেঁথে রাখা।
ঘরে ঢুকতেই হাতে ধরে সোজা বারান্দায় দাঁড় করিয়ে দিলেন। রবিও দেখতে লাগলেন, তার সামনে প্লাতা নদী আর প্রাণের প্রকৃতি। বেগুনি আর নীলের মিশেল কুয়াশায় কত স্বপ্ন না বুনে গিয়েছিল দু’জনার চঞ্চল মনে। এমন নীলাভ ধূসর কুয়াশাচ্ছন্ন বিকেল আর কি ফিরে আসবে। এমন দিন ফিরে না আসলেও এ-সব কিছুই ফিরে আসবে ওকাম্পোর কাছে রবি’র কবিতা হয়ে। আর তা রয়ে যাবে যতদিন ওকাম্পো বেঁচে আছে।
তবে ওকাম্পোর কাছে রবির কবিতা দূরের মনে হয় না, এর প্রতিটি ধ্বনি ওকাম্পোর পরিচিত, এবং মর্মস্পর্শী, যেকারণে কবিতা পড়ে আনন্দে, কৃতজ্ঞতায় কেঁদেছেন বারবার। ওকাম্পোর ভাষায়... হে ঠাকুরের ঈশ্বর যিনি আমাকে কোনো কিছু থেকে আশ্রয় দিতে চাননি, আপনার এই বিস্মৃতি আমি কিছু মনে করিনি আপনি আমাকে কতটা ভালো করে চেনেন ! লুকায়িত ঈশ্বর জানেন আমি সর্বদা তার খোঁজেই আছি, করুণাময় ঈশ্বরই জানেন তার কাছে যাবার পথই হচ্ছে মুক্তির পথ। কী অসম্ভব শব্দ, কী তার ভার, কী তার অনুভূতি !
“দাঁড়ালেম তব সন্ধ্যা-নাগনের তলে
চাহিলাম তোমা পানে নয়নের জলে... ‘আবার আরেকটি গানে বলছে...
আমি বহু বাসনায় প্রাণপণে চাই
বঞ্চিত করে বাঁচালে মোরে
এ কৃপা কঠোর সঞ্চিত মোর
জীবন ভরে ....
না চাহিতে মোরে যা করেছ দান
আকাশ আলোক তনু মন প্রাণ
দিতে দিতে তুমি নিতেছ আমায়
সে মহা দানেরই যোগ্য করে
অতি ইচ্ছায় সন্তুষ্ট হতে
বাঁচালে মোরে...
প্রতিটা শব্দে যে আকুল মিনতি আর বিনয়... নিজেকে কীভাবে সমর্পণ করতে হয় তা তিনি শিখিয়েছেন। ‘আমি চাওয়ার আগেই আমাকে দান করে পুর্ণতা দিয়েছ, এত বিশাল আকাশ এই যে গাছগাছালি, পাহাড়, নদী এই যে দেখা এবং পাওয়ার আনন্দ আহা... কী সুন্দর
কত গভীর শব্দ... তুমি আমায় দান দিতে দিতে নিয়ে যাচ্ছ সেই মহা দানেরই যোগ্য করে। অবর্ণনীয়। ভাষায় প্রকাশ... অসম্ভব... ওকাম্পো মিরালরিও বাড়িটি রবির জন্য উপভোগ্য করে তুলেছিল নানা আয়োজনের মধ্যদিয়ে। রবির প্রয়োজনে সব কিছু করেছিল। দু’দিনের মধ্যে এত বড়ো বাড়িটি সাজিয়েছিল। নয়নাভিরাম বারান্দা। কবিতা লেখার উপযোগী নিভৃত পরিবেশের ব্যবস্থা করা, যখন সঙ্গ দেওয়া দরকার ঠিক তখনই, ভৃত্যকে রেখেছিল সার্বোক্ষণিক তার দেখাশোনার জন্য। রবির দর্শনার্থীদের সাক্ষাতের ব্যবস্থা করা, সেখানে কবি সাহিত্যিকদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়া। রবির পছন্দের জায়গাগুলো ঘুরে দেখানো। এসকল কিছুই করেছে ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো। রবির যেন কোনো অসুবিধে না হয় সে জন্য তার ব্যক্তিগত পরিচারিকা ফ্যানিকে পর্যন্ত নিয়োগ দিয়েছিলেন। ওকাম্পোর শেষ পর্যন্ত বাড়ি ভাড়া ও রবীন্দ্রনাথের অন্যান্য খরচ মেটাতে হীরার টিকলি বিক্রি করতে হয়েছিল। অথচ কখনো রবিকে বুঝতে দেননি। এই দান তো বলে কয়ে হয় না, দু’টি মানুষ একে অপরের কাছ থেকে কত দূর, দূরে। কেউ চেনে না কারোকে অথচ জীবনের সুর তাল লয় ছন্দ, সেও সব একই। একই সুরে বাঁধা, একই ছন্দে প্রকাশ।
সুর বাঁধতে হয়, মানুষেরা সুর বাঁধতে পারে না। তাই তারা জগতের সাত ছাঁদে বাঁধা থাকে, আর যারা সুরবেঁধে মুক্তি পায় তারা বিহঙ্গের মতো। মানুষের কাছে তারাই অমানুষ, বহিমিয়ান, তাদের বেঁধেও লাভ নেই, ছেড়েও ক্ষতি নেই। যে সুর নীলিমায় অবগাহন করে মুক্তির আনন্দে, সে পায় প্রাণের সঙ্গ। আর মানুষেরা সেই সুরই বেঁধে নেয়, আর মর্ত্যলোকে মিশে যায় জগতের কোলাহলে। তারা পায় আসঙ্গ। রবি, ওকাম্পো সুর বেঁধেছিলেন কেউ কারোকে না চিনেই। বেঁধেছিল আপন তাগিদেই। তাই দু’জনের সৃষ্টশক্তি এজগতে মহৎ হয়ে রয়ে গেল।
রয়ে যাবে ‘রক্ত করবী’, রয়ে যাবে ‘পূরবী’, রয়ে গেছে তার ওপর ভুল শব্দে দাগাদাগি, কাটাকুটি আর কাটাকুটি থেকে শুরু হোলো পুঁজিবাদী সাম্রাজ্যবাদের আগ্রাসন এবং যুদ্ধের হিংস্রতা, মানুষের আদল না হয়ে, হয়ে গেল জানোয়ারের, তাও সব অদ্ভুত অচেনা। সত্যিকার অর্থেই তো আমরা তো আমাদের ভেতরের জানোয়ারটাকে চিনি না এইসব এলোমেলো দাগ কাটতে কাটতেই একদিন হয়ে উঠলো অনেক অনেক ছবি আড়াই থেকে তিন হাজার...। এবিষয়েই ছোট্টো করে বিজয়া বলছিলেন, “রবীন্দ্রনাথের এই আঁকাআঁকিতেই মুগ্ধ হলাম,তাকে একটু উসকেও দিলাম।”
আর এর ভিতর দেখতে না দেখতেই সময় চলে গেছে প্রায় ছয়, সাত বছর তো হবেই। তারপর যখন তার সাথে আমার আবার দেখা হলো তখন তার কাটাকুটি ছবিতে পরিণত হয়েছে, যা বিশ্বমানদ-ে রাখা যায়। আর এই বিশ্বমানদ-ে তিনি এসেছেন সাধনায় সাধক হয়ে।
রবীন্দ্রনাথ মূলত একজন সাধক। কোনো সাধক মানুষ বেশি সময় ধরেই কিছু শুনতে পায় না। ওই সময়ে তারা তাদের সুরে আচ্ছন্ন থাকেন, যখন তারা নিজ আত্মায় আত্মস্থ থাকেন তখন চলার পথের এই পরিক্রমায় যত ভালোবাসার মানুষই হোক না কেন তার কণ্ঠও সাধকের কান অব্দি পৌঁছায় না, তবে এ বিষয়ে যারা জানে না তারা কষ্ট পান ভীষণ, কিন্তু সাধকের কিছু করারও থাকে না। তিনি মশগুল হয়ে থাকেন তার আপন গহিনে। ওকাম্পো রবিকে এভাবেই বুঝতে পেরেছিলেন, রবির কাছে লেখা ওকাম্পোর চিঠিতে এমন অনেক কিছু উঠে এসেছে। তবে সমসাময়িক সংসার এবং ভালোবাসার পাত্র-পাত্রীদের, বন্ধু-স্বজন যেই হোক তাদের জন্য শিক্ষণীয় ও বোধের জায়গা তৈরিতে যথেষ্ট সহায়ক ওকাম্পো ও রবির পত্রাবলি। রবি ও ওকাম্পোর চিঠি এবং জীবনাচরণ অনেক বড়ো সম্পদ বলে মনে করি এযুগের মানুষের জন্য। জীবনের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে এখন অনেকেই বলেন, “ও আমাকে বুঝলো না, এ আমাকে বুঝলো না।” সাধারণের কথা বলি, একজন মানুষ আর একজন মানুষকে চিনতে পারে ঠিকই কিন্তু বুঝে উঠতে পারে না। বুঝে ওঠা সহজ নয়। ওকাম্পোর একটা চিঠিতে রবিকে লিখছে। “আমি আপনার সামনে এতটাই লাজুক হয়ে পড়ি যে, আপনার সামান্য অসুন্তুষ্টি হচ্ছে ভাবলেই আমার ভাবনা-চিন্তাগুলো এলোমেলো হয়ে যায়, জট পাকিয়ে যায়।”। আরো লিখেছে, “আপনার মন এমনভাবে সুরে আচ্ছন্ন, নিজের আত্মায় আত্মস্থ যে, আপনার চলার বাইরের কোনো সংগীত আপনার কানে আসে না। কিন্তু কে সেটা এমন করে ভাবে ? আমি খুব চিন্তা করে দেখেছি আমি যখন কোনো কিছুর প্রতি তীব্র্র ভালোবাসায় আচ্ছন্ন থাকি, তখন বাইরের কোনো ভালোবাসার শব্দ কানে আর আসে না।” আসলে আপনি যখন কোনো কিছুর প্রতি তীব্র আকর্ষণ বোধ করবেন তখন আপনি পরিপূর্ণ, সেখানে এক তিল জায়গাও থাকবে না, থাকার কথা নয়। তাই সেখানে আর নতুন পুরাতন কোনো ডাক ! না শোনারই কথা।
ওকাম্পোর কিছু কথা ও রবি’র স্মৃতি...
রবীন্দ্রনাথ যখন বাংলায় আবৃত্তি করতেন তখন সেটা গান হয়ে উঠতো আমার কাছে। শব্দগুলো এতো বিশুদ্ধ উচ্চারণ করতেন যে আমি কিছু শব্দ স্মৃতিস্থ করে পুনরুচ্চারণ করতে পারতাম।
আমি শুধু তোমার মুখে উন্মুখ হয়ে সারাক্ষণ কাটাতে পারি, সবার মধ্যে তোমাকে পাই না, তাই সবার সামনে কথা বলা হয়ে ওঠে না। আমি লাজুক হয়ে উঠি। খেই হারিয়ে ফেলি তোমার পানে তাকিয়ে সব শুনতে পারি সময়ের পর সময় ধরে। নীরবে বুঝতে পারি। আমি অনেক আনন্দিত এই ভেবে যে, আমি তোমার অনেক কাছে। একই সাথে বেদনায় ভারাক্রান্তও বটে যে, আমি তোমার কাছে শুধু ভিন দেশি আগন্তুক। অবশ্য তাতে কিছুই যায় আসে না, আমি অনেক পেয়েছি তোমার কাছে যা তুমি নিজেও জানো না। সে ভালোবাসায় নিজেকে পরিপূর্ণ মনে হয়। আর আমি নিজেকে যত বেশি আপনার কাছে সমর্পণ করবো, যতবেশি নিজেকে বিলিয়ে দেবো, তত বেশি ঋণী হবো আর এ যাবত যা দিয়েছি তা আমার কিছু নয়, সে আপনারই দান।
আমার ভালোবাসা এতটাই অনুভূতিপ্রবণ, এতটাই আবেগময়, এতটাই গভীর ও গম্ভীর অথচ মোলায়েম পশমি চাদরের মতো নরম এবং ন¤্র যা আপনার চরণদ্বয়কে রাখবে শীতল অনুভূতিতে।
আমি আমার চিন্তার হাত ধরে যতটা পথ হেঁটেছি শুধু তোমায় নিয়ে সেখানে তোমার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র শব্দ থেকে শুরু করে তোমার চিন্তার রূপগুলো বুঝে উঠেছি, অনিন্দ্য আনন্দে। আমার চিঠি পড়ে তুমি বলেছ আমি তোমাকে বুঝিনি। আমি উপরে উঠে তোমার সাথে দেখা করিনি আজকে। তখন আমার দু’চোখ ভরে জল ছিল, আমি ভীষণ কাঁদতে ছিলাম। আমি আহত ছিলাম আমাকে ক্ষমা কর। এমনকি শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল। আমি লজ্জিত ভীষণ। আমার জন্য তুমি লজ্জিত হবে এ অপরাধবোধ আমাকে বিধ্বস্ত করছে। আমাকে ভুল বুঝ না। তোমার সামনে এলে আমার ভয় হয় কথাও ঠিকমতো বলতে পারি না, কোনো অপরাধের ব্যাখ্যাও দিতে পারি না।
আমি তোমাকে সুখী দেখতে চাই, হয়তো এটা ভুল বোঝাবুঝির দিকে ঠেলে দেবে। কিন্তু আমার এ হৃদয় তোমাকে সুখী দেখতে চায়। যে পরিমাণ ব্যথা ও আনন্দ তুমি দিয়েছ আমায় সেসব উপহারের জন্য কখনোই ধন্যবাদ দিতে চাই না। যদি কখনো মনে কর আমাকে দরকার যে, তোমার আগ্রহের জিনিসগুলো গুছিয়ে দেবে। তবে আমাকে স্মরণ করো।
তুমি আমাকে যা দিয়েছ তার জন্য কৃতজ্ঞ। মনে রেখো গুরুদেব, তুমি যাকে রেখে যাচ্ছ, সে হৃদয়ের কথা বলিতে ব্যাকুল...
গুরুদেব আমি তোমাকে ভালোবাসি, কোনো কিছুই এটাকে বদলাতে পারবে না। আমাকে ক্ষমা কোর। মনে রেখো গুরু দেব, তুমি আমার সামনে থাকো আর দূরে থাকো তুমি আমার ভেতরেই থাকো। আমার ভালোবাসা এবং তোমার জন্য যতটুকুই করতে চাই, আর যতসামান্য যাই আছে তা তুমি গ্রহণ করে আমায় আরো একটু আনন্দ দেবে।
লেখক : চিত্রকর
চিত্র : লেখক . ছবি : ইন্টারনেট