প্রতিদিন আমাদের ব্যবহারের অন্যতম অনুষঙ্গ হলো ছাতা। আমাদের দেশে অবশ্য বর্ষাকালেই ছাতার ব্যবহার বেশি দেখা যায়। তবে, রোদ হোক কিংবা বৃষ্টি ছাতার কোনো বিকল্প নেই। সূর্য থেকে ত্বক কিংবা বৃষ্টি থেকে মাথা, আমাদের সর্বদা রক্ষা করে ছাতা। তবে এই ছাতার কিন্তু রয়েছে এক রাজকীয় ইতিহাস। সেই ইতিহাস কথা আজকের এই অঁভোগ আয়োজনে...
প্রাচীন এক রাজা তার উত্তরসূরি বেছে নেওয়ার এক অভিনব ব্যবস্থা করেছিলেন। তিনি তার পাঁচ ছেলেকে বৃত্তাকারে দাঁড় করিয়ে মাঝখানে একটি ছাতা ফেলার ব্যবস্থা করেন। তিনি প্রার্থনা করছিলেন যে, তার পছন্দসই সন্তানের দিকে যেন পড়ে ছাতাটা। এভাবে রাজা হলেন রাজপুত্র ওকসানা। তাকে সম্বোধন করার সময় বলা হতো, মহান রাজা যিনি ছাতার দৌলতে সিংহাসন লাভ করেছেন ! এটি ত্রয়োদশ শতাব্দীর ঘটনা। বিষয়টি কিন্তু বেশ মজার। কারণ, এটা থেকে বোঝা যায়, প্রাচীন যুগে ছাতাকে বেশ উচ্চ পর্যায়ের অনুষঙ্গ ভাবা হতো। শুধু রোদ বৃষ্টি ঠেকাতে নয়, রাজা বানাতেও পেরেছে এই ছাতা মশাই।
ছাতার ইংরেজি প্রতিশব্দ ‘আমব্রেলা’। ‘আমব্রেলা’ শব্দটি এসেছে লাতিন ভাষার মূল শব্দ ‘আমব্রা’ থেকে, যার অর্থ ‘ছায়া’। আর ‘ছাতা’ নামটি এসেছে লাতিন শব্দ ‘টগইজা’ থেকে, যার অর্থও ‘ছায়া’। আসলে প্রাচীন কালে যখন ছাতা তৈরি হয়েছে তা হয়েছিল রোদের হাত থেকে বাঁচতে।
তবে কে, কখন কবে ছাতা আবিষ্কার করেছিল, তা নিয়ে তর্ক-বিতর্ক রয়েছে। কারো মতে প্রাচীন মিশরীয়রা প্রথম ছাতা তৈরি করে, আবার কেউ বলে চীনারা ছাতা আবিষ্কার করেছে। তবে প্রায় চার হাজার বছর আগের ইতিহাস থেকে জানা যায়, মিশর, গ্রিস ও চীন দেশের চিত্রকর্মে ছাতার নিদর্শন রয়েছে। মিশরীয় চিত্রলিপি, সমাধি ও মন্দিরে আঁকা ছবি থেকে বোঝা যায়, খ্রিষ্টপূর্ব ২৫০০-২৪০০ অব্দের দিকে রাজা ও দেবতাদের ছায়া দানের জন্য চারকোণা সমতল ছাতা ব্যবহার করা হতো।
অতীতে কেবল অভিজাত ব্যক্তিরাই ছাতা ব্যবহার করতে পারতেন। পরিব্রাজক মার্কো পোলার কাহিনি থেকে জানা যায়, ১২৭৫ খ্রিষ্টাব্দে কুবলাই খানের দরবারে তিনি দেখেছেন সেনাপতির মাথার ওপর সম্মানসূচক ছাতা মেলে ধরা হয়েছে। রাজছত্রের ব্যবহার চীন থেকে রপ্ত করে জাপান ও কোরিয়া। প্রাচীন কোরিয়াতে রাজার ছবি আঁকা যেত না। রাজার উপস্থিতি বোঝাতে ঘোড়ার ওপর রাজছত্রের ছায়া আঁকতেন শিল্পীরা।
আমাদের উপমহাদেশেও প্রাচীন কালে রাজছত্র ব্যবহার হতো। ৩০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের বৌদ্ধদের প্রাচীন গ্রন্থ থেকে জানা যায়, সে যুগে এই ভূমিতে ছাতা ব্যবহৃত হতো। ভারতীয় রাজারা ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে রাজছত্র ব্যবহার করতেন। অজন্তা গুহার দেয়াল-চিত্রে ছাতার ছবি আছে। খ্রিষ্টীয় নবম শতকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় রাজছত্রের প্রচলন ঘটতে থাকে। সে সময় কম্বোডিয়া, লাওস, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম এবং জাভার বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ রাজছত্র ব্যবহার করতে শুরু করেন। তবে, ভারতে আধুনিক ছাতার আবির্ভাব হয় ইউরোপীয় ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে। রাজসিংহাসনের দু’পাশে দু’জন রাজকর্মচারী ছাতা ধরে থাকত। মুঘল স¤্রাটের মাথায় ছাতা ধরে রাখত দু’জন কর্মচারী। মারাঠা বীর শিবাজির উপাধি ছিল ‘ছত্রপতি’।
ভারতে প্রথম ছাতার কারখানা তৈরি হয় ১৯০২ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ জুলাই মুম্বাইয়ে। আর বাংলায় ছাতার পথিকৃৎ তো মহেন্দ্রলাল দত্ত। অবশ্য পৃথিবীতে প্রথম ছাতার দোকান হলো ‘জেমস স্মিথ অ্যান্ড সন্স’ যা ১৮৩০ খ্রিষ্টাব্দে চালু হয়। দোকানটি ৫৩ নিউ অক্সফোর্ড স্ট্রিটে আজও চালু আছে।
প্রাচীন গ্রিস এবং রোমে ছাতার ব্যবহার শুরু হয় খ্রিষ্টপূর্ব ১০০০ অব্দে। তখন ছাতা ছিল কেবল মহিলাদের প্রসাধনী সামগ্রীর অন্তর্ভুক্ত। এসময়ই প্রথম ছাতা বন্ধ করে রাখার কৌশল আবিষ্কৃত হয়। চাকরেরা তাদের মনিবের পাশাপাশি হাঁটত আর তাদের মাথার ওপর ছাতা ধরে রাখত। ব্যবহারের পর ছাতা বন্ধ করে স্টোরে রেখে দিত। আমাদের দেশেও এককালে জমিদারদের মাথায় এমন করে ছাতা ধরার চল ছিল। বাংলাদেশে অতীতে আমজনতা ছাতা ব্যবহারের অধিকার রাখতেন না। গ্রামের বিত্ত ও ক্ষমতাবানরাই কেবল ছাতা ব্যবহার করতে পারতেন। অন্যদিকে জমিদার বাড়ির সামনে দিয়ে ছাতা মাথায় যেতে পারতেন না সাধারণ মানুষ। বিশেষ করে হিন্দু জমিদার বাড়ির সামনে দিয়ে ছাতা মাথায় যাওয়া মুসলমান প্রজাদের জন্য কঠোরভাবে নিষেধ ছিল।
সময়ের সাথে সাথে প্রাচীনকালের ছাতা অসংখ্যবার পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে আজকের আধুনিক অবস্থায় পৌঁছেছে। এখন ছোট্টো পকেট-ছাতা খুব জনপ্রিয়। শোনা যায়, ১৭১৫ খ্রিষ্টাব্দে মারিয়াস নামে এক পারসি নাগরিক পকেটে বহনযোগ্য ছাতা তৈরি করেন। তবে আধুনিক পকেট-ছাতা তৈরি করেন জার্মানির হ্যান্স হপ্ট ১৯২৮ খ্রিষ্টাব্দে। এই ছাতা পুরুষদের ক্ষেত্রে ‘লর্ড’ ও স্ত্রীলোকদের ক্ষেত্রে ‘লেডি’ নামে খুব জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। ১৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দে ওহিও-র বাসিন্দা ব্র্যাডফোর্ড ফিলিপস আধুনিক ফোল্ডিং ছাতার প্রথম পেটেন্ট করেন। ১৯৯১ খ্রিষ্টাব্দে তাইওয়ানের নাগরিক সুন ইউ সাং হাতলে একটা ছোট্টো বোতাম টিপে ছাতা ভাঁজ করার কৌশল আবিষ্কার করেন।
ভিক্টোরিয়া যুগের ছাতা ছিল খুব ভারি। সহজে বহন করা যেত না। এর কারণ ছাতার রিব ও ডাঁটি তৈরি হতো তিমির হাড় বা কাঠ দিয়ে। ১৮৫২ খ্রিষ্টাব্দে ইংল্যান্ডের স্যামুয়েল ফক্স [১৮১৫-১৮৮৭] ‘ট’ আকৃতির স্টিলের ডাঁটি ও রিব সমন্বিত ছাতা তৈরি করে ছাতার দুনিয়ায় বিপ্লব আনেন। ১৯৬০ খ্রিষ্টাব্দে প্রথম পলিয়েস্টার কাপড়ের ছাতা তৈরি হয়। দ্রুত শুকিয়ে যাওয়ার জন্য এই ছাতা খুব জনপ্রিয় হয়। গত শতকের শেষ পর্ব থেকে ছাতার সাবেকি কালো রং ছাড়াও নানা বাহারি রঙের ছাতা তৈরি হচ্ছে। ছাতার রিব ও দ- তৈরি হচ্ছে অ্যালুমিনিয়াম বা ফাইবার দিয়ে। ১৮৫২ খ্রিষ্টাব্দে গেজ নামে এক ফরাসি নাগরিক স্বয়ংক্রিয়ভাবে ছাতা খোলার সুইচ আবিষ্কার করেন। বর্তমানে এই সুইচের আধুনিকিকরণের পর বেড়েছে এমন ছাতার সমাদর। ডিজাইনেও এসেছে অনেক পরিবর্তন।
বিশ শতকের শুরুর দিক থেকে মহিলাদের কাছে ছাতা ফ্যাশনেবল উপকরণের বদলে মূলত বৃষ্টি থেকে মাথা বাঁচানোর যন্ত্র হিসেবে বিবেচিত হতে থাকে। ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে আবিষ্কৃত হয় পলিভিনাইল ক্লোরাইড দিয়ে তৈরি ছাতার স্বচ্ছ চাঁদোয়া। ১৯৫০-এর দশকে তেলতেলে সুতির কাপড়ের চাঁদোয়ার পরিবর্তে নাইলনের চাঁদোয়ার ব্যবহার শুরু হতেই এই ছাতা ব্যাপক জনপ্রিয় হয়। সেই জনপ্রিয়তায় আজও টান পড়েনি।
গ্রন্থনা : ফাতেমা ইয়াসমিন