[পূর্ব প্রকাশিতের পর]
ইরফানের কাছে আমি যখন ব্লা ব্লা অ্যাপস-এর নাম শুনি, আমি ভেবেছিলাম বুঝি সে মজা করে বলছে, এটা যে কোন অ্যাপসের নাম হতে পারে তা আমার ধারণার বাইরে ছিল। অবশ্য ঘর হতে দুই পা ফেলে বাইরে এলে কত কত নতুন ধারণার জন্ম হয়, একইসাথে পুরাতন অনেক ভুল ধারণার প্রাচীরও ভেঙে ফেলা সম্ভব হয়। খেতে খেতেই আমরা জেনেছিলাম যে, আমরা কোথায় অপেক্ষা করব, আগেই বলেছি ব্লা ব্লা অ্যাপসের মাধ্যমে আমাদের রিকোয়েস্ট একজন গ্রহণ করেছেন যিনি আমাদের বেলজিয়াম থেকে পিক করবেন। আমরা খাওয়া-দাওয়া শেষে হেঁটে হেঁটে বাস স্টপের দিকে রওনা হলাম, যদিও দুপুর তবে বিকেল তার ডানা মেলছে, শীতের বিকেল শুরু হতে-না-হতেই শেষ হয়ে যায়, এ সময়টাকে দুপুর-বিকেলের সন্ধিক্ষণ বলা যেতে পারে। আমাদের হাতে বেশ কিছু সময় থাকায় আমরা বাসে করে South Tour-এ গেলাম, এটি ব্রাসেলসের ভৌগোলিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ সাউথ রেলওয়ে স্টেশন-সংলগ্ন। South Tour মূলত ব্রাসেলস-এর সবচেয়ে উচু বিল্ডিং, ১৯৬২ সালে নির্মিত এই ভবনটি সে সময় ইউরোপীয় অর্থনৈতিক সম্প্রদায়ের মধ্যে সবচেয়ে উঁচু বিল্ডিং ছিল, যদিও ইউরোপে এখন এর থেকে অনেক উচু বিল্ডিং রেেয়ছে। তবে, প্রাচীন হিসেবে এর একটি গুরুত্ব এখনও রয়ে গেছে। South Tour এলাকাজুড়ে রয়েছে বিভিন্ন শপিং মল ও বানিজ্যিক স্থাপনা। এছাড়া একটি বিশাল খোলা চত্বরের মাঝে একটি নান্দনিক ঝরনা Fountain of Zuidertoren, যা সহজেই পর্যটকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। বৃষ্টিস্নাত বিকেলের খানিকটা এখানে কাটিয়ে আমরা চলে গেলাম ব্রাসেলসের প্লেস অব কংগ্রেস, যেখানে রয়েছে এক নান্দনিক স্থাপত্য শৈলীর নিদর্শন। Square-Brussels Convention Centre এটি মূলত একটি সম্মেলন কেন্দ্র ঘিরে যে অবকাঠামো সেটা আমাকে বেশি কৌতূহলী করেছে তা নানান আদলে সিঁড়ির ধাপ, চমৎকার বাগান আর নানান স্কাল্পচার, যা স্থাপনাটিকে আরো শৈল্পিক করে তুলেছে। সিঁড়ির ধাপগুলোতে শোভা পাচ্ছে সামাজিক, অর্থনেতিক আর রাজনৈতিক সাম্যতার বিভিন্ন স্লোগান, যাতে এটা সহজেই অনুমান করা যায় যে, এটা রাজনৈতিক মত প্রকাশের একটি উন্মুক্ত চত্বর। এখানে তরুণদের জটলাও চোখে পড়ার মতো। এদিকে আমাদের যাত্রার সময় এগিয়ে আসায় আমরা আমাদের নির্ধারিত গন্তব্যের দিকে রওনা হলাম। আমাদের এখনকার গন্তব্য Maisons Grand-Place, এটি সর্বোতভাবে একটি বাণিজ্যক এলাকা। যেখানে রয়েছে বিশাল শপিং মল, স্টক একচেঞ্জ, উইন্ডমিলসহ আরো নানান স্থাপনা। এর মধ্যে ইরফান ফোনে আমাদের রাইড ওনারের সাথে কথা বলে জেনে নিল তার আবস্থান, আমরা Maisons Grand-Place-এর এদিক সেদিক হাঁটাহাঁটি করে সময় পার করছিলাম, রাইড ওনারের সাথে কথা বলে আমরা প্রকৃত স্থানে চলে গেলাম তখন গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি শুরু হওয়ায় আমরা একটি কফি শপে ঢুকে পড়লাম। এতে অবশ্য লাভই হলো ; এতক্ষণ হাঁটাহাঁটিতে খিদেও লেগেছিল আমরা কফির সাথে টুকটাক কিছু নাশতা করে যখন গাড়িতে উঠলাম তখন ঝুম বৃষ্টি।
এখন সময় ঘড়ির কাঁটায় সন্ধে কিন্তু প্রকৃত চিত্রে তা প্রায় রাত্রি। আমাদের সাথে আরো একজন যাত্রী যুক্ত হওয়ার কথা থাকলেও শেষমুহূর্তে তিনি তা বাতিল করায় আমরা তিনজন যাত্রা শুরু করলাম। আমি, ইরফান আর গাড়ির মালিক যিনি গাড়ি চালাচ্ছেন। গাড়ি চলতে শুরু করলে ইরফান গাড়ির মালিক কাম চালকের সাথে টুকটাক আলাপ সেরে নিলো। আলাপচারিতার মাধ্যমে কিছুটা সহজ হয়ে নেওয়া আরকি। আমরা কোথায় যাচ্ছি তা তো তার জানা, কিন্তু কেন যাচ্ছি আমরা কোন দেশের নাগরিক। আমাদের দেশ সম্পর্কে টুকটাক জানানো। আমরাও জানলাম ভদ্রলোক ব্রিটিশ তিনি লন্ডনে চাকরি করেন, জার্মানিতে তার বাগদত্তা থাকেন, সাধারণত প্রতি উইকএন্ডে তিনি জার্মানিতে আসেন। তবে এবার যাচ্ছেন ক্রিসমাসের ছুটি কাটাতে। এদিকে একটানা ঝুমবৃষ্টিতে চারপাশ খুব ঝাপসা, একসময় আমাদের গল্প-কথা থেমে গেল ; টানা বৃষ্টির শব্দ কেমন একটা ঘোরের মধ্যে নিয়ে যায়, একটু ঝিমুনিও আসে।
ব্রাসেলস থেকে ফ্রাঙ্কফুর্টের দূরত্ব প্রায় ৪০০ কিলোমিটার। আমরা প্রায় চার ঘণ্টা ড্রাইভিং শেষে ফ্রাঙ্কফুর্টে পৌঁছি, ততক্ষণে বৃষ্টি থেমে গেছে। ফ্রাঙ্কফুর্টে পৌঁছেই আমরা আমাদের হোটেলে খোঁজ করলাম, গাড়ি থেকে নেমে খানিকটা হাঁটলেই হোটেল, এর আগে ইউরোপে আমি যে কয়েকটা দেশে বা শহরে ভ্রমণ করেছি কোথাও প্রচলিত ধারার হোটেলে থাকিনি। হলিডে ক্যাম্প বা হলিডে হোমস্ এধরনের আবাসনে থেকেছি। এখন যেখানটায় আছি সেটা খুবই সাধারণ মানের হোটেল, আমাদের দেশের জেলাপর্যায়ে যে-ধরনের সাধারণ আবাসিক হোটেল থাকে অনেকটা সে রকম। সাধারণত স্টুডেন্টরাই এ ধরনের হোটেলে বোর্ডার। আগেই বোধকরি বলেছি এখানে আমি আর ইরফান দুই ধরনের এরেঞ্জমেন্টে থাকবো বলে বুকিং করেছি, ইরফান ডর্মেটরিতে সিট বুক করেছে আর আমার জন্য একটি সিঙ্গেল রুমের ব্যবস্থা করেছে। সেইসাথে এটাও বলেছে, ‘তাসলিমা ফুনি এটাচ্ বাথরুমের প্রত্যাশা রাখিয়েন না।’ তাই শুরু থেকেই আমার ভেতর একটা খুঁত-খুঁতানি ছিল। যা হোক, সেদিকে পরে আসছি, যে কারণে হোটেল নিয়ে এত কথা তা হলো, এটা আমাদের খুব কমন ধারণা যে, ইউরোপ ফ্রি-কালচারের একটি দেশ সেখানে কেউ কারো প্রতি অপ্রয়োজনে তেমন কোনো আগ্রহ দেখায় না। কিন্তু ফ্রাঙ্কফুর্টে এসে বিশেষ করে এই হোটেলে এসে চেক ইন করার আগে যে সমস্ত প্রশ্নের সম্মুখীন হলাম এবং তাদের রুলস্ সম্পর্কে জানলাম, তাতে এর ঠিক উল্টো একটা চিত্র ধরা পড়ল। যেমন, যেহেতু আমি একজন মহিলা এবং একটি সিঙ্গেল রুম বুক করেছি সেহেতু ইরফান আমার ভাতিজা হওয়া সত্ত্বেও সে কোনো প্রয়োজনে আমার রুমে যেতে পারবে না। প্রয়োজন হলে সে যেন আমাকে লবিতে ডেকে নেয়। এটি একটি উদাহরণ, এমন আরো জটিল জটিল বা উদ্ভট নিয়ম ছিল। এসব নিয়মে সম্মত হয়ে সকল ফর্মালিটিস মেনে আমরা চেক ইন করলাম।
ছোট্ট খুপরির মতো একটা রুম যেখানে একটি সিঙ্গেল বেড আর একটি ড্রেসিং টেবিল, এই হচ্ছে ফার্নিচার ; তবে, রুমে ঢোকার পর যে বিষয়টি আমার জন্য সুখকর ছিল তা একটি এটাচ্ বাথ। সেই ভোরে চলতে শুরু করার পর এই প্রথম একটু ফুসরত। যদিও শীতের রাত তবু মনে হলো সারাদিনের ক্লান্তি ঘোচাতে গোসল করতেই হবে। রাত এখন এগারোটার মতো বাজে, রাতের খাবার এখনো খাওয়া হয়নি তাই আমি আর ইরফান ফ্রেস হয়ে আবার বেরিয়ে পড়লাম। ইরফান ইতোমধ্যে গুগুল ম্যাপের সাহায্যে হালাল খাবারের রেস্টুরেন্টের লোকেশন দেখে রেখেছে তাই বের হয়ে খুব একটা খোঁজাখুঁজি করতে হয়নি। আমাদের হোটেলের কাছেই একটি তার্কিশ রেস্টুরেন্ট, রাত তখন বোধ করি বারটা হবে রেস্টুরেন্টগুলো তখনও জমজমাট। রাস্তার পাশে উপরে ছাউনি দেওয়া চারপাশটা খোলা একটি রেস্টুরেন্ট, আমরা একটি মাঝারি সাইজের পিৎজা অর্ডার করলাম। চারদিকে খাবারের ম ম গন্ধে ক্ষুধা যেন চনমনিয়ে উঠল, অথচ এতক্ষণ আমি তেমন কোনো ক্ষুধা অনুভব করিনি। খাওয়া-দাওয়া শেষে আমরা আর দেরি না করে হোটেলে ফিরে এলাম। সারাদিনের ক্লান্তি যেন এখন দুচোখে ভর করেছে।
এমনিতে আমি লেট রাইজার হলেও কোথাও বেড়াতে গেলে আবার ভোরের পাখি হয়ে উঠি। বেশ সকাল সকাল আমার ঘুম ভেঙে গেল। ফ্রেশ হয়ে ইরফানকে ফোন দিলাম, আমার ফোনে ইরফানের ঘুম ভাঙল। এরপর আমরা তৈরি হয়ে ব্যাগ অ্যান্ড ব্যাগেজ বেরিয়ে এলাম। প্রথম কাজ নাশতা করা। ফ্রাঙ্কফুর্টে এটা লক্ষণীয়, এখানে প্রচুর তার্কিশ রেস্টুরেন্ট; তাই হালাল খাবার পেতে খুব বেগ পেতে হয় না। আমরা একটা তার্কিশ রেস্টুরেন্টে ঢুকে পড়লাম। নাশতায় তার্কিশ স্পেশাল প্লেট অর্ডার করলাম সাথে স্পেশাল চা। তবে, বলতেই হবে চায়ের স্বাদটা যেমন পরিবেশনটা আরো চমৎকার। নাশতা করতে করতে আমরা সারাদিনের পরিকল্পনা সাজিয়ে নিচ্ছিলাম।
আগেই বলেছি ইউরোপের প্রায় সকল উল্লেখযোগ্য শহর কোনো-না-কোনো নদী কেন্দ্রিক। ফ্রাঙ্কফুর্টও এর ব্যতিক্রম না, তেমনি ব্যতিক্রম না নদীর পরিধি। আমাদের দেশের বিবেচনায় এগুলো নদী না হয়ে খাল হতে পারত। নদীর এপার-ওপারে যোগাযোগের জন্য আড়াআড়ি বেশ কিছু সেতু রয়েছে যার মধ্যে দুটি সেতু শুধুমাত্র পায়ে চলার জন্য নির্ধারিত, অর্থাৎ এ দুটি সেতু দিয়ে কোনো যান-বাহন চলে না। সকাল থেকে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি, তাই বলে কি শহর প্রদক্ষিণ বন্ধ থাকবে ? একদমই না। আজও আমাদের পায়ে হেঁটে শহর দেখার পরিকল্পনা আছে, যেমনভাবে ব্রাসেলস ঘুরে দেখেছি। প্রথমেই আমরা নদীর ধার ধরে হেঁটে জেটিতে পৌঁছে গেলাম যেখানে বেশ ছোটো ছোটো হাউজ বোট ঢেউয়ের দোলায় আনমনে দোল খাচ্ছে, সাথে জেটিতে মৃদু দোলনি অনুভূত হচ্ছে। আমরা ঝিরঝির বৃষ্টিতে কিছুটা সময় ঢেউয়ের দোল খেয়ে আবার পথে নামলাম। আমাদের এবারের গন্তব্য নদীর ওপার। হ [চলবে]