কথায় বলে, ‘সময় এবং স্রোত কারো জন্য অপেক্ষা করে না’। তাই প্রত্যেকের জীবনে সবচেয়ে মূল্যবান হলো সময়। আমরা জানি প্রতিটি সেকেন্ড, মিনিট আমাদের জীবনে কতটা মূল্যবান। আর এই সময় জানার জন্য ঘড়ির দরকার হয়। বর্তমান সময়ের সব কিছুই প্রতিটি সেকেন্ড হিসেব করে চলেছে। তবে, আগে কিন্তু বিষয়টি এমন ছিল না। একটা সময় ছিল যখন মানুষ বনে-জঙ্গলে, পাহাড়ের গুহায় বাস করত। মানুষ তখন লেখাপড়া জানত না। সময় নিয়েও তেমন তাদের মাথা ব্যথা ছিল না। তখন সময় নির্ণয়ের জন্য মানুষের একমাত্র অবলম্বন ছিল সূর্য। সূর্য উঠলে তারা দিন শুরু করত, আর সূর্য ডুবে গেলে রাত হতো। এরপর আস্তে আস্তে আবিষ্কার হলো ঘড়ি। আজ আমরা জানবো ঘড়ি আবিষ্কার ও এর বিবর্তন। আধুনিক ঘড়ি আবিষ্কার নিয়ে রয়েছে নানা মতবাদ। আর আবিষ্কারকের নাম নিয়েও রয়েছে অনেক তর্ক-বিতর্ক। আর এই ঘড়ি আবিষ্কারের পেছনে রয়েছে কয়েক হাজার বছরের ইতিহাস। জানা যায় মিশর ও ব্যাবিলনে সর্ব প্রথম ঘড়ি আবিষ্কৃত হয়েছিল। তবে, একটা বিষয় জানার রয়েছে, সেটি হলো ঘড়ি কিন্তু একদিনে হুট করে আবিষ্কার হয়ে যায়নি। প্রথম আধুনিক ঘড়িতে শুধু ঘণ্টার কাঁটা ছিল। এরপর মিনিটের কাঁটা এল। আর তারপর সেকেন্ডের কাঁটা। এ কারণে আধুনিক ঘড়ি আবিষ্কারের ইতিহাস হাজারো তর্ক-বিতর্কে ভরা। তবে প্রথম শুরু হয়েছিল কোথা থেকে চলুন জেনে নিই। বিস্তারিত জানচ্ছেন ফাতেমা ইয়াসমিন...
অনেকেই মনে করেন, প্রাচীন গ্রিকের পদার্থবিদ আর্কিমিডিস প্রথম যান্ত্রিক ঘড়ি বা আধুনিক ঘড়ি আবিষ্কার করেন। কিন্তুইতিহাস আরো ঘাটলে জানা যায় ৯৯৬ খ্রিষ্টাব্দে পোপ সিলভেস্টার আধুনিক ঘড়ি বা যন্ত্র-ঘড়ি আবিষ্কার করেন। যন্ত্র-ঘড়িতে অনেকগুলো চাকা লাগানো থাকত। এই ঘড়িতে শুধু ঘণ্টার কাঁটা ব্যবহার করা হতো যা নির্দিষ্ট সময় পরপর বেজে উঠত। কিন্তু এই ঘড়িতে মিনিট বা সেকেন্ডের কাঁটা ছিল না। তবে, ইতিহাসের হিসাব অনুযায়ী পিটার হেনলেইনকে আধুনিক ঘড়ি আবিষ্কারক হিসেবে মানা হয়। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ধরনের ঘড়ি আবিষ্কার করা হয়েছিল। যেমন, সূর্যঘড়ি, পানিঘড়ি, মোমঘড়ি ইত্যাদি। তবে, যান্ত্রিক ঘড়ি আবিষ্কারের জন্য পিটার হেনলেইনের কৃতিত্ব সবচেয়ে বেশি।
১৬০০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত ঘড়ির আকার অনেক বড়ো বড়ো হতো। তখন ঘড়ি শুধুমাত্র বাজার বা বড়ো কোনো বিল্ডিং-এ লাগানো হতো। এই কারণে তখনকার দিনে ঘড়ি এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নিয়ে যাওয়া যেত না। অনেক ঐতিহাসিকদের মতে, ১৫৮৪ খ্রিষ্টাব্দে সুইজারল্যান্ডের জোস্ট বার্গি ঘড়ির মিনিটের কাঁটা আবিষ্কার করেন। তিনি তার একজন বন্ধুর বাড়ির ঘড়িতে মিনিটের কাঁটা লাগিয়েছিলেন। আর এরপর থেকেই ঘড়িতে মিনিটের কাঁটার ব্যবহার শুরু হয়। সে সময়ঘড়ি ওজনে অনেক ভারি হতো। আর তাই সময়ের সাথে সাথে ঘড়িকে হালকা আর ছোটো করার প্রচেষ্টা শুরু হয়।
প্রাচীনকাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত নানাধরনের ঘড়ি
সূর্য-ঘড়ি
সূর্য-ঘড়ির চারদিকে ঘণ্টার আর মিনিটের কাঁটা এঁকে দেওয়া হতো আর মাঝখানে একটা লম্বা লাঠি লাগিয়ে দেওয়া হতো। সূর্য উদয় থেকে অস্ত যাওয়া পর্যন্ত সূর্যের আলো ওই লাঠির ওপর এসে পড়ায় তার ছায়া ওই কাঁটার ওপর এসে পড়ত এবং দিনের বিভিন্ন সময়ে তার ছায়ায় বোঝা যেত এখন ক’টা বাজে। কিন্তু এই ঘড়ির একটি সমস্যা ছিল, রাতের আঁধারে কিংবা দিনে আকাশে মেঘ থাকলে সূর্যের আলো না থাকার কারণে মানুষ ঠিক সময় জানতে পারত না। কিন্তু সূর্য-ঘড়ি ছিল মানুষের আবিষ্কার করা সর্বপ্রথম ঘড়ি। এই ঘড়ির ব্যবহার তারপর কমে যেতে থাকে ধীরে ধীরে।তারই ধারাবাহিকতায় পানিঘড়ির আবিষ্কার হয়।
জল-ঘড়ি
খ্রিষ্টপূর্ব ১৪০০ অব্দে মিশরীয়রা এই পানি ঘড়ি আবিষ্কার করেছিল। জল-ঘড়িতে দু’টি পাত্রের ব্যবহার করা হতো। একটি পাত্রের নিচে একটি ছোটো ছিদ্র করে দেওয়া হতো। সেই পাত্রের জল একটু একটু করে সেই ছিদ্র দিয়ে পাশে রাখা অন্য পাত্রে পড়ত। আর ওই পাত্রে পানির পরিমাণ অনুমান করে সময়ের হিসাব করা হতো। তখনকার সময়ে বেশ কয়েকটি দেশে এই ঘড়ির ব্যবহার শুরু হয়েছিল। তবে, এই ঘড়ির কিছু অসুবিধা থাকার কারণে জাহাজে ব্যবহার করা যেত না। এছাড়া শীতপ্রধান দেশগুলোতে ঘড়ির জল জমে বরফ হয়ে যেত, যার কারণে ঘড়ি বন্ধ হয়ে যেত। ফলে মানুষ তখন জল-ঘড়ির বিকল্প খুঁজতে শুরু করে দিল। তারই পরিপ্রেক্ষিতে আবিষ্কৃত হয় বালু-ঘড়ি।
বালু-ঘড়ি
বালু ঘড়ি ছিল কিছুটা জল-ঘড়ির মতোই। বালু-ঘড়িতে একটা ফানেল ব্যবহার করা হতো, যার মাঝ বরাবর থাকত চ্যাপ্টা আর নিচের অংশে থাকত স্কেলের মতো দাগ কাটা। ফানেলের উপরের অংশে মিহি ও দানাদার বালু ঢালা হতো। সেই বালু মাঝের চ্যাপ্টা অংশ দিয়ে নিচে পড়ে জমা হতো আর সেই স্কেলের মতো দাগ হিসাব করে সময় জানা যেত।
মোম-ঘড়ি
এরপর নবম শতাব্দীতে ইংল্যান্ডে আলফ্র্রেড দ্য গ্রেট মোম ঘড়ি আবিষ্কার করেছিলেন। তিনি একটি লম্বা মোমবাতি নিয়ে তাতে সমান মাপে কিছু দাগ কেটে দিতেন। এরপর মোমবাতিটি জ্বালিয়ে দেওয়া হতো। আর মোমবাতি জ্বলতে জ্বলতে কমতে থাকত। তখন মোমবাতির ওপর দেওয়া চিহ্নগুলো দেখে সময়ের অনুমান করা যেত।
ওয়াচ
ঘড়িতে ঝুলন্ত ভারি বস্তু ব্যবহারের চলন উঠে যাওয়ার পর পকেটে বহনযোগ্য ছোটো ঘড়ি তৈরি হয়। এগুলোই ‘ওয়াচ’ নামে পরিচিত। এটাই আমাদের বর্তমান যুগের ঘড়িগুলোর আদিরূপ। এ ধরনের ঘড়িগুলো গোলাকার ডিম আকৃতির ছিল। এজন্য এগুলোকে বলা হতো ‘নুরেমবার্গের ডিম’। একটি ডিম্বাকৃতি কেসের মধ্যে ঘড়ির সব যন্ত্রাংশ রাখা হতো।
ডিজিটাল ক্লক
ঘড়ির বহু পরিবর্তনের পর ১৮৮৩ খ্রিষ্টাব্দে জোসেফ পালওয়েবার সর্বপ্রথম পকেটে বহনযোগ্য ডিজিটাল ঘড়ি তৈরি করেন। এরপর ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দে খঊউ ডিসপ্লে-যুক্তপ্রথম হাতঘড়ির প্রচলন হয়। হ্যামিল্টন ওয়াচ কোম্পানি ‘পালসার’ নামের এই ঘড়ি তৈরি করেছিল। এরপর নানা ঘড়ি প্রস্তুতকারী কোম্পানির আবির্ভাব ঘটে। এদের মধ্যে প্রতিযোগিতার ফলে নতুন নতুন সব ডিজিটাল হাতঘড়ির আবির্ভাব হয়। আমাদের দেশেও এসব ঘড়ির প্রচলন শুরু হয়। এক্ষত্রে ক্যাসিও কোম্পানির ডিজিটাল ঘড়িগুলো অনেক জনপ্রিয়তা লাভ করে।