ঢাকা শহরের অদূরে সাভার উপজেলার একটি ছোট্ট গ্রামের নাম বিরুলিয়া। গাবতলী থেকে আশুলিয়া মহাসড়ক ধরে উত্তর দিকে এগিয়ে গেলে মিরপুরের রূপনগর, দিয়াবাড়ির পশ্চিম দিকে তুরাগ নদীর উপর বিরুলিয়া সেতু চোখে পড়বে। এই সেতু পার হলেই বাঁপাশে বিরুলিয়া গ্রাম। একসময়ে গ্রামটির তিন দিকে ধান ক্ষেতের বিল ও একদিকে নদী ছিল। বর্ষা মৌসুমে একটি দ্বীপ মনে হতো। বর্তমানে গ্রামটির দক্ষিণ-পশ্চিম পাশে ধানক্ষেতের বিল আর পূর্ব পাশে প্রবাহিত হয়ে চলেছে তুরাগ নদী।
বিরুলিয়া গ্রামটিকে একটি ছোটো প্রাচীন শহর বললে ভুল হবে না। ইংরেজ শাসনামলের প্রথমভাগে কয়েকজন ধনাঢ্য ব্যবসায়ী এই ছোটো দ্বীপ-গ্রামে সুরম্য অট্টালিকা নির্মাণ করতে শুরু করেন। উনিশ শতকের মধ্যে একটি পাকারাস্তার দুই পাশে অর্ধ শতাধিক বাড়ি তৈরি হলে গ্রামটি তখন মুঘল নগর কসবার আদলে একটি ছোটো শহরে রূপান্তরিত হয় ।
এই গ্রামের দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে সাহাপাড়া এবং উত্তর-পূর্ব দিকে ঘোষপাড়া। সড়কপথে বিরুলিয়া সেতু পার হয়ে উত্তর দিক থেকে গ্রামে প্রবেশ করলেই শত বছর প্রাচীন একটি একতলা বাড়ি চোখে পড়বে। তৎকালীন ব্যবসায়ী গোপী মোহন সাহা ১৩২৫ বঙ্গাব্দে বাড়িটি নির্মাণ করেছিলেন। গোপী মোহন সাহা বাড়িটি নির্মাণ করলেও ছেলে নারায়ণ সাহার নামেই বাড়িটি পরিচিতি লাভ করে। বর্তমানে নারায়ণ সাহার পরবর্তী বংশধরেরা বাড়িটিতে বসবাস করছেন। গোপী মোহন সাহার বাড়ি থেকে কিছুটা উত্তরে ‘শ্রী শ্রী রাধা মোহন রায় জিউ মন্দির’। মন্দিরের পাশে রয়েছে পুরোহিত শ্রী জীবন দাস মোহন্ত ও তার স্ত্রী শ্রীমতী প্রিয়দাসী মোহন্তের সমাধিসৌধ। মন্দিরটি প্রায় দেড় শত বছরের প্রাচীন।
বিরুলিয়া গ্রামের সরুপথ ধরে আরো দক্ষিণ দিকে গেলেই ডানপাশে সারিবদ্ধভাবে কয়েকটি প্রাচীন বাড়ি দেখা যাবে। দক্ষিণ দিকের দু’টি ভবন নিয়ে শ্রী তারক সাহার বাড়ি। তারক সাহার পিতা তৎকালীন ধনাঢ্য ব্যবসায়ী শ্রী প্রতাপ সাহা উনিশ শতকের শেষ দিকে বাড়িটি নির্মাণ করেছিলেন। তার পুত্র শ্রী তারক সাহা ইংরেজ শাসনামলের শেষ দিকে বিরুলিয়া ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট এবং পাকিস্তান সৃষ্টির পর বিরুলিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন।
বিরুলিয়া গ্রামে তারক সাহার বাড়িটি সবচেয়ে বড়ো। বাড়িটির পূর্ব দিকের ফটক দিয়ে প্রবেশ করতে হয়। বাড়িটির মাঝখান বরাবর মাটি থেকে তিন ফুট উঁচু প্লাটফর্মের উপর নির্মিত দোতলা ভবন দু’টি এখনো টিকে আছে। উত্তর-দক্ষিণ মুখি আয়তাকার দোতলা ভবনটি পরিবারের বসবাসের জন্য তৈরি করা হয়েছিল। এই ভবনের নিচতলায় ৬টি কক্ষ এবং উপর তলায় ৫টি কক্ষ রয়েছে। বাড়িটির ভেতরের দিকে পশ্চিম পাশে দুই কক্ষ বিশিষ্ট আরো দু’টি একতলা ভবন ছিল। এর একটি রান্নাঘর হিসেবে ব্যবহৃত হতো। রান্নাঘরের ছাদ ইতোমধ্যে ধসে পড়েছে এবং অন্য একতলা ভবনটি সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গেছে। বাড়িটির পশ্চিম দিকে পরিত্যক্ত প্রাচীন শৌচাগার এখনও রয়েছে। শৌচাগারের পাশ দিয়ে একটি পাকা সিঁড়ি সরাসরি বিলের মধ্যে নেমে গেছে। বর্ষাকালে জলপথে এই দিক দিয়েই যাতায়াতের ব্যবস্থা ছিল। বাড়ির ভেতর থেকে দোতলায় ওঠার সিঁড়ি রয়েছে। দোতলার আয়তকার কক্ষটির একপাশের দেয়াল রঙিন সিরামিকসের টুকরা দিয়ে অলঙ্কার করা। কক্ষটি সম্ভবত বৈঠকখানা হিসেবে ব্যবহৃত হতো। বাড়িটির এই ভবনের বাইরের দেয়ালের উপরের অংশটিও রঙিন সিরামিকসের টুকরা দিয়ে অলঙ্করণ করা।
বাড়িটির উত্তর-পূর্ব দিকের অন্য দোতলা ভবনটি তারক সাহার বৈঠকখানা হিসেবে পরিচিতি লাভ করলেও আসলে এটি অতিথিশালা। দোতলা ভবনটির উভয় তলায় দু’টি করে কক্ষ রয়েছে। নিচতলার বারান্দার গোলাকৃতি থামগুলো সিরামিকসের টুকরা দিয়ে নকশা করা। নান্দনিক অলঙ্করণে বাড়িটির আভিজাত্য প্রকাশ পেয়েছে। দোতলার বর্ধিত বারান্দার টিনের চাল ও কাঠের নকশা করা বেলকুনি ভবনটিকে আকর্ষণীয় করে তুলেছে।
তারক সাহার বাড়ির উত্তর পাশের দোতলা বাড়িটি গয়ানাথ সাহার বাড়ি হিসেবে পরিচিত। গয়ানাথ সাহার পিতা দশরথ সাহা উনিশ শতকের শেষ দিকে বাড়িটি নির্মাণ করেন। দশরাথ সাহার তিন ছেলে দ্বারকানাথ সাহা, গয়ানাথ সাহা ও সীতানাথ সাহা বাড়িটিতে বসবাস করতেন। এই বাড়িটিও ৪ ফুট উঁচু প্লাটফর্মের উপর নির্মিত। এই বাড়ির নিচতলায় ৪টি এবং দোতলায় ৪টি করে মোট ৮টি কক্ষ রয়েছে। ভবনটির সম্মুখভাগে দোতলার বারান্দার কাঠের নকশা করা বেলকুনি ও ছাদ বাড়িটিকে দৃষ্টিনন্দন করে তুলেছে। ১৯৬৪ খ্রিষ্টাব্দে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময়ে দশরথ সাহার পুত্ররা ভারত চলে যান। এরপর বাড়িটি দীর্ঘদিন খালি পড়ে থাকে। দেড় শত বছরের প্রাচীন এই বাড়িটির মালিকানা বেশ কয়েকবার বদল হয়েছে।
দশরথ সাহার বাড়ির উত্তর পাশে গঙ্গাচরণ সাহার বাড়ি। দোতলা বিশিষ্ট এই বাড়িটি উনিশ শতকের শেষ দিকে তার পিতা ভাগীরথী সাহা নির্মাণ করেন। এই বাড়িটিও ৪ ফুট উঁচু প্লাটফর্মের উপর নির্মিত। বাড়িটির নিচতলায় ৫টি এবং দোতলায় ৫টি কক্ষসহ মোট ১০টি কক্ষ রয়েছে। বাড়িটির সম্মুখভাগের দোতলায় অর্ধচন্দ্র আকৃতির দু’টি বারান্দা রয়েছে। নিচ থেকে লম্বা পিলার দোতলার ছাদ পর্যন্ত উঠে গেছে। নান্দনিক নকশায় নির্মিত বাড়ির সম্মুখভাগ খুবই আকর্ষণীয়। ভাগীরথী সাহার বাড়িটিতে এখনো তার উত্তরসুরিরা বসবাস করছেন।
ভাগীরথী সাহার বাড়ির উত্তর পাশে মনমোহন সাহার দোতলা বাড়ি। মনমোহন সাহার বাড়িটিও উনিশ শতকের শেষ দিকে নির্মাণ করা হয়েছিল। তার মৃত্যুর পর তিন ছেলে গোপী বল্লব সাহা, নীহার বল্লব সাহা ও প্রাণ বল্লব সাহা মালিক হন। ৪ ফুট উঁচু প্লাটফর্মের উপর নির্মিত শত বছর প্রাচীন এই বাড়িটিতে দু’টি দোতলা ভবন রয়েছে। বাড়িটির সম্মুখভাগের দোতলায় বারান্দা রয়েছে। নিচতলা দু’টি গোলাকৃতির পিলার দোতলার ছাদ পর্যন্ত উঠে গেছে। বসবাসের জন্য ভবনটিতে নিচতলায় ৪টি এবং উপর তলায় ৪টি কক্ষ রয়েছে।
এই ভবনটির উত্তর-পূর্ব পাশে দোতলা ভবনটি বৈঠকখানা হিসেবে পরিচিত। বৈঠকখানার নিচতলায় ও দোতলায় দু’টি করে কক্ষ রয়েছে। বৈঠকখানার দোতলার দুই পাশে কাঠের তৈরি বারান্দার বেলকুনি ভবনটির সৌন্দর্য বৃদ্ধি করেছে। মনমোহন সাহার বাড়িটির মালিকানা পরিবর্তন হলেও কয়েকটি হিন্দু পরিবার দু’টি ভবনেই বসবাস করছে।
সাহাপাড়ার উত্তর-পূর্ব দিকে ঘোষপাড়া। ঘোষপাড়া যাওয়ার পথে চোখে পড়বে শত বছর প্রাচীন শ্রী শ্রী রাধা মাধব মন্দির এবং শ্রী শ্রী বৃন্দাবন চন্দ্র জিউ মন্দির। এখানে এখনো পূজারিরা নিয়মিত প্রার্থনা করেন এবং শ্রী শ্রী চৈতন্য দেবের স্মরণে কীর্তন পরিবেশিত করেন।
মন্দিরের অদূরে খোলা মাঠের উত্তর-পূর্ব কোনে বিরুলিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। ১৯১৪ খ্রিষ্টাব্দে বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত হয়। বিদ্যালয়টির পশ্চিম পাশেই ধীরেন্দ্র সাহার দোতলা বাড়ি। বাড়িটির নিচতলায় ৩টি এবং দোতলায় ৩টি করে মোট ৬টি কক্ষ রয়েছে। বাড়িটির ভবনের পশ্চিমাংশে নিচতলা ও দোতলায় লম্বা বারান্দা রয়েছে। ধীরেন্দ্র সাহার বাড়িটির বেশিরভাগ অংশ পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। একটি অংশ বিরুলিয়া পুলিশ ফাঁড়ির আবাসিক ভবন হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। ধীরেন সাহার পুত্ররা ঢাকা ও ভারতের কলকাতায় বসবাস করছেন। মাঠের দক্ষিণ-পূর্ব কোনে তুরাগ নদীর পাশেই ভারতচন্দ্র ঘোষের দোতলা বাড়ি। ভারতচন্দ্র ঘোষের মৃত্যুর পর তার পাঁচ ছেলে রজনীকান্ত ঘোষ, দুর্গাচরণ ঘোষ, রামচরণ ঘোষ, শ্যামচরণ ঘোষ ও কৈলাসচরণ ঘোষ বাড়িটিতে বসবাস করেন। এরপর মালিক হন পরবর্তী বংশধর বিনোদ বিহারী ঘোষ। বর্তমানে বাড়িটির মালিক ভূপেন্দ্র ঘোষ। বাড়িটির নিচতলা এবং দোতলায় ৪টি করে মোট ৮টি কক্ষ রয়েছে।
বিরুলিয়া গ্রামের প্রাচীন বাড়িগুলোর বেশিরভাগ ভবন দেশীয় রীতিতে এবং কয়েকটি ভবন ইউরোপ ও মুঘল রীতিতে নির্মাণ করা হয়েছে। প্রতিটি ভবন নির্মাণে ইট, চুন, সুরকি ব্যবহার করা হয়েছে। বিরুলিয়া গ্রামের প্রাচীন বাড়িগুলো অযতœ অবহেলায় জরাজীর্ণ হয়ে পড়েছে। কয়েকটি ভবন ইতোমধ্যে ধ্বংস হয়ে গেছে। ঢাকা জেলার সাভার উপজেলার বিরুলিয়া গ্রামের এই প্রাচীন বাড়িগুলো দেশের মূল্যবান প্রতœতাত্ত্বিক নিদর্শন।
লেখক : গবেষক, লেখক এবং টেলিভিশন অনুষ্ঠান নির্মাতা