অকালপ্রয়াত শিশুসাহিত্যিক রাইদাহ গালিবা অশ্রুসিক্ত শোকগাথা : নিরঞ্জন অধিকারী

28 Nov 2024, 02:09 PM অন্যান্য শেয়ার:
অকালপ্রয়াত শিশুসাহিত্যিক রাইদাহ গালিবা অশ্রুসিক্ত শোকগাথা : নিরঞ্জন অধিকারী


লিখে আনন্দ পাই, কিন্তু কোনো কোনো লেখা গভীর বিষাদ নিয়ে লিখতে হয়। অশ্রু এসে বাধা দেয়, কলম থেমে যায় মাঝে মাঝে। যাকে নিয়ে এ লেখা সে একজন ক্ষুদে সাহিত্যিক। নানা বিষয় নিয়ে লিখত সে। নানা বিষয়ে ছিল তার কৌতূহল। ‘ছিল’ ক্রিয়াপদ দেখে বুঝতেই পাচ্ছেন, সে আর আমাদের মাঝে নেই। সে হচ্ছে কুঁড়িতেই ঝরে যাওয়া সাহিত্যিক রাইদাহ গালিবা। তার ডাক নাম কুইন। বাংলাদেশ বেতারের ঢাকা কেন্দ্রে কর্মরত তার জননী কানিজ পারিজাত। বেতারে উচ্চপদে ব্যস্ততার মধ্যে কাজ করলেও তিনি সাহিত্য সৃষ্টির জন্য সময় বের করে নেন। বাংলাদেশের সাহিত্যে তিনিও একজন নক্ষত্র। কানিজ পারিজাত নামে তিনি সাহিত্যচর্চা করছেন। রাইদার জন্ম ২০১১ খ্রিষ্টাব্দের ৮ মার্চ। অকাল প্রয়াণ ২০২২ খ্রিষ্টাব্দের ১ ডিসেম্বর।

রাইদাহর বয়স যখন মাত্র তিন বছর, তখন সে মুখে মুখে বানিয়ে বানিয়ে গল্প বলতে পারত। ছিল অসাধারণ শ্রুতিধর। তার মা কোনো গল্প বললে সে তা শুনে যথাস্থানে যথাবিরতি ও স্বরভঙ্গিসহ হুবহু বলতে পারত।

তার পর্যবেক্ষণ শক্তিও ছিল অসাধারণ। তার নানা যখন চুল কাটাতে নরসুন্দরের কাছে সেলুনে যেতেন, রাইদাহও কোনো কোনো দিন তার সঙ্গে যেত। ফিরে এসে সে নরসুন্দরের হুবহু অনুকরণ করে দেখাতো, নরসুন্দর কেমন করে তার নানার চুল কেটেছে। সে একাই ভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করে দেখাতে পারত।

রাইদাহ খুবই সংবেদনশীল ছিল। তার এ সংবেদনশীলতা ও পর্যবেক্ষণ শক্তির জন্য সে শৈশবেই সাহিত্য সৃষ্টিতে ব্রতী হয়েছিল। ছয় বছর বয়সেই সে একটা গল্প রচনা করে ফেলে- গল্পটির নাম ‘বাঘ ও দৈত্য’। প্রথম প্রকাশিত গল্প ‘শিশু’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। গল্পটির নাম ‘পিটুর জাদু জুতা’। তখন সে কে. জি. শ্রেণিতে পড়ত এবং তার বয়স তখন মাত্র সাত বছর।

২০২০ খ্রিষ্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে তার যে বইটি প্রকাশিত হয় সে বইটির নাম ‘পিটুর জাদু জুতা’। প্রকাশক ছালমা রেহানা ; প্রকাশনা ছোটোদের বই, সেঞ্চুরি আর্কেড শপিং সেন্টার [দোতলা] মগবাজার, ঢাকা-১২১৭। রাইদাহ বইটি উৎসর্গ করেছে তার বাবা, মা আর ছোটোভাই আবরারকে।

গল্পটির কাহিনি খুব সুন্দর। গল্পের প্রধান চরিত্র পিটু। সে তার মায়ের সঙ্গে বনের পাশে একটি কুটিরে থাকত। খুবই গরিব ছিল তারা। একটা তোতা পাখি পুষত। তার নাম ছিল টুটু। নিরূপায় হয়ে পিটু ওই তোতাপাখিটিকে বিক্রি করতে হাটে গেল। সেখানে এক বৃদ্ধ মহিলা পাখিটির বদলে একজোড়া জুতা দিতে চাইলেন- ওই জুতা পায়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করে সে যা চাইবে, তা-ই পাবে। বাড়িতে গিয়ে সে জুতা পরে মায়ের সামনে দাঁড়িয়ে চোখ বন্ধ করে ধনরত্ন চাইল এবং সঙ্গে সঙ্গে প্রচুর ধনরত্ন পেয়ে গেল। 

ধনী হওয়ার পর সে অহঙ্কারী হয়ে গেল। তখন জাদু জুতা আর কাজ করছিল না। সে তখন জাদু জুতাটি ফেলে দেবে বলে ঠিক করল। তখন জাদু জুতা কথা বলে উঠল। জাদু জুতা জানালো, পিটু অহঙ্কারের ফলে জাদু জুতা কাজ করছে না। পিটু তার ভুল বুঝতে পারল। কিন্তু জাদু জুতা অন্য কারো জীবনে যাওয়ার জন্য পিটুকে ছেড়ে চলে গেল।

এ গল্পটির মর‌্যাল বা পিটুর নীতিশিক্ষাটি হলো অহঙ্কার করতে নেই। অহঙ্কার ক্ষতির কারণ। রাইদাহর প্রতিটি গল্পের শেষে এ নীতিশিক্ষার কথা রয়েছে। ঠিক সংস্কৃত সাহিত্যের ‘পঞ্চতন্ত্র’-এর গল্পগুলোর মতো।

রাইদাহর দ্বিতীয় গল্পগ্রন্থের নাম ‘এক যে ছিল মুচি’। প্রকাশকাল ফেব্রুয়ারি, ২০২১। প্রকাশক শিশু প্রকাশক ফারজানা কাইয়ুম, ২৭/৫ গ. তোপখানা রোড, সেগুনবাগিচা, ঢাকা-১০০০। এ গ্রন্থটির মর‌্যাল বা নীতিশিক্ষা হলো এই যে তার সামনে কেউ যদি বিপদে পড়ে সাহায্য চায় তবে তা করা উচিত এবং ভবিষ্যতে সে প্রয়োজনে উপকারভোগীদের কাছ থেকে প্রতিদান পেতে পারে। এক গরিব কিন্তু নির্লোভ মুচি বিপদগ্রস্ত লাল পিঁপড়ে ও এক হাঁসকে বিপদ থেকে বাঁচিয়েছিল। তারাও মুচির বিপদের সময়ে সাহায্য করেছিল।

লাল পিঁপড়েটা ছিল একটা পরি। অবশ্য পরিটা লাল পিঁপড়ে রূপেই মুচিকে সাহায্য করেছিল। অতঃপর আমরা দেখি, এক রাজার আদেশে মুচি নির্ধারিত এক সপ্তাহের মধ্যে চল্লিশ জোড়া জুতা বানিয়ে ফেলল। মুচির এক প্রতিবেশী ছিল, তার নাম ছিল বিতু। সে ওই মুচিকে খুব হিংসে করত। সে মুচির বানানো চল্লিশ জোড়া জুতা রাজাকে দেওয়ার আগেই চুরি করে নিয়ে গেল। তখন হাঁসরূপী পরি বিতুর কাছ থেকে জুতাগুলো ফেরত নিয়ে এলো। রাজা মুচিকে প্রতিশ্রুতি দেওয়া একহাজার স্বর্ণমুদ্রা দিয়ে দিলেন এবং মুচি ধনী হয়ে সুখে-শান্তিতে বসবাস করতে লাগল।

এ গল্পটিতেও সততা ও কর্মনিষ্ঠার পরিচয় ফুটে উঠেছে।

রাইদাহর তৃতীয় গ্রন্থ ‘ইমা ও দৈত্য’। প্রকাশকাল ফেব্রুয়ারি ১৯২২। প্রকাশক ফারজানা কাইয়ুম, শিশু প্রকাশ ২৭/৫ গ, তোপখানা রোড, ঢাকা-১০০০।

রাইদা তার এ বইটি তার ছোটোভাই আবরারকে উৎসর্গ করেছিল।

গল্পটি খুব সুন্দর। এক দেশে ইমা নামে একটি মেয়ে ছিল। ইমা যখন খুব ছোটো তখন তার মা মারা যায়। ইমা তখন তার বাবার কাছেই বড়ো হতে থাকে। তার বাবা ছিল এক গরিব জেলে। ইমা খুব লোভী আর হিংসুটে ছিল। তার এক বন্ধুর কাছে একটি কলম দেখে সে তা কিনতে চায়। কিন্তু তার বাবার কাছে টাকা ছিল না। তাই তিনি কলম কিনে দিতে পারেন না। রাগ করে ইমা বাড়ি থেকে বের হয়ে যায়। চলতে চলতে সে একজঙ্গলে চলে যায়। পৌঁছে এক দৈত্যের প্রাসাদে। দৈত্যের কাছ থেকে সে কোনোক্রমে বেঁচে ফিরে আসে। এ গল্পটির নীতিশিক্ষা হচ্ছে : লোভ আর হিংসা করা উচিত নয়।

রাইদাহ গালিবার চতুর্থ এবং সর্বশেষ গল্পগ্রন্থ হচ্ছে ‘ভয়ংকর গাছ’। প্রকাশকাল ফেব্রুয়ারি ২০২৩। প্রকাশক কাজী কামরুল হাসান। বই বাংলা প্রকাশন, ৪৫ আকছাইল কলাতিয়া কেরানীগঞ্জ, ঢাকা-১২১৩। বইটি কাউকে উৎসর্গ করা হয়নি। গভীর বেদনার সঙ্গে উচ্চারণ করছি, এ বইটি তার অকালে ঝরে যাওয়ার পরে প্রকাশিত হয়েছে। রাইদাহর ডেঙ্গু হয়েছিল। তাকে ভর্তি করা হয়েছিল ঢাকার একটি প্রখ্যাত বেসরকারি হাসপাতালে। তার মা জানিয়েছেন, ফ্লুইড অব্যবস্থাপনা ও সময়মতো চিকিৎসা না দেওয়ার কারণে স্থিতিশীল অবস্থায় ভর্তির দুই দিন পরে কুঁড়িতেই ঝরে যায় এ সাহিত্যিক কুসুম।

‘ভয়ংকর গাছ’ গল্পটিতে রূপকথার মিশেল আছে। মনু নামের এক গরিব কাঠুরে ছিল। তার ছিল এক স্ত্রী আর এক মেয়ে। মেয়েটির নাম রোজা। রোজার জন্মের কিছুদিন পরে তার মা নিখোঁজ হয়ে যায়। তার এক পথিকের কথা থেকে সে জানল যে বনে কাঠুরে কাঠ আনতে যায়, সে বনে একটি অভিশপ্ত গাছ আছে, তার কাছে কেউ গেলে গাছটি তাকে পশু বানিয়ে দেয়। পথিক গাছটিকে অভিশাপ থেকে মুক্ত করার উপায়ও বলে দেয়- নীল পাহাড়ে পাওয়া যায় বিশেষ ধরনের পানি, সেই পানি ছিটিয়ে দিলে গাছটি অভিশাপ থেকে মুক্ত হবে। কিন্তু সে পানি রয়েছে নীল পাহাড়ের এক জাদুকরী ডাইনির কাছে। মনু বেরিয়ে পড়ে সেই পানির খোঁজে। বানরের সাথে কথা বলে, বানর একটা ঘোড়াকে বলে তাকে নীল পাহাড়ে নিয়ে যেতে। নীল পাহাড়ে পৌঁছে সে ডাইনির কাছ থেকে সেই পানি নিয়ে আসে। ওই ঘোড়াটি আর কেউ নয়, সে হচ্ছে ওই রাজ্যের মন্ত্রী। ওই অভিশপ্ত গাছটি ছিল ওই রাজ্যের যুবরাজ। অনেক বছর আগে ওই যুবরাজ যখন সিংহাসনে বসেন, তখন তার শত্রু এক দৈত্য তাকে অভিশপ্ত গাছে পরিণত করে। মনু তার আনা পানি ছিটিয়ে দিলে ঘোড়া হয়ে যায় মন্ত্রী আর অভিশপ্ত গাছটি হয়ে যায় যুবরাজ। কৃতজ্ঞ যুবরাজ মনুকে জিজ্ঞেস করে ‘তুমি কী চাও ?’ জবাবে মনু বলে আমি অন্য কিছু চাই না, কেবল আমার ছোটো মেয়ে রোজার মাকে ফিরিয়ে দিন। যুবরাজ তখন মনুকে বলে তুমি বাড়ি গিয়ে রোজার মাকে দেখতে পাবে। তা-ই হয়। রোজার মা ফিরে আসে।

এ গল্পটিতেও সততা ও পরোপকারের সুফল প্রকাশিত হয়েছে। শিশু ও ধানশালিকেল দেশ পত্রিকায় তার আলোচিত লেখাগুলো প্রকাশিত হয়েছে। রাইদাহর আন্ডোরে রাজ্যের কাহিনি, কথা নামক একটি গল্পও রয়েছে। এগুলো ছাড়া রাইদাহ গালিবার আর কোনো লেখা আমার হাতে আসেনি।

রাইদাহ গালিবের গল্পগুলোর ভাষাও খুব চমৎকার। কোনো জটিলতা নেই। তার ভাষার প্রকাশক্ষমতাও প্রশংসনীয়। দুটো উদাহরণ দিচ্ছি :


ভয়ংকর গাছে থেকে

পথিক বলে এ গাছকে মুক্ত করতে হলে লাগবে এক বিশেষ ধরনের পানি। কিন্তু সে পানি সহজে পাওয়া যায় না। এই পানি পেতে গেলে যেতে হবে নীল পাহাড়ে।


‘পিটুর জাদু জুতা’ থেকে

অনেকদিন আগের কথা। একটি ছোট্টো গ্রামে বাস করত একটি ছেলে। তার নাম ছিল পিটু। পিটু তার মায়ের সাথে বনের পাশে একটি কুটিরে থাকত। পিটুর মা সারাদিন কাজ করে যা আয় করত তা দিয়ে পিটু এক বেলাই খাবার কিনে খেতে পারত।

কাহিনি নির্মাণ, চরিত্র চিত্রণ, গল্পের বয়ান, গল্পের ভাষা ও সংলাপ রাইদাহ গালিবার শিল্পসার্থকতার পরিচয়বহ।

পরিণত বয়সে তার হাত থেকে আমরা অবশ্যই আরো উন্নতমানের লেখা পেতে পারতাম। কিন্তু মহাকাল আমাদের সে প্রত্যাশা থেকে বঞ্চিত করেছে। তবু যা পেয়েছি, সে ফসল অকিঞ্চিৎকর নয়, বরং তা স্বর্ণফসল, চিত্তব্যঞ্জক।