ভাষা মানুষের অস্তিত্বের অংশ, আত্মপরিচয়ের অন্যতম স্তম্ভ। মানুষের যতগুলো আত্মপরিচয় রয়েছে, তার মধ্যে ভাষা সবার আগে। ভাষা, দেশ, জাতি, ধর্ম, পরিবার- এইসব মানুষের আত্মপরিচয়ের এক একটি স্তম্ভ। আর নিজের আত্মপরিচয় প্রতিজন মানুষের কাছেই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
পৃথবীর সব জনপদের মানুষেরই নিজ নিজ ভাষা আছে, যা তাদের মায়ের ভাষা, মুখের ভাষা, স্বপ্নের ভাষা, মনের ভাবপ্রকাশের ভাষা, জীবন-যাপনের ভাষা। মায়ের কাছ থেকে মানুষ প্রথম এ-ভাষা শেখে বলে এর নাম মাতৃভাষা।
ভাষা শুধু কিছু শব্দের সমষ্টি নয়। এর সঙ্গে আবেগ-অনুভূতি, চিন্তা-চেতনা, স্বপ্ন-কল্পনা মিশে থাকে। ভাষা ছাড়া কোনো কিছু চিন্তা বা কল্পনা করা যায় না। তাই মানুষের জীবনে মাতৃভাষার কোনো বিকল্প নেই। মাতৃভাষায় মনের ভাব প্রকাশ করার মধ্যে যে আনন্দ ও তৃপ্তি আছে তা বিদেশি ভাষায় কখনো পাওয়া যায় না।
মানুষ তার মাতৃভাষার প্রতি পরম শ্রদ্ধাশীল। মাতৃভাষা মানুষ প্রকৃতিগতভাবেই আয়ত্ত করে বলে সেই ভাষায় অর্জিত সবকিছুই তার কাছে সবচেয়ে আপন। শিক্ষাগ্রহণ বা বিদ্যার্জন কিংবা জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার জন্য প্রয়োজন মনের ভাবপ্রকাশ ও বিকাশের উপযুক্ত মাধ্যম। এক্ষেত্রে মাতৃভাষার চেয়ে উত্তম কোনো মাধ্যম হতে পারে না। একমাত্র মাতৃভাষাই পারে প্রাণের সাথে ভাবের মিলন ঘটিয়ে দিতে। বিদেশি ভাষায় কখনো একজন মানুষের মনের ভাব যথাযথভাবে ফুটে ওঠে না। মাতৃভাষার আকুলতা এবং ভাবদ্যোতনা অন্য কোনো ভাষার পক্ষে পূরণ করাও সম্ভব নয়। আর্থ-সামাজিক ও জ্ঞান-বিজ্ঞানে উন্নতির শীর্ষে যেতে হলে প্রথমে দরকার মাতৃভাষায় দক্ষতা অর্জন।
ঘুরে এসেছে একুশে ফেব্রুয়ারি। বাহাত্তর বছর পর ঘুরে এসেছে আবার সেই পবিত্র দিন- যেদিন নিজ মাতৃভাষা বাংলার অধিকার ও মর্যাদা রক্ষার জন্য পূর্ব-বাংলার তরুণেরা তথা ছাত্র-জনতা নিজেদের জীবন উৎসর্গ করতে কুণ্ঠাবোধ করেননি।
একুশের ভাষা আন্দোলন একটি সাংস্কৃতিক ঘটনা হলেও এর পেছনে কাজ করেছে অর্থনৈতিক ও সামাজিক বৈষম্য। ঔপনিবেশিক শাসনের করাল গ্রাস থেকে মুক্তি পাওয়ার পরপরই পাকিস্তানের নতুন উপনিবেশের শৃঙ্খলে আবদ্ধ হয় পূর্ব-বাংলা। অর্থবিত্ত, শিক্ষা-দীক্ষা, শিল্প-সংস্কৃতি-সহ সব কিছুতে বাঙালিরা এগিয়ে থাকার পরও বারবার বৈষম্যের শিকার হতে হয়। ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দের মধ্য আগস্টে দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত ভাগ হয়ে নতুন রাষ্ট্র পাকিস্তান সৃষ্টি হওয়ার পরপরই পূর্ব-বাংলার জনসাধারণ অর্থনৈতিক ও সামাজিক বৈষম্যের শিকার হতে থাকে এবং প্রতিনিয়ত মোকাবিলা করতে থাকে নিপীড়ন-নির্যাতনের। পূর্ব-বাংলার সিংহভাগ জনগোষ্ঠীর মুখের ভাষা বাংলা হওয়া সত্ত্বেও মুসলিম লীগ সরকার উর্দুকেই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে তৎপর হয়ে ওঠে। তারা বাঙালিদের ওপর ভিনদেশি সংস্কৃতি ও উর্দু ভাষা চাপিয়ে দেওয়ার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। তখনই ছাত্র-শিক্ষক ও বুদ্ধিজীবী সমাজ প্রতিবাদের আওয়াজ তোলে। বাঙালির ভাষা আন্দোলনের সেই শুরু।
মুসলিম লীগ নেতারা যখন পাকিস্তানের নানা জাতিগোষ্ঠীর ভাষাগুলোকে উপেক্ষা করে একমাত্র উর্দু-কেই ‘রাষ্ট্রভাষা’র বিশেষ মর্যাদা দিতে তৎপর হয়ে ওঠেন। তখন বাঙালি রাজনীতিক ও বুদ্ধিজীবীগণ প্রত্যক্ষ করেন যে, পূর্ব-বাংলা নতুন প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তান রাষ্ট্রের একটি প্রদেশ হলেও এখানে লোকসংখ্যা বেশি এবং পুরো পাকিস্তানের শতকরা ৫৬ ভাগ লোক বাংলায় কথা বলে। অন্যদিকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে পূর্ব-বাংলার জনগণের ওপর ভিনদেশি ভাষা চাপিয়ে দেওয়া হলে তারা শিক্ষা, সংস্কৃতি, সরকারি চাকরি ও অন্যান্য ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হবে। সুতরাং তারা উর্দুর পাশাপাশি বাংলাকেও পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতির দাবি তোলে। বাঙালিদের এ দাবি ছিল যেকোনো বিবেচনায় ন্যায্য দাবি।
সংখ্যাগরিষ্ঠতার দিক থেকে তো বটেই সাহিত্যচর্চার দিক থেকেও বাংলা ভাষা ছিল অনেক এগিয়ে। ’৪৭ খ্রিষ্টাব্দের দিকে পূর্ব-বাংলায় বাংলাভাষীর সংখ্যা ছিল পাঁচ কোটির মতো। পশ্চিম-পাকিস্তানের জনসংখ্যা কিছু কমবেশি তিন কোটি। এই তিন কোটি লোক মোট চারটি ভাষায় (বেলুচি, পশতু, সিন্ধি, পাঞ্জাবি) কথা বলত। হিসাবমতে পাকিস্তানের সব থেকে বেশি লোকে কথা বলে বাংলা ভাষায়। আবার বাংলা ভাষার রয়েছে এক সমৃদ্ধ সাহিত্যভা-ার। চর্যাপদ এবং মঙ্গলকাব্যের মধ্যযুগের কথা বাদ দিলেও আধুনিককালের মাইকেল মধুসূদন দত্ত, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, কাজী নজরুল ইসলাম, জীবনানন্দ দাশ প্রমুখ প্রথিতযশা কবি-সাহিত্যিকদের রচনাসম্ভার বিশে^র যেকোনো ভাষার সাহিত্যের সঙ্গে তুলনীয়। তাই পাকিস্তানে প্রচলিত ভাষাসমূহের মধ্যে রাষ্ট্রভাষা হবার দাবি সবচেয়ে বেশি বাংলারই ছিল।
তাই তো ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি পূর্ব-বাংলার দামাল ছেলেরা মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্য জীবন উৎসর্গ করতে দ্বিধা করেনি। ভাষার জন্য বাঙালির জীবনদান পৃথিবীর ইতিহাসে অনন্য, অদ্বিতীয়। বাংলা ভাষা বাঙালির আত্মপরিচয়ের অন্যতম স্তম্ভ বলেই মহান ভাষা আন্দোলনের ৭২ বছর পর এখনো মহান একুশ আমাদের কাছে এত জীবন্ত, এত প্রণোদনাদায়ী। একুশে ফেব্রুয়ারি একদিকে যেমন আমাদের আত্মপরিচয়ের অধিকার অর্জনের মাইলফলক এবং স্বাধীনতা সংগ্রামের সূতিকাগার, অন্যদিকে তেমনি পৃথিবীর সব দেশের সব জাতিগোষ্ঠীর নিজ নিজ মাতৃভাষার প্রতি শ্রদ্ধা জানাবার দিন।
বাংলাদেশে নানান জাতিগোষ্ঠীর নানান ভাষা
বাংলাদেশে এখন ছাব্বিশটির মতো উপজাতি বাস করে। প্রায় প্রতিটি জাতিই নিজস্ব ভাষায় কথা বলে। বাংলা ছাড়া অন্যান্য ভাষার মধ্যে চাকমা, মগ, ওঁরাও, গারো, মণিপুরি ও সাঁওতালি ভাষা ব্যবহারকারীর সংখ্যা বেশি। বাংলাদেশের স্থানীয় আদিবাসীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি লোক কথা বলে চাকমা ভাষায়। এর সংখ্যা তিন লাখের বেশি। এ ভাষায় কিছু প্রাচীন পুঁথি রয়েছে। শব্দতত্ত্ব, ও ধ্বনিতত্ত্ব এবং বাগ-বিন্যাসের দিক দিয়ে বাংলা ভাষার সাথে চাকমা ভাষার অনেক মিলও পাওয়া যায়। এ ভাষার ছয়টি আঞ্চলিক রূপ রয়েছে। ব্যবহারের দিক থেকে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে মগ ভাষা। দুই লাখের বেশি লোক মগ ভাষায় কথা বলে। মগ হলো আরাকানি ভাষার কথ্যরূপ এবং একটি সংকর ভাষা। মগ বর্ণমালার নাম ‘ঝা’। মগ ভাষাপ্রবাদ, ধাঁধা, উপকথা, গীত, ভূতের গল্প, জাতকের গল্প, বৌদ্ধ রাজা-রানিদের কাহিনি- এমন সব লোকসাহিত্যসমৃদ্ধ। ব্যবহারের দিক থেকে ওঁরাও তৃতীয় স্থানীয় ভাষা। বাংলাদেশে প্রায় লক্ষাধিক লোকের মাতৃভাষা ওঁরাও। ওঁরাও ভাষা ‘কুরুখ’ নামে সমধিক পরিচিত। এ ভাষার কোনো লিখিত রূপ নেই। তবে, তা লোকসাহিত্যসমৃদ্ধ। গারো একটি প্রাচীন অনার্য ভাষা। এই ভাষার কোনো লিপি নেই। বাংলা হরফে গারো ভাষা স্বচ্ছন্দে লেখা যায়। এ ভাষা প্রবাদ-প্রবচন, শ্লোক, গান, ছড়া, কিংবদন্তি, উপকথা, পালাগানসমৃদ্ধ। প্রায় তিন হাজার ৫০০ বছরের প্রাচীন ভাষা মণিপুরি। মৈতৈ জাতির নামানুসারে আগে এ ভাষার নাম ছিল মৈতৈ। মণিপুরি একটি সংকর ভাষা। মণিপুরি ভাষায় প্রচুর সামরিক-সংগীত, নাটক, উপন্যাস, ছোটোগল্প, কবিতা এমনকি মাহকাব্যও রচিত হয়েছে। রামায়ণ, মহাভারতসহ বাংলা ও অন্যান্য ভাষার কিছু গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ মণিপুরি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। বর্তমানে বৃহত্তর সিলেটে মণিপুরিভাষীর সংখ্যা প্রায় ৫০ হাজার। সাঁওতালি একটি অনক্ষর ভাষা। সাঁওতাল ভাষায় দুটি উপভাষা আছে ‘নাইলি’ ও ‘করকু’। বাংলাদেশের দিনাজপুর, রাজশাহী ও রংপুরে সাঁওতালভাষী মানুষেরা বাস করেন। সাঁওতালি ভাষা বাংলা থেকে তো বটেই প্রাচীন ভারতীয় আর্য ভাষা থেকেও প্রাচীন।
স্থানীয় জাতিগোষ্ঠীর অন্যান্য ভাষার মধ্যে খাসিয়া, মু-া, খুমি, কোচ, হাজং, চাক, খাড়িয়া, খিয়াং, তঞ্চঙ্গ্যা উল্লেখযোগ্য।