গতর : কানিজ পারিজাত

18 Mar 2025, 02:11 PM গল্প শেয়ার:
গতর : কানিজ পারিজাত

আটকে গেল, হেলেনা বেগমের বেলায় এসেই আটকে গেল... হেলেনা বেগমের আগেই ভানুর মেয়ে শাপলা দাঁড়িয়েছিল... পূর্ণ যৌবনা কলাগাছ থেকে কেটে আনা দুটো কচি কলাপাতা জোড়া দিয়ে ফেচু কবিরাজের বাড়ির মাটির ঘরে বিছানো হয়েছে, সেই জোড়া দেওয়া কলাপাতার উপর গিয়ে দাঁড়িয়েয়েছিল বছর কুড়ির ছিপছিপে গড়নের স্বামী পরিত্যক্তা শাপলা, ঘরখানা ছোটো, ঘরের ভেতর একপাশে টিনের বেড়ার সাথে তক্তা বেঁধে বেঁধে তাক বানিয়ে রাখা, সেই তক্তাবাঁধা তাকের উপর প্লাস্টিকের মবিল আর পেট্রোল রাখার সারি সারি ঘোলাটে সাদা রঙের পুরনো ডিব্বা- সেইসব ডিব্বার কোনোটার বুক পর্যন্ত, কোনোটার আবার গলা পর্যন্ত ভরে রাখা জল, সাত ঘাটের জল। বহুদিনের শ্যাওলা জমা সেই মূল্যবান জলেই নিজের দক্ষ হাতখানা ভিজিয়ে নেয় ফেচু কবিরাজ, শাপলার সারাশরীরে ঘষে ঘষে নিচের দিকে নামতে থাকে ফেচু কবিরাজের ভেজা হাত- মাথা থেকে পায়ের পাতা পর্যন্ত, আর মুখে বিড়বিড় করে পড়তে থাকে মন্ত্র, বিশেষ মন্ত্র। বুক, পেট, উরু আর হাঁটুর নিচে নিপুণ এক ভঙ্গিমায় লতার মতো বেয়ে বেয়ে পায়ের পাতার কাছে এসেই আচমকা কী যেন পেয়ে যায় ফেচু কবিরাজের অভিজ্ঞ হাত- হেঁচকা টানে উঠিয়ে নিয়ে আসে রুদ্ধশ্বাসে তাকিয়ে থাকা মানুষগুলোর চোখের সামনে, শাপলার মায়ের মতোই বিস্মিত চোখে হেলেনা বেগমও দেখে সেই চমকে দেওয়া দৃশ্য- ফেচু কবিরাজের হাতে দলা পাকানো কতগুলো কালচে শেকড় আর সুতো- শরীর থেকে বের করে আনা বিষ- শাপলার দিকে বিজ্ঞ চোখে তাকিয়ে জানতে চায় ফেচু-

কি গতরে আর বেদনা আছে...?

স্বস্তি নিয়ে মাথা নাড়ে শাপলা। স্বামীর আগের পক্ষে ঘরে সতীন আছে শাপলার, সতীনের বিষচোখের দৃষ্টিতে হোক, আর মনের বিষে গোপনে শাপলাকে শেকড় খাইয়ে হোক- বিয়ের পর থেকে শাপলার সারাশরীরে খালি বেদনা আর বেদনা... রোগবালাই লেগেই থাকে... দুই বছরের মাথায় স্বামী ছেড়ে গেলেও ব্যথা-বেদনা গতর ছেড়ে যায়নি। অবশেষে আজ ফেচু কবিরাজের বদৌলতে শাপলার গতর থেকে বেরিয়ে এলো সতীনের দেওয়া সুতো-শেকড়-বাকড়- গোপনে চালান করে দেওয়া বিষ।

গতরের বেদনা সারাতে, ক্ষতির বিষ বের করতে ফেচু কবিরাজের জুড়ি মেলা ভার- শাপলার মায়ের কাছ থেকে এমনটা শুনেই ফেচু কবিরাজের কাছে ওদের সাথেই এসেছে হেলেনা বেগমও। শাপলার মতো বছর কুড়ির সে নয়- মধ্য চল্লিশ পার হয়েছে কয়েক বছর আগে, শাপলার মতো ছিপছিপে গড়নেরও নয়, তবে তার শরীরের গাঁথুনি সত্যিই আলাদা, হেলেনা বেগমের দির্ঘাঙ্গী সুঠাম শরীরে আছে চড়াই-উতরাই, খাঁজ-খাদ আর কত কত বাঁক- এত কিছুর কারণেই বুঝি শাপলার সতীন একজন হলেও, গ্রামে হেলেনা বেগমের সতীন শত জন- সেইসব অজানা শত্রু আর শত সতীনের গোপনে চালান দেওয়া বিষে হেলেদুলে চলা হেলেনা বেগমের গত কয়েক মাস ধরেই এই হাল- ডান হাঁটুতে ব্যথা, গতর কেমন ভার ভার, হাঁটা চলায় অসুবিধা !

চালের আড়তে কাজ করা ভানু বিবি স্বামীর বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেওয়া মেয়েসহ কয়েক মাস আগে হেলেনা বেগমের ঘরের কাছেই এসে ঘর বেঁধেছে- তারই কাছ থেকে শুনে আজ হেলেনা বেগমও গতরে লুকানো গোপন বিষ বের করতে এসেছে ফেচু কবিরাজের হাত দিয়ে?।

ডিব্বায় রাখা শ্যাওলা জমা জলে আবারো হাত ভিজিয়ে নিয়েছে ফেচু কবিরাজ, বিকেলের আলো মলিন হয়ে গেছে, ঘরের মধ্যে মরা আলোর ছায়া, সেই আবছা ছায়ায় নিজের সাথে করে নিয়ে আসা জোড়া কলাপাতা আবারো মাটিতে বিছিয়ে তার ওপরে গিয়ে দাঁড়ায় হেলেনা বেগম। চোখ বন্ধ করে কী যেন বিড়বিড় করছে লালচুলো-গালভাঙা-কেঠো শরীরের ষাটোর্ধ্ব কবিরাজ ফেচু- ভেজা হাতখানা হেলেনা বেগমের শরীরের আঁকাবাঁকা, চড়াই উৎরাই, খাঁজ-খাদ বেয়ে বেয়ে নামছে... হাঁটু বরাবর এসে হাতখানা হঠাৎ থেমে গেল... হাত যেন আটকে গেছে হাঁটুতে- এমন ভঙ্গিতে হেলেনা বেগমের দিকে তাকিয়ে কবিরাজ বলল- “এই পাতায় তো হবি না... এ.. তো বতি পাতা, কচি পাতা লাগবি, বতি কলাগাছের এক্কেবারে কচি পাতা, পাতা দুডো এক সুমান হতি হবি— আইজ আর হবি না... আবার আসতি হবি শনি নয় মঙ্গলবার... কলাপাতার জোড়াসহ... !

হতাশ হেলেনা বেগম জোড়া কলাপাতা হাতে উঠিয়ে নেয়- তার বেলায়ই ঘটে- বারেবারে ঘটে- একটুর জন্য তার ভাগ্যই বারেবারে আটকে যায়...!!


-রাকিবুল এর মা না ? বাড়ি গেলি ভ্যানে ওঠো ভাবি...

ঘাড় ঘুরিয়ে হেলেনা বেগম দেখে ভ্যানচালক আখতার, তার বাড়ির কাছেই বাড়ি, সম্পর্কে পাড়াতো দেবর, ফেচু কবিরাজের বাড়ি থেকে শাপলা আর তার মা ভানু শাপলার স্বামীর বাড়ির দিকে রওনা হয়ে গেছে। গতরের বিষ বেরিয়ে গেছে- ফিরে এসেছে তাগদ, সেই তাগদ নিয়ে এইবার স্বামী আর সতীনের সাথে এসপার ওসপার করতেই সেই বাড়িতে গমন।

নিজ বাড়িতে ফেরার অপেক্ষায় চৌরাস্তার কোনায় সন্ধ্যার অন্ধকারে দাঁড়িয়েছিল হেলেনা বেগম। মরে আসা বিকেল থেকে তার মাথায় ঘুরছে একটাই কথা- কলাপাতা দুটো বতি হলো কী করে ? সে তো কচি দেখেই কেটেছিল- আবার মঙ্গলবার পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে- আরো তিন দিন!

-সাহাফুল কি বাড়ি আসে না ?

প্যাডেলে পা চালিয়ে প্রশ্ন করে আখতার।

-কোনো মাসে আসে, কোনো মাসে আসে না।

ভ্যানচালক আখতারের কথার উত্তরে বলে ভ্যানে বসা হেলেনা বেগম।

রাকিবুল আর সাহাফুল হেলেনা বেগমের দুই ছেলে। তরুণ দুই ছেলের বড়োজন রাকিবুল ঢাকায় গাড়ি চালায়, বছরে ১-২ বার আসে, ছোটো ছেলে সাহাফুল বাড়ি থেকে কয়েক মাইল দূরে থানায় মোটর মেকানিকের কাজ করত, শোনা যাচ্ছে এক ঢঙি মেয়ের পাল্লায় পড়ে নাকি ঘর বেঁধেছে সাহাফুল- বাড়ি আসার তেমন মন নেই আর। ছেলেদের মন থাকল কি থাকল না, সে নিয়ে ভাবার অবকাশ কম হেলেনা বেগমের, তার এখন একটাই ভাবনা- তার গতরখানা। বিষ ঢুকাইছে- কোন ফাঁকে যেন তার গতরে ক্ষতির শেকড় চালান দিয়ে দিছে... নাইলে তার ভরাট গাঁথুনির মজবুত গতরখানা- এমন ফাটল ধরলো কেমনে- ডান হাঁটুতে ব্যথা।

-মাস্টার থাকলি তুমার আর একলা লাইগত না, কী কও ভাবি ? আয়েসি ভঙ্গিতে প্যাডেল চালাতে চালাতে বলতে থাকে আখতার।

হেলেনা বেগমের স্বামীকে সবাই মাস্টার বলেই ডাকে- বছর দুই আগে গত হয়েছে মাস্টার- স্কুলমাস্টার নয়, লঞ্চের সারেং রুমে কাজ করত, ছোটোখাটো গড়নের লঞ্চের মাস্টার নদীর গতিপথ চিনলেও, যা চিনতে পারেনি তা হলো গতর। হেলেনা বেগমের বিলাসী গতরের গরম আঁচ নেভাতে না পেরে সারাজীবন ঠান্ডা-নরম হয়েই ছিল মাস্টার- বছরের অধিকাংশ সময়ই লঞ্চের সারেংগিরি করে কয়েকমাস পরপর বাড়ি ফিরত মাস্টার, হাত ভরতি সদাই নিয়ে। ছেলেদের জন্য সদাই- নতুন জামা-প্যান্ট, প্লাস্টিকের খেলনা, হেলেনার জন্য রংবেরঙের ফুল-ছাপা জর্জেট ও সুতি শাড়ি, সাজসজ্জা- কত কী। তারপর খেয়ে-দেয়ে বিছানায় পড়ে পড়ে খালি ঘুমাত- যেন কত যুগ নদীর বুকে ঘুমহীন চোখে সাঁতরে আসা ক্লান্ত মাস্টার, ওদিকে ঘরের মধ্যে নদীতে বান ডেকেছে, উথাল পাথাল ঢেউ- এমন ভরা জোয়ারের নদীতে ঝাঁপ দিতে মাস্টারের বড়োই ভয়, বড়োই ক্লান্তি- তবে, তাতে কী ? যৌবনবতী নদী কি আর শান্ত থাকতে পারে...? তাই তো সে ঘর ভেঙেছে, পাড় ভেঙেছে, কুল ভেঙেছে উন্মত্ত স্রোত দিয়ে...

ঝনঝন একটা শব্দ হলো, আয়েসি প্যাডেল চালাচ্ছিল আখতার, চেইন পড়ে গেছে। ভ্যান দাঁড় করিয়ে চেইন ঠিক করতে বসে যায় ভ্যানচালক আখতার। দুই পাশে অন্ধকার, ক্ষেত আর জলা, তারই মাঝে ইট বিছানো পথ, চেইন ঠিক করা দেখে ভ্যান থেকে নেমে দাঁড়াতে যায় হেলেনা বেগম- নিষেধ করে আখতার,

-বসো তুমি ভাবি, তুমার আর কী এমন ভার ?

একটা স্বস্তি আসে হেলেনা বেগমের মনে, গতরখানা যতই নিজের কাছে ভার ভার লাগুক, অন্যের চোখে তাহলে এখনো সে ভারি হয়ে ওঠেনি! এখনো ওই গ্রামের পুরনো ভক্তরা দেখে তাকে, আড় চোখে দেখে। দেখবেই তো, মধ্য চল্লিশ পার হয়েছে হেলেনা বেগম কয়েক বছর আগেই- তারপরও তার মজবুত গতরখানা পুরনো জমিদার বাড়ির মতোই দাঁড়িয়ে আছে শক্তপোক্ত ভীম আর কারুকার্য করা নকশাদার ইট নিয়ে- পুরনো ঐতিহ্যের সাক্ষী হয়ে, শুধু পুরনো জমিদার বাড়ির মতোই ফাটল ধরেছে ভীমে- ফাটল আরো বেড়ে গিয়ে ভেঙে পড়ার আগেই ফাটল ঠেকাতে, ঐতিহ্য ধরে রাখতেই ছুটছে হেলেনা বেগম ফেচু কবিরাজের পিছে- কচি কলাপাতার পিছে। একহাতে চেইন আর অন্য হাতে হেলেনা বেগমের পাশে হাত দিয়ে ভ্যানটা ধরে রেখে ব্যালেন্স ঠিক রাখছে আখতার, কখন যেন তার ভ্যানধরা হাতখানা ভ্যান ছেড়ে আলগোছে উঠে এসেছে হেলেনা বেগমের হাঁটুর উপরে, উরুতে।

ছোট্ট একটা হাসি ফোটে হেলেনা বেগমের ঠোঁটে- হঠাৎ করেই তার মনে হয় তার থেকে বছর সাতেকের ছোটো পাড়াতো দেবর আখতার ইচ্ছে করেই ভ্যানে আর কোনো সওয়ারী ওঠায়নি। এই আখতার ভ্যান চালানোর আগে যুবক বয়সে মনোহারি সাজসজ্জা বিক্রি করত বাড়ি বাড়ি গিয়ে ফেরি করে করে। তার মনোহারি সাজের বাক্শের ডালা খুলে কতবার হেলেনা বেগমের দাওয়ায় বসে হেলেনা বেগমের সুডৌল হাত টিপে টিপে নিজে হাতে পরিয়ে দিয়েছে রঙিলা কাচের চুড়ি, পয়সাও নেয়নি- বলেছে পরের বার এসে ডাব খেয়ে যাবে, পরের বার এসে ডাব না খেয়ে মনোহারি বাক্শো থেকে একটা খয়েরি রঙের লিপস্টিক দিয়ে বলেছে- “তুমার ঠোঁট ছাড়া আর কারো ঠোঁটেই মানাবি না, তাই তুমারেই দিয়ে গ্যালাম ভাবি।”- আসলেই তাই, রূপসজ্জা যেন শুধুই হেলেনা বেগমের ভরা মুখের জন্যে, বাহারি পোশাকগুলো যেন শুধুই হেলেনা বেগমের ঐ খাঁজ-খাদওয়ালা গতরের জন্য- আর গ্রামের শত পুরুষের শত জোড়া চোখ শুধুই হেলেনা বেগমের শোভা দেখার জন্যে !

ভ্যান চলছে ধীরগতিতে- হঠাৎ পেছন থেকে হর্ন দিতে দিতে তাদের বাঁ দিকে পাশ কাটিয়ে অন্ধকার ভেদ করে ছুটে যায় একটি সাদা রঙের প্রাইভেট কার- বাঁ দিকে চেপে যাওয়া ভ্যান নিজের গায়ের জোরে টেনে ওঠাতে ওঠাতে মুখ ভেঙিয়ে সাদা গাড়িটাকে গালি দিয়ে ওঠে আখতার- “আইছে বাওচোচটা, শালার মানুষ বেচাডা আবার বাড়ি আইছে...”

পুরনো এক শিহরণে কেঁপে ওঠে হেলেনা বেগম- বাতাসে ছাতিমের ঘ্রাণ ভেসে আসছে।

টিনশেড ঘরের পুরনো খাটের নিচে কোনায় একটা ছোটো তালা দেওয়া সিলভার কালারের ট্রাঙ্ক- তারই ডালা খুলেছে হেলেনা বেগম- ন্যাপথলিনের গন্ধমাখা ভাঁজ করা কয়েকটা শাড়ি, পুরনো নকশিকাঁথা ও চাদরের নিচ থেকে সযতেœ ভাঁজ করে রাখা চারকোনা জিনিসটা শিহরিত হাতে বের করে আনে হেলেনা বেগম- একটা বেশ পুরনো তেলতেলে কাগজের রঙিন পোস্টার- সিনেমার পোস্টারের মতোই আঁকা- একটা ব্লাউজ ছাড়া, পাতলা জর্জেট শাড়ি পরা শরীরখোলা এক মেয়ে [খুব সম্ভবত নায়িকা], শাড়িটা আবার গা থেকে খুলে যাচ্ছে, খুলে যাচ্ছে বললে ভুল হবে- মেয়েটা যেখানে দাঁড়িয়েছে তার থেকে একটু উঁচুতে যেন একটি টিলার কিনারা, সেই উঁচু জায়গায় উপুড় হয়ে শুয়ে থেকে এক যুবক [মনে হয় নায়ক] শক্ত হাতের মুঠোয় মেয়েটার আঁচল ধরে টানছে, হয়ত মেয়েটাকে টেনে তুলছে আর এভাবেই যুবকের সামনে খুলে যাচ্ছে মেয়েটার শাড়ি, খুলে যাচ্ছে ভাঁজ, খুলে যাচ্ছে একটার পর একটা বন্ধ দরজা- সামনের দরজা, পেছনের দরজা-

দরজা হেলেনা বেগমও খুলেছিল, খুলতে হতো প্রায় প্রতিরাতেই, এক যুবকের জন্য। যুবক তখন দুই তিন বারের চেষ্টায় পরীক্ষা দিয়ে কোনোরকমে টেনেটুনে ডিগ্রি পাস, বেকার। উদার বড়ো ভাইয়ের স্নেহের কৃপায় মেলা পয়সা দিয়ে পানির মেশিন কিনেছে, গ্রামের সবার ধানক্ষেতে টাকার বিনিময়ে মেশিন দিয়ে পানি দেওয়ার দায়িত্ব নিয়েছে- রাতে রাস্তার ওই পাড়ে মেশিনঘরে থাকে একা। রাস্তার এই পাড়ে সারেং মাস্টারের রেখে যাওয়া ভরা জোয়ারের যৌবনবতী নদীটাও একা। যুবক নদীটাকে একা নিরানন্দে ফেলে রাখেনি, সাঁতরেছে- যৌবনের বান ডাকা ভরা নদীতে সাঁতরেছে- উপুড়সাঁতার, চিৎসাঁতার, ডুবসাঁতার- এপার থেকে ওপার, মধ্যরাত থেকে ভোররাত- ব্যাঙের ডাক থেকে পেঁচার ডাক- আতা ফুলের ঘ্রাণ থেকে ছাতিম ফুলের ঘ্রাণ পর্যন্ত প্রাণ ভরে সাঁতার কেটেছে যুবক- মাতাল করে দিয়েছে বাধভাঙা নদীটাকে।

অন্ধকার রাস্তা থেকে একটি বাইকের শব্দ ক্রমশ ঘন হয়ে আসছে- চেনা শব্দে সতর্ক হেলেনা পোস্টারটা লুকিয়ে ফেলে এগোয় ঘরের দরজার দিকে- উঠোনের কোনায় বাতাবিলেবু গাছের কাছে বাইকটা দাঁড় করিয়ে হেলেনার ঘরের দিকে এগিয়ে আসে লম্বা-চওড়া শক্তপোক্ত গড়নের বছর পঞ্চাশের এক পুরুষ- আকবর, হেলেনার ননদের স্বামী। কয়েক বছর মিলিটারিতে চাকরি করে কী এক কারণে চাকরি ছেড়ে ফিরে এসেছে গ্রামে, তিনখানা ছেলে মেয়ের বাপ, শুকনা শরীরের খিটখিটে মেজাজের বউয়ের সাথে বনিবনা না হলেও হেলেনা বেগমের বেশ ভক্ত এই আকবর। প্রায়ই আসে হেলেনার ঘরে, খোশগল্প করে যায়।

-গতরে বলে বেদনা হইছে তুমার, এদিক ওদিক বলে যাওয়া-আসা করতিছো, তা আমাগেরে তো কিছুই কও নাই-

হেলেনার দিকে তীর্যক চাহনি দিয়ে বলে ওঠে আকবর।

-না কওয়াতেই তুমার বউ চান্দে চান্দে ঝগড়া করতি আসে, তুমারে কইয়েকি তুমার বিপদ আরো বাড়ায়ে দেব ?

হেলেনাও ভুরু নাচিয়ে আকবরের কথার উত্তর দেয়।

-ওর কথা বাদ দেও, মাথায় ছিট আছে, তুমার গতরের বানটা ভালো, এত তাড়াতাড়ি বিষবেদনা হওয়ার তো কথা না-

হেলেনার বাড়িয়ে দেওয়া সরবতের গ্লাস হাতে নিতে নিতে বলে আকবর।

-সিডা তুমার বউরে জিজ্ঞেস করো, কোন গাছের শিকড় আমার গতরে চালান দিয়ে দেছে ?

-সত্যিই দেছে নাকি ? আমার বউ দেছে নাকি সালামের বউ দেছে ?

হেলেনার কথার প্রতিউত্তরে আকবরের বলা ইঙ্গিতপূর্ণ কথাটায় সতর্ক হয় হেলেনা বেগম। বাড়ির কাছের রাস্তার মোড়ে ছোটোখাটো বাজার- সেখানেই সালামের সদাইয়ের দোকান- হেলেদুলে চলা হেলেনা দোকানে সদাই আনতে গেলেই- সালাম গল্প জুড়ে দেয়- দোকানের সামনে বেঞ্চিতে বসিয়ে দুধ-চা খাওয়ায়, মাঝে মাঝে মোবাইলে ছাড়ে গান-

“জং ধইরা গেছে তালায়-

হেড মিস্তিরি কোন জায়গায় ?

তেল মাইরা দে, যৌবনের তালায়...”

সালামের গান শোনানোর খবর তাহলে সালামের বউ জেনে গেছে, ঠিক যেমন সেই যুবকের সাঁতরানোর খবর জেনে গেছিল বাড়িতে থাকা তার এক ভাবি, যুবকের মেজভাবি !

বাইকে উঠে স্টার্ট দিয়েছে আকবর, হঠাৎ দাওয়ায় দাঁড়ানো হেলেনার দিকে ফিরে বলে-

‘মানুষ বেচাডা’ তো এহন বাড়ি- তুমার ইট্টু খোঁজ নিলিও তো পারে- আকবরের বলা কথার খোঁচাটা বুকের মধ্যে খেজুর কাঁটার মতো গিয়ে বিঁধে হেলেনা বেগমের- বুকটা জ্বলে ওঠে, একইসাথে ডান হাঁটুটাও যেন ব্যথায় খচখচ করতে থাকে...!

নির্জন দুপুর। রোদ বেশ ঝাঁঝালো, তেজ থেকে আড়াল হতে একটি কড়াই গাছের ছায়ায় বসে আছে হেলেনা বেগম। ক্লান্ত লাগছে। বেশ কয়েক দফা দৌড়াদৌড়ি হয়েছে পায়ের ব্যথাটা নিয়ে। শনি ও মঙ্গলবারে কয়েক দফায় কচি, উজ্জ্বল সবুজ কলাপাতার জোড়া কেটে নিয়ে যাওয়া হয়েছে ফেচু কবিরাজের ঘরে। কাজ হয়নি। প্রতিবারই ফেচু কবিরাজের হাত হেলেনা বেগমের গতরের চড়াই উৎড়াই বেয়ে নামে- ঠিক হাঁটুর কাছে এসে হাতখানা আর নামতে চায় না, প্রতিবারই দোষ ধরা পড়ে, কোনোবার পাতা দুটোর সাইজের দোষ, কোনোবার রংয়ের, কোনোবার আবার পাতায় দাগ- প্রতিবারই একটা-না-একটা দোষ পাওয়া যায়। হেলেনা বেগমের কেন যেন মনে হয়- তার হাঁটু দুটোই কবিরাজের হাত দুটোর শেষ ঠিকানা, হাত দুটো ট্রেনের মতো চলতে শুরু করে তার গতরের খাঁজ আর খাদ বেয়ে ভ্রমণ করে প্রতিবার ওই হাঁটু দুটোতে এসেই থেমে যাবে, এরপর আর কোনো স্টেশন নেই- কিংবা থাকলেও ট্রেন চালকের যেন যাওয়ার মন নেই।

মনে একটা দুশ্চিন্তা এসে ঢুকেছে হেলেনা বেগমের- গতরে ঢোকা বিষ এখনো বের করা গেল না- বেড়ে গিয়ে সারাগতরে যদি ছড়িয়ে পড়ে- তাই তো সে তাড়াতাড়ি ছুটে এসেছে এখানে- মাদ্রাসার হুজুরের কাছে, বিষ কাটানোর পানি পড়া নিতে।

হাসির শব্দ কানে আসে, মেয়েলি হাসির রিনিঝিনি শব্দ, পেছনে ফিরে তাকায় হেলেনা- কুড়ির ওপর বয়স এমন এক শহুরে মেয়ে- বিরাট হা করা পিঠ কাটা ব্লাউজের সাথে এমনভাবে শাড়িখানা পরেছে যাতে গতর আর ঢাকে না, ছতর, গতর সবই আধা আধা দেখা যায়। মেয়ের হাতে একটা ফোন, কথা বলতে বলতে এগিয়ে আসছে, মনে হয় ফোনের ভেতর কারো সাথে ভিডিওতে কথা বলছে, গোপন কথা, বলার জন্য আড়াল দরকার, তাই বুঝি এই শুনশান দুপুরে মাদ্রাসা চত্বরের আঙিনার নির্জনে হাঁটতে হাঁটতে এগিয়ে এসেছে। আড়াল খোঁজা মেয়েটাকে কী ভেবে একটুখানি আড়াল করে দিতেই নিজেকে আরও একটু গাছের আড়ালে লুকিয়ে ফেলে হেলেনা বেগম!

কথা বলতে বলতে কড়াই গাছের অনেকটা কাছে এসে পড়েছে মেয়েটা, শোনা যাচ্ছে তার কথোপকথন

-“আরেকটু নিচে নামাও, ফোনটা আরেকটু নিচে নামাও- ভালো করে দেখতে দাও”

একটি পুরুষ কণ্ঠের আদুরে আবদারের উত্তরে কাচভাঙা হাসিতে ফেটে পড়ছে মেয়েটা, পুরুষ কণ্ঠটি আবার বলে-

-খালি উপরটাই দেখাবা ? শরীরের নিচটা দেখাবা না ? ফোনটা আরেকটু নিচে নামাও, দেখাও না নিচটা..

হাসিতে ভেঙে পড়ছে মেয়েটা, যেন একটি অবুঝ বালককে শান্ত করছে এমন ভঙ্গিতে ফোনটা গলা থেকে বুক হয়ে নাভির কাছে নামিয়ে এনেছে মেয়েটা- নাভি বরাবর রেখে আবারো হাসছে কাচভাঙা হাসি, ছেলেটাও হাসছে...!

এমন হাসি হেলেনার সেই যুবকটিও হেসেছিল, ছাতিম ফুলের ঘ্রাণ ছড়ানো একরাতে এসে পোস্টারটা দেখিয়ে হেলেনাকে বলেছিল- ঠিক তুমার মতো, না না তুমার কাছে এই নায়িকাও ফেইল, তুমার পিছনডা আরো সুন্দর, কলসির মতো-

-“ধর্মের কল বাতাসে নড়ে, দেহিসো- যেমন পাপী বাপ, তার তেমন পাপের মাইয়ে”,

কথা শুনে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় হেলেনা বেগম, শাপলার মা ভানু, হেলেনার মতোই মনে হয় ভরদুপুরে হুজুরের কাছে মেয়ের স্বামীর জন্য তদবির নিতে এসেছে। স্বামীকে বশ করার তদবির। শরীর থেকে সেদিন বিষ বের করার পরও, সতীনের দেওয়া বিষের টোটকা শাপলার স্বামীর মনেও ছড়িয়েছে, শাপলাকে স্বামী সেদিন বাড়িতে দাঁড়াতেও দেয়নি, তাড়িয়ে দিয়েছে...

কথা বলতে বলতে হাসতে হাসতে ফিরে যাচ্ছে মেয়েটা, দূরে বড়ো বাড়িটার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে- সেদিকে তাকিয়ে ভানু বলে ওঠে, মানুষ বেচাডার মাইয়ে, নাম ঐশী- “যমন বিজাত, তেমন দজ্জাল, তেমন বেহায়া, চাইরবার বলে বাইর হইছে, এক এক বার এক এক ছেমড়ার সাথে...”

বের হওয়ার কথা ছিল হেলেনারও, শহরে বড়ো চাকরি করা বড়ো মনের উদার বড়ো ভাইটাকে পটিয়ে একটা মোটরপার্টসের দোকান দিয়েছিল যুবক, হেলেনাকে বলেছিল লাভ আর একটু বেশি হলেই হেলেনাকে সাথে করে ঢাকায় পাড়ি জমাবে- হেলেনাও স্বপ্ন দেখেছিল মাস্টারের ঘরের ছোটো দুই ছেলেকে নিজের মায়ের বাড়িতে রেখে যুবকের হাত ধরে ঢাকায় পাড়ি দেয়ার- যুবক ঠিকই মোটা টাকা লাভ করে পকেটে ভরে পাড়ি দিয়েছিল ঢাকায়। তবে, তার লাভের টাকার হিসাব হেলেনা জানতে পারেনি, হিসাব জানতে পারেনি যুবকের উদার বড়ো ভাইটাও।

-বিজাত মাইয়েডার বলে এট্টা স্বামী আছে, সিডারে ওর সাথে আর দেহা যায় না, খালি নাঙগের [প্রেমিক] সাথে এইরম পিরিত কইরে বেড়ায়... একশ্বাসে বলতে থাকে ভানু, বাড়ি বাড়ি জোগানের কাজও করে ভানু, তার কাছে তাই টাটকা খবর থাকে। আবার কথা বলে ভানু-

“পাপের পয়সার ছাওয়াল মাইয়ে কি ভালো হয় নাকি ? শয়তানডার বড়ো ভাইডা কত ভালো ছিল, সবের উপকার কইরত, সেই ভাইর টাকা মাইরে খাইছে, ভাইডা যহন অসুস্থ হয়, তহন বলে ও খুশি হইছে, চায় নাই ভাই সুস্থ হয়ে ফিরে আসুক, ভাই’র সম্পত্তি ভাঙায় খাবি, ভাই’র সবকিছু চুষেই তো কত টাকা বানাইছে...”

চুষে নিয়েছিল যুবক- হেলেনার সময়, হেলেনার স্বপ্ন। ঢাকায় গিয়ে ভাইয়ের পয়সায় ওকালতি পড়েছিল, তারপর একদিন রঙিন কাগজে সাজানো কলাগাছের তোরণ দিয়ে নতুন বউ সাথে নিয়ে ঢুকেছিল বাড়িতে- পেছনে তখন ছিনতাই হয়ে গেছে হেলেনার স্বপ্ন।

-মার কানের সুনাও [সোনা] ও ছিনায় নিবার পারে, আবার কথা বলতে থাকে ভানু

-ওর কোনো ধর্মই নাই, গ্রামের কাউরে একপয়সারও সাহায্য করে না, পারলি আরো খসায় নেয়, এক হাটে থেইকে মানুষ কিনে অইন্য হাটে বেইচে আসে, মানুষ কি আর এমনি এমনি ওর নাম ‘মানুষ বেচা’ দেছে ?

মানুষেরা এমনি এমনিই জেনেছিল, হেলেনা আর যুবকের সাঁতারকাহিনিও এমনি এমনিই জেনে গিয়েছিল, যুবকের বাড়িতে থাকা মেজভাবিটাই সারাগ্রামে রাষ্ট্র করেছিল হেলেনা আর তার দেবরের কথা। দু’চারজন অভিজ্ঞ নারী হেলেনাকে জানিয়েছে হেলেনার আগেও যুবক আরো কারো কারো গতর মেপেছে, বিশেষ করে যুবকের মেজভাবির সাথে যুবকের গতরের লেনাদেনা। পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারেনি হেলেনা, তাই তো পোস্টারটা আজও দেখে সে, নেড়েচেড়ে দেখে !

রোদের ঝাঁঝ কমে আসছে, মাদ্রাসার কোনার রুমটার দরজা খুলতে দেখা যায়, হুজুরের বিশ্রাম নেওয়া শেষ, এখন দেখা করা যাবে, সেদিকে পা বাড়াতে যাবে হেলেনা, হঠাৎ ভানু বলে ওঠে- দেহিসো কান্ডু, কেমন নওশা সাইজে ঘুইরতেছে।

ভানুর কথায় দূরে বড়ো বাড়িটার দিকে নজর যায় হেলেনার- টকটকে কমলা রঙের পাঞ্জাবি পরে বাড়ির আশেপাশে দিয়ে ঘোরাঘুরি করছে ‘মানুষ বেচাডা’ হেলেনার একসময়ের প্রেমিক- বাঁধভাঙা নদীতে সাঁতার কাটা সেই যুবক।

গতরে সত্যিই ফাটল ধরেছে হেলেনার। হাঁটুর ব্যথাটা বেড়েছে ভীষণ। সাথে বেড়েছে মনের ব্যথাও। গত কয়েক মাসে হাতে থাকা পয়সাগুলো কবিরাজ, হরেকরকম বৈদ্য, পানিপড়া, তাবিজপড়ার পেছনে দিয়ে দিয়ে হাত একেবারেই খালি। ওদিকে ছোটো ছেলে ঢঙ্গি মেয়েটার পাল্লায় পড়ে পয়সাও দেয় না, বাড়িও আসে না, বড়ো ছেলের গাড়ি অ্যাক্সিডেন্ট করেছে, চালকের চাকরিটাও নেই আর, চাকরি খুঁজছে সে। এতসব বিপদের মধ্যে বড়ো বিপদ হলো হাঁটুর ব্যথাটা এমনভাবে বেড়েছে- পা ফেলতে ভারি কষ্ট ! একটা মোটা লাঠিতে ভর দিয়ে পা ফেলতে হয় হেলেনা বেগমের। তার গতরের এমন পরিবর্তনের সাথে সাথে তার ভক্তদেরও অদ্ভুত কিছু পরিবর্তন খেয়াল করেছে হেলেনা- আখতার আর তাকে দেখলেই ভ্যানে উঠতে বলে না, আকবরও বাইক নিয়ে হেলেনার বাড়ি আসা কমিয়ে দিয়েছে, সালামের দোকানে সদাই আনতে গেলে আগের মতো বসিয়ে দুধ-চা আর খাওয়ায় না- সেদিন দোকানে সদাই আনতে গেলে হেলেনার হাতের লাঠিটার দিকে একনজর তাকিয়ে আগের সদাইয়ের বাকি পয়সা তাড়াতাড়ি জমা দিতে বলে সালাম। ফিরে আসার সময় হেলেনা শুনতে পায় সালাম গান শুনছে-

“তাজা ফলে মজা দ্বিগুণ

মরিচ পাকলে লাল

ও বন্ধু, মার ছক্কা,

ধুম-ধারাক্কা,

গুটি লালে লাল”

হেলেনার গতরও তাজা ছিল, হঠাৎ কেমন ক্ষয় ধরে গেল- ইদানীং গতরের ওপর ভারি রাগ হয় হেলেনার- পোস্টারটা ফেলে দিয়েছে সে।

ভানু এসে খবর দেয়, দুপুরের পর মাদ্রাসার আঙিনায় গোশত বিলি হবে, মানতের দুটো ছাগল। ছাগলের গোশত তার পথ্য, যাবে হেলেনা, লাঠিতে ভর দিয়ে হলেও যাবে, এখন আর তার সেই শোভা নেই, শত ভক্তের চোখ আর তাকে খোঁজে না, মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে দেখেও না আর।

মাদ্রাসার আঙিনায় এসে একটু বিব্রতই হয় হেলেনা বেগম। ‘মানুষ বেচা’র ছেলে চাকরি পেয়েছে, সেই মানতের ছাগল। পাশে বসা ভানু আস্তে আস্তে বলে,

-“ম্যালা টাকা ঘুষ দিয়ে বলে ছাওয়ালডারে এট্টা চাকরিতি ঢুকোইছে, মানুষজনের কাছে খালি নাম কিনতি চায়, মানুষ খালি ওরে গাইল পারে-

ভাই’র টাকায় বড়ো হইছে, ভাই’র সাথে বেইমানি করছে- মানুষ খালি ওরে ‘মানুষ বেচা’ কয়- সেই সব খারাপ কথা ঢাকতি ওর মতো কিপটে ছাগলের গোশত দিয়ে মানুষির কাছে নাম কিনতি আইছে।”

বেইমানি তো হেলেনার সাথেও হয়েছে, বেইমানি হয়েছে হেলেনার মনের সাথে, গতরের সাথে- হেলেনার স্বপ্ন ছিনতাইয়ের পর ‘মানুষ বেচা’ডার সাথে হেলেনার খুব কমই দেখা হয়েছে, দূর থেকে হেলেনাকে দেখে ব্যস্ত ভঙ্গিতে সরে গেছে ‘মানুষ বেচা’, তখন অতটা খারাপ না লাগলেও ইদানীং গতরে ক্ষয় ধরার পর, কেন যেন হেলেনার মনে হয় তার গতরের পচনটা ওই ‘মানুষ বেচা’ডাই ধরিয়েছিল যুবক বয়সে, তার গতরের বিষ ওই ‘মানুষ বেচাডা’রই দেওয়া।

গোশত নিতে আসা মানুষগুলোর মধ্যে হঠাৎ একটা ঠেলাঠেলি শুরু হয়ে যায়, প্রথম সারির মানুষেরা গোশত নেওয়ার পর হইচই শোনা যায় পেছনের সারিতে, বড়ো ঘোমটা দিয়ে নিজের মুখ ঢেকে পেছনের সারিতে ছিল হেলেনা, তার বেলায় এসেই গোশত দেওয়া আটকে গেল, ধাক্কাধাক্কি, ঠেলাঠেলি, চিল্লাপাল্লা- কানে ভেসে আসে ক্ষুব্ধ মানুষের কথা-

-ভালো কিছু তো দেও নাই, ফেপসা, ঠ্যাং, হাড্ডি, গোশত কই ?

জনতার রোষ থামাতে ধমকে ওঠে সাদা পাঞ্জাবি পরা ‘মানুষবেচাডাও-

“এত গোশত খাতি চাও ক্যা ? গতরে গোশত কম আছে নাকি?”

মানুষের ধাক্কাধাক্কি ও ঠেলাঠেলির স্রোতে আচমকা হেলেনা বেগম ‘মানুষ বেচাডা’র সামনাসামনি, মুখোমুখি, কয়েক সেকেন্ড, হাতের ছোট্টো পোটলাটা খুলে দেখে হেলেনা- দুই টুকরো তেল, দুই টুকরো হাড্ডি আর ফেপসা মতন কী সব- একটানে ঘোমটাটা টেনে খুলে ফেলে হেলেনা, পোটলাটা সজোরে ছুঁড়ে মারে ‘মানুষবেচাডা’র মুখ বরাবর- চিৎকার দিয়ে বলে ওঠে-

“তোর গোশত, তুই খা, ছোটোলোকের বাচ্চা”

সজোরে হাঁটতে শুরু করে হেলেনা বেগম, পেছনে তখন ক্ষুব্ধ জনতা একের পর এক পোটলা ছুঁড়ে মারছে ‘মানুষ বেচাডা’র গায়ে, কেউ কেউ ঢিল আর সুরকিও ছুঁড়ে মারছে।

***

হন হন করে হাঁটছিল হেলেনা বেগম, হঠাৎ খেয়াল হয় মোটা লাঠিটা ভিড়ের মধ্যেই ফেলে এসেছে, অদ্ভুত ব্যাপার হলো- লাঠি ছাড়া পা ফেলতে একটুও কষ্ট হচ্ছে না, ডান হাঁটুতে সেই ব্যথাটা নেই আর...

গতর থেকে সবটুকু বিষ বেরিয়ে গেছে কখন !

অলঙ্করণ : স্ব. সরকার