পিকআপ ভ্যানে মালপত্র ওঠাতে যেয়ে ছোট্ট একটা পুরনো লাগেজ নিচে পড়ে যায় থপ করে। লক ভেঙে দুই ভাগ হয়ে ভেতর থেকে পাখির পালকের মতো পিচের রাস্তায় ছড়িয়ে পড়ে কতগুলো ছোটো ছোটো ভাঁজ করা কাগজ। কাগজগুলো ছোপ-ছোপ লালচে দাগে ভরা। দেখেই বোঝা যাচ্ছিল অনেক বছর আগের। একটা কাগজ হাতে তুলে নেয় রাইসুল। ভাঁজ খুলতেই কয়েক লাইনের লেপ্টানো লেখা চোখে পড়ে। লেখার ভাষাটা বাংলা না। তবে, চেনা মনে হয়। কিন্তু সে পড়তে পারে না। এগুলো যে চিঠি-তা অনুমান হয়।
আরো কিছু কাগজের সঙ্গে এগুলোও তার বাবার প্রয়োজনীয় কাগজ ভেবে বাকিগুলোও কুড়িয়ে একসাথে করে। লাগেজে পুরে আবার পিকআপে তোলে।
এটি বেশ কয়েক বছর আগের ঘটনা।
আজ এই চিঠিগুলোই রাইসুলের কাছে প্রধান প্রমাণ। এ প্রমাণের কাছে আর কিছু মিথ্যা হতে পারে না। রাইসুলের শরীর তিরতির করে ঘামে। সমস্ত পৃথিবীটা একটা প্লাবনের মতো উছলে উঠে ধাক্কা দেয় তাকে। শূন্যের ভেতর সে ভাসতে থাকে ভারসাম্যহীন। একদিকে চরম সত্যের আবিষ্কার, নিষ্ঠুর বাস্তবতার পোড়াসাক্ষ্য উপস্থিত, অন্যদিকে রক্তের সম্পর্ক! কোন দিকে যাবে রাইসুল? ঘাম ঝরতে থাকে কপাল বেয়ে।
সামনে ডায়নিং টেবিলে একটা আপেল কাটার ছুরি। চকচকে। ছুরিটা তার দিকে চেয়ে আছে। রাইসুল একবার চিঠিগুলোর দিকে তাকায়, একবার ছুরিটার দিকে। একবার ছুরিটার দিকে তাকায়, একবার চিঠিগুলোর দিকে। সত্য বড়ো, না সম্পর্ক; সম্পর্ক, না সত্য? প্রশ্নটা মাথার মধ্যে ঘুরতে থাকে ভনভন করে।
কোভিড-১৯ এর আঁচ এ দেশের শ্যামল ছায়ার গায়েও আছড়ে পড়েছে। কথায় আছে না, বাঙালির সব কিছুতেই একটু বেশি বেশি ? তাই-ই হলো। এক রাতে দশ টাকার মাস্কের দাম একশ, দুইশ’, তিনশ’। পঞ্চাশ টাকার হ্যান্ডওয়াশ চারশ’, পাঁচশ’! সাবানের দাম দ্বিগুণ, ত্রিগুণ। রোগ নির্ণয়ে জাল-জালিয়াতির ছড়াছড়ি। যে যেভাবে পারে হাতিয়ে নেওয়ার ফন্দি। প্রকাশ্যে, গোপনে হরিলুটের চেষ্টা। এরূপ বিশৃঙ্খল কায়দা-কানুনের মধ্যে রাইসুলের তরুণ মন বিক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। দম বন্ধ হয়ে আসে। সবকিছুতেই একটা ভজঘট রেলগাড়ি। লকডাউন, বাজারমূল্য, দিনমজুরদের জীবন-যাপন, সমন্বয়হীনতায় দুর্গতি। দেশপ্রেম, ন্যায়-নীতি, ইচ্ছা-আদর্শের জায়গায় একসাগর রক্তের বিনিময়ে প্রাপ্ত স্বাধীন দেশটার মানুষের প্রতি তার নানান প্রশ্ন জাগে। হৃৎপি-ের ভেতরে একটা ঘোড়া টগবগ করে দৌড়ায় হাজার মাইল বেগে। রাইসুল উদ্বিগ্নতার সঙ্গে সব প্রশ্নের উত্তর খোঁজে। পায় না। মিল খুঁজে পায় না চারপাশের মানুষের কর্মের, কাজের, স্বভাবের, চরিত্রের। নেতার কিংবা নেতৃত্বের। দুর্দান্ত বিভ্রমের পাতা ওড়ে। কোথায় কল, কোথায় হাতল তার দিক নেই। কে নিয়ন্ত্রণ করে, কে নিয়ন্ত্রণ মানে তারও নেই সন্ধান, অনুসন্ধান। সুযোগ-সন্ধানীরা ওঁত পেতে আছে।
দুই লাখ মা-বোনের ইজ্জত, পিতার রক্ত, ভাইয়ের আত্মত্যাগ আর অসহনীয় নিপীড়ন, নির্যাতন সহ্যের পর যে দেশ, সে দেশের প্রতি কারো কোনো দায় নেই, দায়িত্ব নেই, কর্তব্য নেই, বোধ নেই, বিচার নেই। হিসাব-নিকাশ নেই। এক পাড়ে সংক্রামকের থাবা থেকে বাঁচার ফরিয়াদ, অন্য পাড়ে গুণ-ভাগের চতুর দাবা খেলা। ‘ছেলের হাতের মোয়া’র মতো যার যা ইচ্ছা তা-ই করে চলেছে। দেখেও না-দেখার ভান করছে, যাদের চোখ আছে। যাদের চোখ নেই, তাদের তো কথাই নেই।
ভাবতে ভাবতে রাইসুল নিজেকে দেখতে পায় তুলোর শরীরে বলপেনের নিবের ফোঁটার চেয়েও ছোট্ট এক ফোঁটায়। আত্মোপলব্ধিতে বলে ওঠে-‘না না, এভাবে চলে না।’
কিন্তু কে শোনে? কে শুনবে?
মুক্তিযুদ্ধ দেখেনি রাইসুল। যুদ্ধের অনেক বছর পরে তার জন্ম। ভূমিষ্ঠ দিনের তারিখ কোথাও লেখা আছে বলে তার জানা নেই। সার্টিফিকেটে যে তারিখ দেওয়া সেটাকেই তার জন্মসাল বলে মানে সে। যুদ্ধের অনেক বছর পর জন্ম হলেও বই পড়ে, চলচ্চিত্র দেখে, গান শুনে, ইতিহাস থেকে জেনে, সাংগঠনিক চর্চায় রাইসুলের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা প্রবল। জাতিসত্তার বোধে বোধনে দেশ বলতে রাইসুল বোঝে-অদ্বিতীয় অস্তিত্ব, মা, মানচিত্র। তাই মাতৃভূমির জন্য, সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য, মুক্তিযুদ্ধের মধ্যদিয়ে পাওয়া এই দেশটির মুক্তি ও কল্যাণ অক্ষুণœ রাখার জন্য সে অনেক কছু বিসর্জন দিতে প্রস্তুত। এমনই তার অনুভূতি।
যেহেতু রোগটা নতুন, দস্যুর মতো দুর্ধর্ষ, প্রবল ছেঁাঁয়াচেজাতীয় সেহেতু সদ্য-ফেরত প্রবাসীরা কিছু দিন ঘরে থাকলে দোষ কোথায়? কী এমন ক্ষতি এতে? সন্দেহভাজনেরা নির্দেশ মান্য না-করা, হাসপাতাল থেকে পালিয়ে উধাও হয়ে যাওয়া, হাটে-বাজারে অবাধে ঘোরাঘুরি করা ইত্যাদি ভাইরাল খবরে তার রাগ দাউদাউ করে চড়ে মাথায়। ঘরে বসে থেকে খিটমিট লাগে তার। বন্ধুদের সঙ্গে, সংগঠনের বড়ো ভাইদের সঙ্গে ফোনে শেয়ার করে এসব কথা, সেকথা। তার আরও খিটমিট লাগে রোগটাকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করায়। পত্রিকা, টিভি, অনলাইন দেখলে দেখা যায় হ-য-ব-র-ল এর অভাব নেই।
নিয়ম মেনে সন্ধ্যার আগে হাঁটতে বের হয় রাইসুল। বাসার কাছে ‘দ্যা চাইল্ড হেভেন’ নামক ফাস্ট ফুডের দোকাটাতে বসে। ওয়ানটাইম মগে একমগ কফি নিল সে। দুজন মুরুব্বিও এসে নির্দিষ্ট দূরত্ব রেখে বসেছে। তাদের মুখেও মারিকালের ও দেশে ফেরৎ প্রবাসীদের অসচেতন আচরণের খবরের আলাপ। রাইসুল কফির মগে চুমুক দেয়। বাসায় রাখা হয়নি এমন একটা পত্রিকা উল্টিয়ে দেখে। অপেক্ষাকৃত কম বয়সী বয়স্ক লোকটি কিছুটা ক্ষুব্ধ স্বরেই বেশি বয়স্ক লোকটির উদ্দেশে বলে- ‘এই সময়ে বিদেশফেরতদের আসলে মুক্তিযুদ্ধপরবর্তী এ দেশের রাজাকারদের মতো সেল্ফ কোয়ারেন্টিনে যাওয়া দরকার। কেউ যেন খোঁজ না পায়। দরজার নিচ দিয়ে, জানালার ফাঁক দিয়ে তাদের প্রয়োজনীয় জিনিস-পত্র দেওয়া হবে। যদি তারা রোগটি বহন করে তবে তা আর ছড়াবে না। যদি ভাইরাসটি বহন না করে, নির্দেশিত চৌদ্দ দিন পর বের হয়ে আসবে। এ তো সবার জন্যই নিরাপদ, তাই না ?’
রাইসুলের খেয়াল কফির মগ আর পত্রিকায় থাকলেও তাদের ‘রাজকারদের মতো সেল্ফ কোয়ারেন্টিন’ বাক্যটিতে চট করে আটকে যায়। বাকি কথাগুলোও সে শুনতে থাকে।
‘কোয়ারেন্টিন’ শব্দটির সঙ্গে রাইসুলের পরিচয় ঘটেছে এরমধ্যে। ইন্টারনেট ঘেটে শব্দটির অর্থ, উৎপত্তি, ব্যবহার জানলেও মুক্তিযুদ্ধ আর রাজাকারদের সঙ্গে শব্দটি কীভাবে যায় তা তাকে ভাবনায় ফেলে। উপস্থিত প্রবীণ দুজনের কাছে জানতে চেয়েও চাওয়া হয় না। বাসায় ফিরে কম্পিউটার অন করে সার্চ করতে থাকে, কোয়ারেন্টিন-রাজাকার-মুক্তিযুদ্ধ।
তিনটি শব্দের মধ্য যোগসাজস পায় না সে। বইয়ের তাক থেকে মুক্তিযুদ্ধের ওপর কিছু বই নামিয়ে দেখতে থাকে, প্রয়োজনীয় মার্ক করা লাইনগুলোতেও খোঁজে। কিছুই পায় না।
দিনকয়েক পর রাইসুল তার চাচা অধ্যাপক সিরাজুল ইসলামের শরণাপন্ন হয় শান্তিনগর থেকে ঝিগাতলার বাসায়। হাত ধুয়ে ঘরে ঢুকতেই চাচা সম্বোধন করেন-
‘কীরে এত দিন পর আমাদের কথা মনে পড়ল ?’
‘মনে পড়ে সব সময়ই চাচা। আসা হয় না মাত্র। আর যে অবস্থা চলছে! তাতে আসার জো আছে ? যাক, তোমরা কেমন আছো ?’
রাইসুল জানতে চায়।
‘ভালো।’ চাচা উত্তার দেন।
‘একটা বিশেষ কাজে তোমার কাছে এসেছি। বলতে পারো জরুরি।’
‘বল, কী কাজ ?’
সিরাজুল ইসলামের একান্ত পড়ার ঘরে তারা দুজন একটা টেবিলের দুই প্রান্তে বসে। রাইসুল বলে-
‘চাচা, তুমি তো মুক্তিযোদ্ধা, সরাসরি যুদ্ধ করেছ। মুক্তিযুদ্ধ গবেষকও। তুমিই তো এ দেশে প্রথম রাজাকারদের নামের ডায়েরি প্রকাশ করলে। বইতে লিখলে কোন রাজাকার কোথায় আত্মগোপনে আছে, তাই না ?’
‘তা ত্ইু জানিস।’
‘আচ্ছা বলো তো তাহলে, সেল্ফ কোয়ারেন্টিন শব্দটির সঙ্গে রাজাকার শব্দটি কীভাবে সম্পর্কিত ?
‘আচ্ছা, এই কথা! আমি ভাবলাম কি-না কি, তো এত দিন পর এ নিয়ে কৌতূহল জাগল কেন, কী হয়েছে ?’
‘তুমি তো ভালো করেই জানো, আমি মুক্তিযুদ্ধ, দেশ, স্বাধীনতা বিষয়ে একটু বেশি আগ্রহী।’
‘তা জানি।’
‘তাহলে বলো, আমি জানতে চাই।’
একটু সময় নিয়ে সিরাজুল ইসলাম বলতে থাকেন- ‘সেল্ফ কোয়ারেন্টিনের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের কোনো সুসম্পর্ক নেই। সুসম্পর্ক আছে রাজাকার-আলবদর-আলসামস অর্থাৎ যারা মুক্তিযুদ্ধের সময় এ দেশেরই মানুষ হয়ে এ দেশের বিরোধিতা করেছে, বিপক্ষে কাজ করেছে, পাক হানাদার বাহিনীর সঙ্গে হাত মিলিয়ে এ-দেশের সর্বাত্মক ক্ষতি সাধনে গুম, খুন, ধর্ষণ, লুটপাটসহ জঘন্য দুষ্কর্মের অগ্রভাগে ছিল। লাখ লাখ লাশ আর রক্তের ক্ষত বুকে নিয়ে ১৯৭১-এর ডিসেম্বরে যখন দেশ স্বাধীন হলো, একটি নতুন বাংলাদেশ জন্ম নিল তখন ওই পাকিস্তানিদের এ দেশীয় দোসররা শাস্তি পাওয়ার ভয়ে ও স্থানীয়দের রোষানলে পড়ার আশঙ্কায় কেউ এলাকা ছাড়ল, কেউ দেশ ছাড়ল, কেউ আত্মগোপনে চলে গেল, কেউ যেন তাদের বিষয়ে বিস্তারিত জানতে না পরে। অনেকে পরবর্তীসময়ে লুকিয়ে পাকিস্তান, সৌদি আরব, ওমান, কাতার যে-যেখানে পারে আশ্রয় নিল; অনেকের রেহাই মিললেও অনেকে সেল্ফ কোয়ারেন্টিনের পথ বেছে নিয়েছিল। কেউ কেউ এখনো ওই অবস্থায় জীবন কাটাচ্ছে। তারা পারত পক্ষে ঘরের বাইর হয় না। লোকের সঙ্গে মেশে না। সামাজিক কর্মকা-ে যোগদান করে না। করলেও বেছে বেছে।’
শেষ চারটি বাক্যে চমকে ওঠে রাইসুল। শিরশির করে ওঠে তার শিরদাঁড়া। একটি অপ্রত্যাশিত ঝাঁকুনি খায় সে। মুক্তিযুদ্ধ ও পরবর্তীসময়ের প্রত্যক্ষদর্শী আপন চাচার কথাগুলোর সঙ্গে হুবহু মিলে যায় তার বাবার লাইফস্টাইল! বুঝ হওয়ার পর থেকে তার বাবা হামিদ মোল্লাকেও সে দেখেনি ঘর ছেড়ে খুব বের হতে। খুব কোথাও যেতে, কারো সঙ্গে মিশতে। জরুরি দরকার না হলে পারিবারিক, সামাজিক, আত্মীয়-স্বজন কারো বাড়িতে যেতে। জন্ম-মৃত্যু বিয়েতেও অনেক সময় না। অবিকল সঙ্গনিরোধের মতো ঘরেই তার সকল কর্ম।
এটি তার মনোজগতে অনেকবার প্রবেশ করেছে, কেন তার বাবা এমন! উপযুক্ত কারণ পায়নি। কিংবা গায়ে মাখায়নি। মায়ের কাছে জানতে চেয়েছে বিভিন্ন সময়ে, সদুত্তর দেয়নি তার মা উন্নয়নকর্মী নিলুফার ইয়াসমিন। মুহূর্তে একটা কিছুর গন্ধ এসে লাগে রাইসুলে চৈতন্যে। সে আরও জানতে চায়-‘আচ্ছা চাচা একটা পরিষ্কার কথা বলবে ?’
‘বল।’
‘তুমি দেশের জন্য নিঃস্বার্থ লড়াই করেছ, মুক্তির জন্য জীবনের মায়া ত্যাগ করে ঘর ছেড়েছ। বাবা অংশগ্রহণ করেনি কেন ? তোমরা তো মাত্র দুই-তিন বছরের ছোটো-বড়ো।’
সিরাজুল ইসলাম হালকা হোঁচট খেয়ে ওঠেন। রাইসুলের চোখে চোখ রাখতে দ্বিধান্বিত হন। বাবা সম্পর্কে ছেলের এ প্রশ্ন তার কাছে ভারি মনে হয়। মনে পড়ে য্দ্ধু থেকে ফিরে অনেকের কাছে শোনা তার ভাই সম্পর্কে অনেক কথা। মনে হয়, কেনই-বা এত বছর পর এমন প্রশ্ন! কুঁচকে যান তিনি। বয়স হলে মানুষ কিছুটা স্বার্থাপর হয় কি-না কে জানে। তিনি সতর্ক উত্তর দেন। রাইসুল প্রশ্ন করে নিঃসংকোচে-‘বাবাও কি রাজাকার ছিল ?’
তিনি কিছুক্ষণ চুপ করে থাকেন। এরপর খট করে বলেন, ‘আমি জানি না।’
সিরাজুল ইসলাম আপন ভাইয়ের মুখটি দেখতে পান আপন চোখের পর্দায়।
‘বাবাও তো সারাবছর সেল্ফ কোয়ারেন্টিনে থাকেন। কেন ? না হলে বাবাকে কারো সঙ্গে মিশতে দেখা যায় না কী কারণে ? মুক্তিযুদ্ধের সময় তুমি মুক্তিযুদ্ধে গেলে, বাবা কোথায় ছিল ?’ রাইসুলের অনেকগুলো জিজ্ঞাসা একসঙ্গে।
‘আমি তো যুদ্ধে ছিলাম। এ দিকের খবর জানব কী করে ?’
‘জানো না, নাকি বলবে না চাচা ?’
সিরাজুল ইসলাম কাচুমাচু করে। রাইসুলের চোখে পলকে ভেসে ওঠে লাগেজের লক ভেঙে রাস্তায় ছড়িয়ে পড়া ভাঁজ করা সেই ছোটো কাগজগুলোর ছবি, কাগজে সেই লেপটানো লেখাগুলো। তার সন্দেহ বাড়ে আরো একধাপ। মনে মনে একটা কিছু ভেবে চাচা সিরাজুল ইসলামের পরের কথার জন্য অপেক্ষা করে না। ফিরে আসে বাসায়। বসে মায়ের সঙ্গে। কোনো ভূমিকা না করে জানাতে চায়- ‘মা, আমাদের বাবা কি রাজাকার ছিল ?’
ছেলের এমন আগুন মুখ দেখে তিনি অবাক। হঠাৎ ছেলের বজ্রভাব আর এমন অপ্রত্যাশিত প্রশ্ন তীরের বেগে লাগে তার অপ্রস্তুত মস্তকে। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বুঝতে পারেন না, কী বলবেন। তিনি মৃদুস্বরে বলেন- ‘আমি জানি না।’
তারপর একই প্রশ্ন। তিনি একই উত্তর দেন- ‘আমি জানি না।’
দৃশ্যটা এমন দেখা যায় যে, অনভ্যস্ত চোর ধরা পড়লে বা স্পষ্ট সত্য স্বীকার ও অস্বীকারের দোলাচলে পড়লে মানুষ নিজেকে লুকোতে যেমন করে- অবিকল তেমন।
মা ও চাচার উত্তর দুটি মিলে যায় একপ্রান্তে। রাইসুলের সন্দেহ জোরালো হয়। তার মাথায় রক্তের বুঁদবুঁদ উঠতে থাকে, ‘বাবা রাজাকার!’
হনহন করে ঢোকে নিজের ঘরে। কাঁধব্যাগে কিছু ঢুকিয়ে হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে যায়। নিলুফার ইয়াসমিন ছেলের চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকেন একটা সমূহ অশনিসংকেতের ঝড়ো হাওয়া টের পেয়ে।
একসপ্তাহের জন্য রাইসুল বাড়ি থেকে উধাও। সপ্তাহ পর ফিরে আসে। আবার বের হয়ে যায় বাসা থেকে। দুই দিন পর ফেরে। তার অগ্নিমূর্তি। বাসাটা সুনসান; হয়ত যে যার কাজে বাইরে। একধাক্কায় চাপানো দরজাটার কপাট খোলে রাইসুল। সে দাঁড়ায় মাত্র জায়নামাজ থেকে উঠে দাঁড়ানো তার বাবা হামিদ মোল্লার সিনা বরাবর। তাকে দেখতে চিতাবাঘের মতো দেখায়। একটি প্রশ্ন ছুড়ে দেয় সে নির্মেদ- ‘বাবা, তুমি কি রাজাকার ছিলে মুক্তিযুদ্ধের সময় ?’
হামিদ মোল্লার বলিরেখা ধরা মুখটা বহু পায়ের তলে পড়া মরা কাঁঠালপাতার মতো আরও রেখাময় হয়ে ওঠে ক্ষণিকে। ক্ষণিকে চোখজোড়া হয়ে ওঠে মরা মাছের পিতের মতো। চোয়াল নড়বড়ে। ডুবন্ত সূর্যের সর্বশেষ ছায়ায় প্রান্তিক বিকালটা পটে আঁকলে কোনো চিত্রশিল্পী যে রং ব্যবহার করতেন, সে রঙের আঁচড় তার সমস্ত আপাদমস্তকে। হামিদ মোল্লা কিছু বলতে চায়, কথা থেমে যায় কণ্ঠনালীতে; যে প্রশ্ন এত বছর কেউ করেনি, করার সুযোগ পায়নি, সে প্রশ্ন নিজ সন্তানের মুখে! কী বলা উচিত ? কী জবাব দেবে ?
থরথর করে কাঁপতে থাকে তার ন্যুব্জ শরীরটা।
নির্বাক হামিদ মোল্লা।
উপনীত বয়সে এসে সন্তানের কাছে প্রকৃত সত্য স্বীকার করবে নাকি মিথ্যাটা উজিয়ে রাখবে আপন রক্তধারার কাছেও। কোটি কোটি হিবিজিবি আলোক-কণা তার চোখের সমনে ঝিঁঝির মতো ওড়ে, তিনি ভারসাম্যহীন।
রাইসুল ইটের ভাটা, রাইসুল কিলিমাঞ্জারো, রাইসুল ভিসুভিয়াস। সে আবার প্রশ্ন করে-‘সত্যি তুমি স্বাধীনতাবিরোধী, খুনি ছিলে বাবা ?’
ক্ষিপ্ত হতে গিয়েও ক্ষিপ্ত না হয়ে বিরামহীন বিস্ময়চিহ্নেঘেরা হামিদ মোল্লা। বলে ওঠে- ‘জানি না, জানি না এসব।’
তিনজনের তিনটি উত্তর এক অভিন্ন মৌলিক বিন্দুতে উত্তীর্ণ হলে রাইসুলের বিশ্বাস চূড়ান্ত রূপ পায়। চেতনায় যে রাজাকার-আলবদর-আলসামসকে সে চরম ঘৃণার দৃষ্টিতে দেখেছে বড়ো হতে হতে, সে রাজাকার-আলবদর-আলসামসেরই একজন তার বাবা! অবিশ্বাসের আর বাকি থাকে না, তবু বিশ্বাস হতে চায় না। রাইসুল হামিদ মোল্লার মুখের ওপর ছুড়ে মারে এক বান্ডিল কাগজ।
ছড়িয়ে পড়া কাগজে লেখার ভাষাটা উর্দু। সঙ্গে জুড়ে আছে বঙ্গানুবাদ। বাসা বদলের দিন পাওয়া সেই চিঠিসদৃশ কাগজগুলোকে বাবার তারুণ্যের প্রেমপত্র মনে করে কৌতূহলবশত কিছু কাগজ রাইসুল রেখে দিয়েছিল নিজের কাছে। সেগুলো সে গত দুদিনে অনুবাদ করিয়ে এনেছে। প্রতিটি চিঠির নিচে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন বিভিন্ন ক্যাম্পের পাকিস্তানি মেজরের নাম, দস্তখত। কোনোটির নিচে সিলমোহর। কোনোটিতে লেখা, কখন কোন গ্রাম জ্বালিয়ে দিতে হবে। কোনোটিতে লেখা, কখন কাকে ক্যাম্পে তুলে আনতে হবে, কোন রাতে কতজন তরুণী মেজরদের ফুর্তির জন্য প্রয়োজন। কোনোটিতে বর্বরতার নীলনকশা আঁকা। হাড় হিম হয়ে আসে। একই সঙ্গে একসপ্তাহে গ্রামের বাড়ি নিবিড়ভাবে চষে ওই অঞ্চলে বেঁচে থাকা মুক্তিযোদ্ধা ও প্রবীণদের কাছে রাইসুলের পাওয়া তথ্যের উপস্থাপনে হামির মোল্লার পথ থাকে না আর অস্বীকারের।
হামিদ মোল্লা একেবারে থ। রাইসুল তথ্য না-হয় পেল পৈত্রিক ভিটা-দেশে অনুসন্ধান করে, কোথায় পেল এ চিঠিগুলো! তবে কি গভীর ভুলেই চিঠিগুলো রয়ে গেছে এতযুগ?
রাইসুল একবার চিঠিগুলোর দিকে তাকায়। একবার তার জন্মদাতার দিকে তাকায়। চোখ যায় টেবিলে রাখা ছুরিটার দিকে। রাইসুল চোখের পর্দায় সিনেমার মতো দেখতে পায় চিঠির বর্ণনাগুলো, ইতিহাসের সেই বীভৎস ছবিগুলো। সে দেখতে পায় কুৎসিত একজন মানুষ লাশ আর রক্তগঙ্গার মাঝখানে দাঁড়িয়ে হাসছে দাঁত কেলিয়ে; সেই মানুষটা তার সামনে উপবিষ্ট। রাইসুলের মাথাটা তীব্রভাবে ঘোরে। তার বমি আসে নাড়িভুঁড়ি উল্টে। রাইসুল বমিটা আটকে রাখতে চায়। পারে না। বমিটা আলোর গতিতে গলার কাছে উঠে আসে। সে ওয়াক-ওয়াক করে তার বাবার ওপর উগ্রে দেয়। হামিদ মোল্লা ‘মাগো...’ বলে কাত হয়ে পড়ে পাশের আলমিরার উপর, তারপর থকথকে কাঁচা বমির ওপর।
রাইসুল আবার ‘ওয়াক থু’ করে একদলা থুতু নিক্ষেপ করে কাতরাতে থাকা দেহটায়।
পরক্ষণে নিজের প্রতিও ঘৃণা গুলিয়ে ওঠে সমান, ঘৃণাটা পাক খায়, আরো পাক খায়। একজন যুদ্ধাপরাধীর রক্ত তার শরীরে!
মানতে পারে না। মেনে নিতে পারে না সে। দ্বিগুণ বেগে আবার তার বমি আসে শূন্যপেট মোচড় দিয়ে...
শান্তিনগরের একটি বাড়ি। আজিজ ম্যানসন। ফ্লোরে পাশাপাশি পড়ে আছে দুটি শরীর। মাঝখানে হা হয়ে আছে টকটকে লাল একটা ছুরি, আর রক্তে ভেজা কতগুলো কাগজ। আগন্তুক প্রত্যেকেরই প্রশ্ন, ভরদুপুরে কে করল এই জোড়া খুন ?
পরের দিন প্রতিটি ইলেকট্রনিক মিডিয়া ও নিউজ পেপারে শিরোনাম হয়- ‘যুদ্ধাপরাধী পিতাকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করে মেধাবী কলেজছাত্রের আত্মহত্যা।’
অলঙ্করণ : স্ব. সরকার