ওভারকোট : মাহমুদা আখতার

18 Mar 2025, 02:22 PM গল্প শেয়ার:
ওভারকোট : মাহমুদা আখতার

২০২৪-২০২৫ খ্রিষ্টাব্দ।

 ধুর্ ! আর শীতই পড়ল না !  

কোটটা অযথাই বের করা হলো। এ মৌসুমে মাত্র একদিনই গায়ে চড়ানোর কোনোরকম সুযোগ হয়েছিল। তা-ও, না পরলেও চলতো বইকি। অভ্যাসের দাসে পরা আর কি !

গত বছর প্রবল শীতে ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে লোকজন তো বলতে শুরু করেছিল- বাংলাদেশে বরফ পড়া শুরু হলো বলে। কোটটাও বেশ আয়েশ করে ভদ্রমহিলার গায়ে চড়ে বেশ কিছু অনুষ্ঠানে ঘুরে বেড়াতে পেরেছে।

তার আগের বছর ডিসেম্বর-জানুয়ারিজুড়ে একাধিক বিয়ের অনুষ্ঠানে অনায়াসে যাওয়া গেছে তীব্র শীতকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ; কোটটা আছে বলেই না ! ভিন্ন ভিন্ন পরিবেশ আর লোকজন ভিন্ন ছিল বলে একই কোট পরে একই মৌসুমে একই ধরনের আয়োজনের অংশী হতে ভদ্রমহিলার কোনো মানসিক সমস্যাই হয়নি।

আর তার আগের বছর, ব্যবহার শেষে নিজেই উষ্ণ পানিতে জেট-পাউডার গুলে ধুতে গিয়ে আবিষ্কার করেছেন- ওমা, কোটের ভেতর বামপাশে চেইন আটকানো লম্বাটে একা গুপ্ত পকেটও আছে দেখছি ! আশ্চর্য! এতদিন এটা চোখে পড়েনি কেন ? কেমন মানুষ আমি ?

তারও আগের বছর ?

হ্যাঁ, কোট নিয়ে মূল গল্পের শুরুটা আসলে এখান থেকেই।

২০১৯-২০২০ খ্রিষ্টাব্দ

শী...ত!

জাঁকিয়ে বসেছে।

নাহ্ ! কালো ওভারকোটটা বের না করলেই চলছে না ঘুমন্তপুরী থেকে।

বেশ ক’বছর ধরেই কালো ওভারকোটটা ভদ্রমহিলার সুখসঙ্গী। মাঘের শীতে বিশেষ আয়োজনে কি প্রয়োজনে কোটটা গায়ে চড়ালেই আর দেখতে হয় না ; কাজ উদ্ধার হয়ে যায়। সবিশেষ খাতির-যতœ আর সপ্রশংসদৃষ্টির কথা তো বলাই বাহুল্য।

কী, বিশ্বাস হচ্ছে না ?

বলেই ফেলি তবে ঘটনাটা ; শুনেই দেখুন।

জানুয়ারি মাস ; প্রায় শেষ হতে চলেছে। ভদ্রমহিলার ভাতিজির নাম আছে ভর্তি-পরীক্ষায় উত্তীর্ণ অপেক্ষমাণদের তালিকার প্রথমেই। নির্দিষ্ট তারিখে নিয়ে যাওয়া হলো সরকারি একটি মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণিতে ভর্তি করাতে। জন্ম-নিবন্ধন সার্টিফিকেটে চোখ পড়তেই কর্তৃপক্ষ শুরু করলেন তালবাহানা।

-বয়স, দশ হয়নি তো !

-জ্বি।

-নেওয়া যাবে না।

-কেন ?

-নিয়ম নেই।

-মানে ? বুঝলাম না।

-১০ বছর পূর্ণ হলে ৫ম শ্রেণিতে ভর্তি হতে পারবে ; এটাই নিয়ম।

-ওই বছরের নভেম্বর মাসেই তো ১০ বছর পূর্ণ হয়ে যাবে।

-প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা দিতে পারবে না বয়স কম থাকলে।

-কী আর এমন কম- এ তো মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধান। ও তো ‘প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা’র আগেই দশ বছর পূর্ণ হয়ে ১১ বছরে পা দেবে।

-হ্যাঁ। তবে, ওর সহপাঠীরা ততদিনে ১১ পেরিয়ে যাবে।

-তাতে কী সমস্যা ? !

-আপনি বুঝতে চাইছেন না কেন ? নিয়ম বহির্ভূত কাজ আমরা করতে পারব না। সরেন। আমাদের কাজ করতে দেন। দেখি, পরের জন আসুন তো।...

চোখের জল আটকে মা-মেয়ে আর ভদ্রমহিলা বেরিয়ে আসেন। মনে মনে উপায় হাতড়ে বেড়ান। Cut your coat, according to your cloth নিয়মটি মেনেই ওঁরা সরকারি বিদ্যালয়ে মেয়েকে [ভাতিজিকে] ভর্তি করাতে নিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু এ কী অবিচার ! একবছর কম হওয়ায় ভর্তি করানো যাবে না এদিকে ১২/১৩ বছরের মেয়েরাও যে বয়স কমিয়ে ১০ বছর লিখে সমানে ভর্তি হচ্ছে ৫ম শ্রেণিতে ; সেখানে কোনো আইন নেই ? ঠিক আছে, যার যেমন যোগ্যতা, সে সেই অনুযায়ী পড়াশোনা চালিয়ে যাবে। ভদ্রমহিলা নিজে সরকারি স্কুলে পড়ে এসেছেন বলে জানা আছে, কত হালকা চাপ থাকে এসব স্কুলে। ভাতিজি পারবে ; ভতিজি অবশ্যই পারবে।


পরদিন কাগজপত্র নিয়ে ভদ্রমহিলা একাই যান।

-দেখুন, এটাই ওর প্রকৃত জন্মতারিখ আর জন্মসাল। ওর বিগত চার বছরের পরীক্ষার ফল দেখুন। ভালোভাবেই উত্তীর্ণ হয়েছে। যেভাবেই হোক, পাঁচ বছরে পড়তে না পড়তেই অনায়াসে পাঠ করতে শিখে গেছে বলেই, ওর আগের স্কুলের অধ্যক্ষ ওকে সরাসরি প্রথম শ্রেণিতে নিয়ে নিয়েছিলেন। আর একারণেই,

-এসব পাড়ার স্কুল নিজের ইচ্ছেমতন চলতে পারে ; আমরা পারি না। বললামই তো, ওকে নেওয়া যাবে না ; আপনি আবার আসছেন কেন ?

-ঠিক আছে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষার ফরম পূরণের সময় যদি বাধা আসে তাহলে ওকে পঞ্চম শ্রেণিতে দু’বছর না হয় রেখে দেব।

-আপনি বেশি কথা বলেন। আপনি বললেই হবে ? দেখি, জিজ্ঞাসা করে। কর্তৃপক্ষ রাজি হলে ওর মায়ের জবানীতে লিখিত দরখাস্ত নিয়ে আসেন দু’দিন পর। সিট থাকলে পুনর্বিবেচনা করব।

-জ্বি। মেয়েটা তো কোনো দোষ করেনি। ও তো পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে। একটু বিবেচনায় রাখবেন।

-থামেন তো ; থামেন। আপনি এখন যান এখান থেকে। বলেই ভদ্রমহিলার আগেই শ্রেণিশিক্ষক বেরিয়ে যান কক্ষ ছেড়ে।

স্কুল থেকে বেরিয়ে ভদ্রমহিলা সোজা চলে যান আজিমপুরে। সেখানে এক ভাগ্নে-বউ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। ওর কাছে গিয়ে সমস্যা খুলে বলে পরামর্শ চান। পঞ্চম শ্রেণির একসেট বইও নিয়ে আসেন চেয়ে ভাতিজিরি জন্য। অপেক্ষাকৃত স্থির ভাগ্নে-বউ ধীরেসুস্থে ভেবেচিন্তে উত্তর দেন- নিয়ম আছে, ঠিক আছে কিন্তু আমাদের স্কুল থেকে বয়সে ছোটো দুয়েকজন গত বছরই তো পরীক্ষ দিল। সমস্যা হয়নি তো ! আপনি এককাজ করেন, আমার নাম আর আমার স্কুলের নাম বলে আমার কথা উল্লেখ করে বলেন যে, আমি নিজে সাক্ষী আছি, আমার স্কুলের ছেলেরা পরীক্ষা দিয়েছে, কোনো সমস্যা হয়নি। তারপরও গাঁইগুঁই করলে ফোন করে আমাকে ধরিয়ে দেবেন।

অফিসে গিয়ে সহকর্মীদের ব্যাপারটা খুলে বলতেই একজন সহকর্মী স্বেচ্ছায় এগিয়ে আসেন। তিনি ফোন করে পরিচিত একজন শিক্ষা-কর্মকর্তাকে ধরিয়ে দেন। কর্মকর্তা গোড়া থেকেই উত্তপ্ত মেজাজে কথা বলতে থাকেন- আপনি নিয়ম ভাঙতে চাচ্ছেন কেন ? আইন যেটা আছে, সেটা মানতে অসুবিধা কোথায় ?

-জ্বি স্যার। কোনো অসুবিধা নেই। কিন্তু সুবর্ণ আইজ্যাক বারীকে তো সবাই চিনি ; তাই না ? কোথায় কী ঘটেছে, তা দিয়ে আমি কী করব ? আমার দেশের বিদ্যমান আইন যেটা জানি, সেটাই জানালাম। একবছর পরে ভর্তি করেন- কী সমস্যা ! হোক দশ বছর।

কর্মকর্তার ছ্যানছ্যানা আচরণে ভদ্রমহিলা আর কথা বাড়ান না। হঠাৎ আলোর ঝলকানির মতন তার এক বান্ধবীর কথা মনে পড়ে, যে যেচে সেধে মানুষের উপকার করে।

-কী রে, কেমন আছিস ?

-ভালোই রে। আসবি নাকি বাসায় ?

-সে আসা যাবেক্ষণ। এখন আমাকে উদ্ধার কর বলে, সবিস্তারে বয়ান করেন ভাতিজির ভর্তি সংক্রান্ত ব্যাপারে।

-ওই ব্যাপারে তো সরাসরি আমি কিছু করতে পারব না। শোন, আমার এক বন্ধু আছে শিক্ষা অফিসার, ওর ফোন নম্বর দিচ্ছি, রাখ। কথা বলে দেখ। ও খুব ভালো। ও একটা ফোন করলেই ভর্তি নিয়ে নেবে।

-দে। এক্ষুণি কথা বলছি।

মুঠোফোন নম্বর পেয়েইি বান্ধবীর সঙ্গে কথা সংক্ষিপ্ত করে শিক্ষা অফিসারকে ফোন করে, সালাম দিয়ে খুব বিনয়ের সঙ্গে আবেদন পেশ করে।

-জ্বি শুনলাম আপনার কথা কিন্তু মানতে পারলাম না।

-ঠিক বুঝলাম না। কারণ কী ?

-আপনি আইন ঠরড়ষবঃ করতে চাচ্ছেন কেন ?

-মোটেই তা নয়। কেউ যদি অল্পবয়সে পড়ার যোগ্যতা অর্জন করতে পারে, তাকে তো আমাদের উৎসাহিত করা উচিত ; তাই নয় কি ? আমার ভতিজি তো নয় বছর বয়সে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ার যোগ্যতা অর্জন করেছে বলেই আমরা ওকে ভর্তি করাতে চাচ্ছি। ও যদি ভর্তি পরীক্ষায় অনুত্তীর্ণ হতো, আমরা কোনো অন্যায় আবদার করে ওকে এখানে ভর্তি করাতে চাইতাম না। তাছাড়া আগে ও যে স্কুলে পড়ত, ওটা উচ্চবিদ্যালয় নয়।

-ও- আচ্ছা। বুঝলাম। কী করবেন ? আইন তো আইনই।

-কিছু মনে করবেন না, বিস্ময় বালক সুবর্ণ আইজ্যাক বারী মাত্র ছয় বছর বয়সেই পিএইচডি স্তরের গণিত, পদার্থ বিজ্ঞান আর রসায়নের সমস্যার সমাধান করতে পেরেছে বলে ২০১৪-এ হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞানী হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে।

-ব্যতিক্রম কখনো উদাহরণ হয় না।

-আপনারা সুযোগ দিলেই হতে পারে স্যার।

-আমার আরেকটা ফোন এসেছে, রাখি।

ভাঙা মনোরথে ভাবি-ননদ তৃতীয় আরেকজনের অফিসে যায় যদি তিনি কিছু করতে পারেন এই আশায়। তিনি নিজের ঢোল পুরোদমে পিটিয়ে অনুরোধ করেন তার দেবরকে ফোন করে বিষয়টি বলতে আর অনুরোধ করতে। দেবর থাকেন গ্রামে। তিনি এবিষয়ের নাড়ি-নক্ষত্র কিছুই জানেন না। কোনো যোগসূত্রও নেই। কী করা যায় তাহলে ? হাল তো ছাড়া যাবে না। বিনা দোষে দোষী ভাতিজির মুখটা অজানা আতঙ্কে ছোটো হয়ে আছে। ভাবি অধিক শোকে পাথর হয়ে আছেন।

‘আর কারও দ্বারে হাত পাতব না ; মুখও খরচ করব না ; অন্যায়-অযৌক্তিক কোনো দাবি তো করছি না! তাহলে কেন হেরে যাব ? আমি এর শেষ দেখে ছাড়ব। যা করার, আমাকেই করতে হবে’- মনে মনে নিজেকেই বলেন ভদ্রমহিলা।

ভাতিজির মায়ের ভাষ্যে একটি আবেদনপত্র লেখেন প্রথমে-

‘প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা দেওয়ার সময় যদি অধিদপ্তর থেকে কোনো নিষেধাজ্ঞা আসে, তাহলে আমার মেয়ে পঞ্চম শ্রেণিতে পরের বছরও পড়তে বাধ্য থাকবে।’

এর আগে গেছেন অফিসে, শ্রেণি-শিক্ষকের কাছে সালোয়ার-কামিজ-ওড়না পরে। এবারে তিনি ঋতুর রঙের সঙ্গে মিলিয়ে শাড়ি পরেন, খোঁপা বাঁধেন। তারপর শাড়ির ওপর কালো ওভারকোটটা চাপিয়ে, ক্রিমরঙা উলেন মাফলার দিয়ে কায়দা করে ঘাড়-মাথা ঢেকে, ফোটোসান চশমা চোখে লাগিয়ে দরখাস্ত নিয়ে বের হন।

স্কুলে পৌঁছেই সোজা প্রধান শিক্ষয়িত্রীর কক্ষে ঢুকে কায়দা করে আবেদনপত্রটি এগিয়ে দেন।

-বসুন-

ভদ্রমহিলা বসেন।

একেবারে বিনাবাক্যেই সমস্যার সমাধান হয়ে যায়।

-মেয়ে কোথায় ? বাইরে ?

-জ্বি-না বাসায়, আমি ওর ফুপু হই। ওদের আসতে বলব ? আজ আমি একাই এসেছি।

-ঠিক আছে একঘণ্টার মধ্যে যদি পৌঁছাতে পারে, তাহলে আজই আসুক। আমি সাইন করে দিচ্ছি। তা না হলে, কাল সকাল নয়টার মধ্যে এসে ভর্তি হয়ে যাক।

-জ্বি- আচ্ছা। অনেক-অনেক কৃতজ্ঞতা আর ধন্যবাদ জানাচ্ছি। আসসালামু আলাইকুম।- বলেই বেরিয়ে এসে রোদের হাসিতে যুক্ত হন।

রাস্তায় নেমে ভাবিকে ফোন করে দুশ্চিন্তামুক্ত করেন। তারপর একা একাই বিজয়ের হাসি নিজেকেই উপহার দেন। আবারও তিনজনের চোখের জল উপচে পড়ে ; তবে সেটা প্রাপ্তির আনন্দে।


অতিমারী কোরোনার কারণে সেবছর থেকে ‘প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা’ বাতিল ঘোষিত হয়।

কারও হয় সর্বনাশ ;

কারও জন্য পৌষমাস।

ভাতিজি এখন সেই স্কুলেই দশম শ্রেণিতে [বিজ্ঞান বিভাগে] পড়ছে। ভদ্রমহিলা তারপর থেকে কালো ওভারকোটটা পরে এখানে-সেখানে যাওয়া বাড়িয়ে দেন। কোনো অফিসে গেলেই খাতির-যতেœর ধুম পড়ে যায় !

-বসেন, বসেন- ম্যাডামকে চা..., না-না কফি দাও। তারপর বলুন, কী সেবা করতে পারি ?

সবাই ম্যাডামের ওভারকোটটার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হন। সমস্যার সমাধান হয়ে যায় দ্রুত। মেঘ না চাইতেই জল পেয়ে যাওয়ায় ভদ্রমহিলাও সুযোগ বুঝে সবাইকে জানান দেন- আমার ছোটো খালা দিয়েছেন, ইংল্যান্ড থেকে দেশে ফিরে সত্যি সত্যিই কোটটা উপহার দিয়েছিলেন তাকে।

***

ছোটো খালার চোখে পড়ে বছর চারেক পর।

-তুই এখনো পরিস এটা ! আমি তো সেই কবেই বাতিল করে তোকে দিয়ে দিয়েছি।

-বাতিল করে আমাকে দিয়েছেন মানে !

-হ্যাঁ...। জানিস, কোটটা লন্ডনে নিয়ে গিয়েছিলাম সস্তায় বঙ্গবাজার থেকে কিনে। হ

অলঙ্করণ : স্ব. সরকার