ইউরোপের ১৫০ দিন -সৈয়দা তাসলিমা আক্তার

09 May 2021, 01:21 PM ভ্রমন শেয়ার:
ইউরোপের ১৫০ দিন -সৈয়দা তাসলিমা আক্তার

ভ্রমণ পর্ব-২


[পূর্ব প্রকাশিতের পর]


শুরুতেই বলেছিলাম, প্রবাসজীবনের শুভসূচনার কথা, তাহলে আর এ জ¦রাব্যাধির গল্প কেন ? তাই তো জ¦রা-ব্যাধির গল্প আর কেন বলি, সে তো থাকবেই প্রবাসে অথবা স্ববাসে। আমি বরং বারগেন শহরের রূপমাধুর্যের কথা বলি। প্রথম দু-একদিনে বারগেনের আকাশ আমাদের যতটা না নিরাশ করেছে পরবর্তীসময়ে অবশ্য তা পুষিয়ে দিয়েছে বলা যায়। শোনা কথা, এবারের নরওয়ের আবহাওয়া নাকি গত পঞ্চাশ বছরের মধ্যে সবচেয়ে সুখকর ছিল। সাপ্তহে এক-দুদিন বাদে প্রায়ই আকাশে সূর্যের ঝলমলানি দেখা যেত। আর ইউরোপে রৌদ্রোজ্জ্বল দিন মানে ঈদের খুশি। আর আমার মতো ঘুরেবেড়ানো যার নেশা তার জন্য তো এটা ছিল পোয়াবারো। ফারজানার কথা আগেই বলেছিলাম, আমার কলিগ, আমরা দুজনেই বারগেনবাসীর মতো রৌদ্রোজ্জ্বল দিনগুলো উদ্যাপন করতে শুরু করলাম, অর্থাৎ একেকদিন একেক পথে বেরিয়ে পড়া। বাস, ট্রেন আর বোট একই টিকেটে ভ্রমণ করা যায় আর মান্থলি টিকেট থাকায় নির্দিষ্ট মেয়াদে যতবার যতখুশি ভ্রমণ করা যায়, এ যেন এক স্বাধীনতার টিকেট, আমার অন্তত তাই মনে হলো। তবে বিপত্তি যে একেবারে ছিল না, তাও নয়- এবং তার মূলে ছিল ভাষাগত বাধা। পাবলিক ট্রান্সপোর্টসহ প্রতিটি পণ্যের প্যাকেজে নরোজিয়ান ভাষা ব্যবহার করা হয় ; যে-কারণে প্রায়শই আমরা বিপত্তিতে পড়ছি। সমাধান হিসেবে পেলাম তানিয়াকে। তানিয়া সপ্তাহে প্রতিদিনই ব্যস্ত সময় কাটায় তার কর্মক্ষেত্রে আর আমরা তাকে আরো ব্যস্ত করে  ফেললাম। তার ছুটির দিনগুলোতে সে আমাদের পথঘাট চেনাচ্ছে, নিয়ে যাচ্ছে সুপারস্গুলোতে বুঝিয়ে দিচ্ছে কোন ধরনের পণ্য কোন কর্নারে থাকে ইত্যাদি ইত্যাদি।

তানিয়ার কল্যাণে প্রথম ফ্লোয়েন-এ ওঠার গল্পটা না বললেই নয়। বারগেন শহরে ছোটো-বড়ো মিলিয়ে মোট সাতটি পাহাড় রয়েছে। যদিও নেপালিদের চোখে এগুলো পাহাড় তো নয়ই টিলাও বলা যায় কি না সন্দেহ। নেপালিদের কথা ওঠায় মনে পড়লো আমাদের সাত সহযাত্রীর মধ্যে দুজন নেপালী আর একজন সিংহলিও ছিলেন। পাহাড় বা টিলা যা-ই বলি না কেন, এই সাতকন্যাকে নিয়ে বারগেনবাসীর আদিখ্যেতার কিন্তু অন্ত নেই। সপ্তাহান্তে তরুণ-যুবা সব বেরিয়ে পড়ে পাহাড় আরোহণে। সেই সাতকন্যার সম্ভবত সর্বকনিষ্ঠজন হচ্ছে ফ্লোয়েন। 

ফ্লোয়েনে দু’ভাবে ওঠা যায়- এক চিরন্তনী উপায় পায়ে হেঁটে , আন্য উপায়টি হচ্ছে সর্বাধুনিক ম্যাগনেটিক ট্রেনে চেপে। আমরা তৃতীয় বিশ্বের আরামপ্রিয় মানুষ দ্বিতীয় উপায়টিই আমাদের মনে ধরলো। না, শুধু আরামপ্রিয় বলে না নতুন একটি বাহনের সাথে পরিচিত হবো এই উচ্ছ¡াসটাও কাজ করছিল। মাঝারি আকারের একটি কিউ পাড়ি দিয়ে আমরা টিকেট সংগ্রহ করতে সক্ষম হলাম, অবশ্য ট্রেনের জন্য খুব একটা বেশি সময় অপেক্ষা করতে হলো না। আর ট্রেনে চড়ার পর যেন নিমেষেই পৌঁছে গেলাম ফ্লোয়েনের চ‚ড়ায়।  মাটি থেকে ৩২০ মিটার উচ্চতার ফ্লোয়েন পর্যটকদের  জন্য নানান আয়োজনের পশরা নিয়ে যেন সেজেগুজে বসে আছে। ফ্লোয়েনের উপরটা কিন্তু একই রকম সমতল নয়, বিভিন্ন চড়াই-উৎরাইয়ের মেলবন্ধন ঘটেছে এখানে। কখনো সরু রাস্তা অথবা বিভিন্ন ধরনের সিঁড়ির ধাপ কোথাও পাথুরে, কোথাও কাঠ আবার কাঁচ দিয়ে তৈরি সিঁড়িগুলো ফ্লোয়েনকে করে তুলেছে আকর্ষণীয় ও নান্দনিক। আমরা যেন সিঁড়ির এই রূপে মুগ্ধ হয়ে গেলাম কখনো এই ধাপে কখনো-বা অন্য কোণটায় বসছি আর মনের আনন্দে ছবি তুলে চলেছি। ফ্লোয়েনের উপর থেকে বারগেন শহরের একাংশ দেখা যায় বিশেষ করে বিশ^বিদ্যালয় এলাকা এবং সমুদ্রের অনেকটা। পাখির চোখে শহর দেখার এই অভিজ্ঞতা বেশ উপভোগ্য ছিল। 

আগেই বলছিলাম, বারগেনের এ সময়কার দিনগুলো বেশ বড়ো। সূর্য যেন ধরণী থেকে বিদায় নিতেই চায় না আর লম্বা দিনের সুবিধাটুকু নিতেও আমরা ভুল করিনি। একেকটি দিনে আমাদের পরিকল্পনাও নেহাত কম থাকে না সকালে অথবা দুপুরে বেরিয়ে পড়ছি দিনের বাকিটা হাতে নিয়ে। এমনি এক দিনে ঘুরে এলাম কিং হাউজ আর কুইন হাউজ। না এরা খুব বিখ্যাত কেউ না, তবে এদের প্যালেসগুলো প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শন ; বিশেষ করে নেপলিয়নের সমসাময়িক শৈল্পিক নিদর্শনগুলো বেশ সাড়ম্বরেই ধরে রেখেছে। ইউরোপজুড়ে এধরনের প্যালেস অসংখ্য। আগেই বলেছি, বারগেনবাসীর সৌন্দর্যবোধের কথা, প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শনগুলোর প্রতি তাদের যত্ন এবং মমত্ববোধ চোখে পড়ার মতো। শুধু বারগেন না ইউরোপের প্রায় প্রতিটি শহরই তাদের প্রাচীন রূপ খুব যত্ন করে সাজিয়ে রেখেছে। অনেকটা জীবন্ত জাদুঘরের মতো যে কেউ সেখানে গেলে মনে হতেই পারে টাইম মেশিনে চেপে ফিরে গেলাম কয়েকশত বছর পেছনে। বলছিলাম কোনো এক কিং হাউজের কথা অনেকটা আমাদের দেশের খ্যাত-অখ্যাত জমিদার বাড়ির মতো। এর কতক বেশ উন্মুক্ত যে কেউ চাইলেই ঘুরে আসতে পারে আর কিছু সংরক্ষিত বেশ নিয়মকানুন মেনে পূর্বানুমতি নিয়ে যেতে হয় আবার কিছু আছে পর্যটকদের জন্য উন্মুক্ত কিন্তু নির্ধারিত টিকেটের বিনিময়ে তাতে ঢোকার অনুমতি মেলে। আমরা সমুদ্রের ধার ঘেঁষে চুপটি করে থাকা এমনি এক কিং হাউজে গেলাম, যার কিছু অংশ সরকারি দপ্তর হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে কিন্তু পর্যটকদের প্রবেশে কোনো বিধি-নিষেধ নেই, নেই কোনো টিকেটের ব্যবস্থাও। নিজ দায়িত্বে পরিবেশের কোনোরকম ক্ষতি না করে নিবিঘ্নে ঘুরে আসা যায়। বিকেলের নরম সোনালি আলো, সাথে উত্তর সাগরের আছড়ে পড়া ঢেউয়ের একটানা মৃদঙ্গ বেশ মায়াময় একটি পরিবেশ, এমনি সময়ে আমরা যেন রূপকথার ঘুমন্ত প্রাসাদপুরির হঠাৎ অতিথি। যেখানে সকলে অপেক্ষায় রাজপুত্রের জাদুর কাঠির ছোঁয়ার। প্রাসাদের ভেতরটা সংরক্ষিত- এর আঙ্গিনা, ছাদ, বাগান আমন্ত্রণ জানায় অতিথিদের। প্রাসাদের আঙ্গিনা ঘেঁষে ম্যাপল আর আপেল গাছের সারি। তখনো ম্যাপল পাতা পুরোপুরি সোনালি হয়ে ওঠেনি কিন্তু আধপাকা আপেলগুলো হাতছানি দিচ্ছে আমাদের। না, এই হাতছানি উপেক্ষা করতেই হলো। কেননা পরিবেশের কোনো ক্ষতি না করে বেড়ানোর অনুমতি রয়েছে আর আপেল খাওয়ার লোভ সংবরণ করতে না পারলে যে কথার খেলাপ হবে। প্রাচীন এই  প্রাসাদের  আনাচে কানাচে  ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে নিজেকে যেন হারানো রাজ্যের একজন মনে হচ্ছিল, যেন বর্তমান থেকে বহু পেছনে। জীবনানন্দের কবিতার মতো “মনে হয় কোনো বিলুপ্ত নগরীর কথা / সেই নগরীর ধূসর প্রসাদের রূপ জাগে হৃদয়ে / ভারত সমুদ্রের তীরে / কিংবা ভূমধ্যসাগরের কিনারে / অথবা টায়ার সিন্ধুর পারে / আজ নেই, কোনো এক নগরী ছিল একদিন, / কোনো এক প্রাসাদ ছিল / মূল্যবান আসবাবে ভরা এক প্রাসাদ।” প্রাসাদ আজো আছে তবে তা যেন প্রাণহীন, নেই সেই উজ্জল ঝাঁড়বাতি,পারস্য গালিচা, ময়ূরের পেখমের মতো রঙ্গীন পর্দা অথবা রামধনু রঙের কাচের জনালা। বিকেল গড়িয়ে বেলা বয়ে যায়, আকাশ তার সোনালি আবরণ আর পাল্টায় না- বোধ করি, সোনা রং তার খুব পছন্দ। সমুদ্রের এ ধারটায় ছোটোখাটো একটি জেটি রয়েছে, বেশ কিছু নৌযান এখানে নোঙ্গর ফেলে জিরিয়ে নিচ্ছে, আমরাও জিরোচ্ছি সমুদ্র পাড়ে  বসে আমরা জলরঙ্গে সূর্যের আলোর খেলা দেখে কাটিয়ে দিলাম পুরো বিকেলটা- লম্বা এক বিকেল। এবার আকাশ বোধকরি একটু লজ্জা পেল, তার সোনার বরনের প্রতি বাড়াবাড়ি রকমের প্রীতি নিয়ে তাই রাঙা হলো আর আমরাও পড়ন্ত বিকেলকে ছুটি দিয়ে সন্ধ্যাকে সাথি করে ফিরতি পথ ধরালাম।  [চলবে]