ইউরোপের ১৫০ দিন -সৈয়দা তাসলিমা আক্তার

11 May 2021, 05:42 PM ভ্রমন শেয়ার:
ইউরোপের ১৫০ দিন -সৈয়দা তাসলিমা আক্তার

ভ্রমণ পর্ব-৪

[পূর্ব প্রকাশিতের পর]

নরওয়ে এসিছি মাত্র দিন সতের পার হয়েছে, তবু আমার মনে হচ্ছে, এ যেন অনন্তকাল ধরে পরবাসে বসবাস। এরই মধ্যে কাটাঘায়ে নুনের ছিটার মতো ঈদ এসে উপস্থিত। নিশ্চয়ই ভাবছেন ঈদের মতো প্রতীক্ষিত আনন্দময় এমন একটি ঘটনাকে এভাবে ব্যাখ্যা করছি কেন ? আগেই বলেছি, আমি গৃহকাতর মানুষ, যদিও নিজের খেয়ালে এখানে সেখানে ঘুরে বেড়াতে পছন্দ করি। যেখানে যতটা সময় ভালো লাগে সেখানে ততটা সময়ই কাটাতে ভালোবাসি, বাঁধাধরা সময় কোথাও থাকার বাধ্যবাধকতা এলে নিজেকে বন্দি বন্দি লাগে। এই যেমন বারগেনে এসেছি, পাঁচ মাসের জন্য সময়টা এখানে বেঁধে দেওয়া তাই অনুভূতিটা কী বুঝতেই পারছেন। আসল কথায় আসি। ঈদের আনন্দ আমার কাছে কখনো একান্ত ব্যক্তিগত কোনো বিষয় ছিল না, সবসময় এটা আমাদের কাছে সম্মিলিত আনন্দ উদ্যাপনের উপলক্ষ ছিল। আর যে-আমি ঈদে নিজের বাড়ি ছেড়ে কখনো অন্য কোথাও অবস্থান করিনি সেখানে দেশ মহাদেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে এসেছি। এই প্রথমবার প্রবাসে ঈদ যেন একাকী এলো, সকলে মিলে আনন্দ ভাগাভাগি করে ঈদ উদ্যাপনের সুযোগ এখানে নেই বললেই চলে। তবে ঈদের মতো এত বড়ো একটি উৎসব একেবারে চুপিসারে এসে চলে যাবে তাই কি হয় ! জানলাম এখানেও ঈদের জামাত হয় এবং তা নারী-পুরুষ সকলের জন্য। যেহেতু নিজবাসে কোনো আয়োজন নেই তাই জামাতে যাওয়ার এই সুযোগ আর মিস করলাম না। সকাল সকাল আমি আর ফরজানা মিলে রওনা দিলাম। আমাদের হোস্টেল থেকে মাত্র দুইটা স্টেশন পরেই এ জামাতের আয়োজন। মূলত একটি ইন্ডোর স্পোর্টস গ্রাউন্ডে এই আয়োজন ছিল। বিমান থেকে নেমে একটু ভাবনায় ছিলাম জায়গাটা খুঁজে পাবো তো, কিন্তু একটু এগোতেই মনটা ভালো হয়ে গেল। পথ নির্দেশিকা তো ছিলই, সেইসাথে ছিল স্বেচ্ছাসেবকদের আন্তরিক সেবা, পথ চিনতে ভুল করার সুযোগই নেই। আমার কাছে এটা একটা নতুন অভিজ্ঞতা। এর আগে আমার কখনো ঈদের জামাতে অংশ নেওয়া হয়নি। আর প্রবাসে ঈদ বলতে এইটুকুই ছিল আমাদের সান্তনা, পরে অবশ্য দুই প্রবাসী পরিবার আমাদের নিমন্ত্রণ করে খাইয়েছে। ফারজানা আর বেনিয়ামিন ভাই, আকরাম ভাই আর ভাবি এদের আতিথিয়তার গল্প করতে গেলে কুলোতে পারব না। তাবে, ফারজানার কথা একটু না বললেই নয়, এ কিন্তু আমার কলিগ ফারজানা নয়, ফারজানার সাথে আমার সখ্য এমনভাবে গড়ে উঠল একসময় সে আমার এক নির্ভরতার মানুষ হয়ে উঠল।

এরই মধ্যে আমাদের একাডেমিক কার্যক্রম শুরু হয়ে যায়। সপ্তাহে তিন দিন ক্লাস, তবে বারগেন বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মকানুন বেশ মজার। যেমন ক্লাস করার ব্যাপারে তাদের কোনো বাধ্যবাধকতা নেই, নেই কোনো হাজিরার ব্যবস্থা। যার ইচ্ছে ক্লাস করবে, ইচ্ছে না হলে করবে না, তবে অ্যাসাইনমেন্ট বা পরীক্ষার সিডিউলের ব্যাপারে তারা খুব কঠিন। সেমিস্টারের শুরতেই তা নির্ধারিত থাকে এবং যাই ঘটুক না কেন, এর কোনো পরিবর্তন হবে না, এ যেন হাকিম নড়ে তো হুকুম নড়ে না অবস্থা। ক্লাস শুরু হওয়ার পর আমাদের ফুরফুরে মুডটা একটু থমকালো, অবশ্য মন্দের ভালো হিসেবে বাড়ির জন্য হাহাকার করার সময়টা কমে গেল। মানে দাঁড়ালো একটু একটু করে নতুন পরিবেশ আর প্রকৃতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারছি। ক্লাসের দিনগুলো যে খুব ব্যস্ততায় কাটছে তা কিন্তু নয়। মাত্র ঘণ্টাদেড়েকের ক্লাস তারপর অধিকাংশ দিনই নিরবচ্ছিন্ন অবসর। তাই মাঝেমাঝেই ক্লাস শেষ করে আমরা বেরিয়ে পড়ছি এখানে সেখানে। এমনি একদিন ক্লাস শেষ করে বেরিয়ে পড়লাম সৈকত দেখব বলে। বারগেন শহরটি পুরোটাই সমুদ্রের কোলে বলে এখানে খাড়ির দেখা যেখানে সেখানে মিললেও বালুকাবেলার দেখা পাওয়া ভার। তাই যখন ফারজানা জানাল এখানে একটি সৈকত আছে, যদিও আমাদের কাছে তা ঠিক সৈকত বলে মনে নাও হতে পারে- তবু, শোনার পর থেকে বেশ কৌত‚হল হচ্ছে। অগত্যা কৌত‚হল মেটানোর তাগিদেই বেরিয়ে পড়া। পথ চেনা নেই, ফারজানার কাছ থেকে শুনে নিয়ে নির্দিষ্ট নাম্বারের বাসে উঠে পড়লাম। না সে যাচ্ছে না, নাসরিন আর বশির এরাও আমার সতীর্থ। ফারজানার বলে দেওয়া স্টপে বাস থেকে নেমে হাঁটতে শুরু করলাম, জায়গাটা সম্ভবত নস্টেটের কাছাকাছি, এখানে একটা কথা বলে রাখি, নরওয়েজিয়ানদের উচ্চারণ খুব ফাস্ট আর সেখনে ইংরেজির প্রচলন খুব কম তাই স্টেশনটির নাম কিছুটা হেরফের হতেই পারে। একটা ছোটোমতো গেট যা দিয়ে ভেতরে ঢুকেই চোখে পড়লো গোলাকৃতির একটি স্বচ্ছ পানির লেক। বারগেনের লেকের পানির স্বচ্ছতার কথা আর নাই বলি, বলতে গেলে নিজেদের লেকের ছবি চোখে ভাসে আর মনটা খারাপ হয়ে যায়। লেকটির একধারে বেশ কিছু দোলনা রয়েছে, দোলনা দেখলেই একটু দোল খেতে ইচ্ছে হয়। তাই ইচ্ছে পূরণে কিছুটা সময় খরচ করলাম। লেকটিতে মূলত আয়েসি লোকজন সুইমিং করতে আসে। এখন ভর দুপুর তাই লোকজনের আনাগোনা নেই। এই লেকটাকে কেন্দ্র করে দু’দিকে পথ চলে গেছে। শুরু হলো কনফিউশন, কেন যেন বাঁ দিকের পথটাকে মনে ধরলো না, তাই ডান দিকেই চললাম। বেশ কিছুটা পথ এগিয়ে গিয়ে মনে হলো ভুল পথে এলাম। নেটওয়ার্ক-জনিত সমস্যায় ফারজানাকেও ফোনে পাচ্ছি না। ফিরে যাব না এগোবো এই নিয়ে দোদুল্যমান না থেকে এগিয়ে যাওয়াটাই যৌক্তিক মনে হলো।

আগেই বলেছি, বারগেন একটি পাহাড়ি শহর তাই এখনে টানা সমতল পথ পাওয়া শুধু দুষ্করই নয় প্রায় অসম্ভব। এখনে ঠিক তাই পথ আবার বন্ধুর হতে শুরু করেছে। যতই এগুচ্ছি পথ চলার ক্লান্তিও বাড়ছে, তবে পথের ধারের নামহারা ফুলের রূপ অবশ্য ক্লান্তি নাশে ভ‚মিকা রাখছে। সেইসঙ্গে কানে এলো অতিপ্রিয় একটি শব্দ, জলের একটানা বয়ে চলা মৃদু কিন্তু ছান্দিক শব্দ। তার মানে আশেপাশে যেন কোনো জল বালিকার বাস, মুহূর্তেই মনটা খুশি হয়ে গেল।

ঝরনার গল্পে আমার আবেগ বরাবরই সীমাহীন। তবে, এখানে একটু চলতি পথের গল্প বলি। ইতোমধ্যে পথের চড়াই-উতরাই এর কথা তো জানিয়েছি, তবে পথের দু’ধারের রূপগল্প পথটাকে ততটা কষ্টদায়ক করে তুলতে পারেনি। বেশ খানিকটা চলার পর আমরা একটা পাটাতনের মতো জায়গায় এসে পৌছুলাম । জায়গাটা সমতল, যেখানে আমাদের মতো পথ চলতি ক্লান্ত পথিকের বিশ্রামের সকল আয়াজন সাজানো, কাঠের পাটাতন আর টেবিল পাতা। ব্যাপারটা যতটা চমকপ্রদ তারচেয়ে গভীর এক চেতনার যে একটা দেশ কতটা জনবান্ধব আর দূরদর্শী এরকম করে ভাবতে পারে। অবশ্য জনগণও তাই এই মহৎ উদ্দেশের প্রতি তাদের দায়িত্ববোধ ও ভলোবাসা চোখে পড়ার মতো। এলাকাটা নির্জন হলেও বিজন নয়, বোঝা যায় সপ্তাহান্তে ক্যাম্পপ্রেমী মানুষের আনাগোনা এখানে নেহায়েত কম নয়। তবে দায়িত্ববোধ ও ভালোবাসার সম্মিলিত প্রয়াস যেখানে সেখানে স্বচ্ছতা তো থাকবেই, সে মননের দিক থেকে হোক অথবা পরিবেশের দিক থেকে, পুরো চরাচরজুড়ে আবর্জনার লেশমাত্রও নেই। নিজের অজান্তে আমাদের নিজেদের অবিবেচক আচরণের কথা মনে পড়ে, এ যদি আমার দেশে বনভোজনের শেষে আমরা প্রকৃতিকে একরাশ আবর্জনা উপহার দিয়ে ঘরে ফিরি। ফিরে আসি আগের কথায় ; বলছিলাম কাঠের পাটাতন আর টেবিলের গল্প, সত্যিই খুব দৃৃষ্টিনন্দন। হাঁটাহাঁটিতে একটু ক্লান্তি তো ছিলই বসার এরকম মনোরম আয়োজন দেখে পা আর এগোতেই চাচ্ছে না, এ যেন ঘোড়া দেখে খোঁড়া অবস্থা। তাই পায়ের সঙ্গে আর জোরাজুরি না করে বিশ্রামের সিদ্ধান্তই সাব্যস্ত হলো। এখানে বসতেই মনে হলো এককাপ চা পেলে মন্দ হতো না। আসলে বারগেনের এই এক দোষ, মাইলের পর মাইল হেঁটে গেলেও এককাপ চায়ের সন্ধান মেলে না, সে শহরই হোক অথবা শরের বাইরে। তবু মন্দের ভালো, সঙ্গে কিছু শুকনো খাবার ছিল, তাই তখনকার মতো রসনার তৃপ্তি মিটল, সঙ্গে বাড়তি পাওনা ছিল ঝরনার মৃদু গুঞ্জরণ। বোঝা যাচ্ছিল, ধারেকাছেই তার অবস্থান। যেহেতু আমাদের সময় নিয়ে খুব এটা তাড়াহুড়ো নেই, তাই আস্তে-ধীরেই এগুলাম। কিছুটা এগুতেই জল বালিকাকে দেখতে পেলাম, যেহেতু গেল কয়েকদিন বৃষ্টির আনাগোনা কম তাই ঝরনার চঞ্চলতাও কিছুটা স্থিমিত। তবে এর অবয়ব এটা জানিয়ে দিচ্ছে মেঘমল্লার ডাকে এ কতটা পাল্লা দিতে পারে। তবে এর বর্তমান চিত্রের গভীরতাও নেহায়েত কম নয়, ব্যস্ত সময়কে থমকে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট, থমকালাম আমরাও.. ঘড়ির দিকে চোখ পড়তেই সময়ের চোখ রাঙানিকে আর উপেক্ষা করা গেল না, ফেরার পথে পা বাড়াতেই হলো। [চলবে]

ছবি : লেখক