ইউরোপের ১৫০ দিন -সৈয়দা তাসলিমা আক্তার

11 May 2021, 05:48 PM ভ্রমন শেয়ার:
ইউরোপের ১৫০ দিন -সৈয়দা তাসলিমা আক্তার

ভ্রমণ প র্ব-৫

[পূর্ব প্রকাশিতের পর]

বারগেন এসে কেউ ফ্লম যাবেন না, তাই কি হয় ! বিশেষ করে যারা প্রকৃতির প্রেমে মগ্ন আর সৌন্দর্যের পূজারি। আমি নিজে প্রকৃতির সান্নিধ্য খুব উপভোগ করি, আমার শহুরে আবাসেও আমি প্রকৃতিকে খুব করে কাছে পাওয়ার আন্তরিক চেষ্টায় রয়েছি, সে অবশ্য ভিন্ন গল্প ; আসি ফ্লমের গল্পে। ফারজানার পরিবার আর আমি মোট চারজনের ছোটো দলটি সেপ্টেম্বরের এক ভোরে ফ্লমের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লাম। বারগেন শহর থেকে বাসে ঘণ্টা তিনেকের পথ অবশ্য বাহনভেদে সময়ের হেরফের হয়ে থাকে। সড়ক, রেল এবং জলপথ তিন উপায়েই ফ্লম যাওয়া যায়। আমরা যাওয়া আসায় দুটি ভিন্ন বাহন বেছে নিয়েছিলাম বাস এবং রেল। ইউরোপে রেলযাত্রা বেশ রোমান্টিক, আরামদায়ক এবং ব্যয়বহুলও বটে, পানিপথের যাত্রার ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য, তবে সড়ক পথে যাত্রা কিছুটা সাশ্রয়ী। নির্ধারিত দিনে সকাল সাড়ে ছটায় আমরা রেল স্টেশনে পৌঁছে গেলাম, সাতটা নাগাদ আমাদের যাত্রা শুরু। ইউরোপের রেল নিয়ে আগেই অনেক গল্প শোনা হয়ে গেছে, ক্ষেত্র বিশেষে প্লেন থেকেও রেলের ভাড়া বেশি। বেশ আরামদায়ক এবং উপভোগ্য। প্রথম রেলে চড়ে এর আঁচ নেহাত কম পেলাম না। আমরা যে কামরাটার সওয়ারী হলাম তাতে আমরাসহ জনা আট যাত্রী ছিল। ছিল না নির্দিষ্ট কোনো আসনে বসার বাধ্যবাধকতা। আমরা বেশ গুছিয়ে একটা কেবিন মতো জায়গায় আমাদের আসন বেছে নিলাম যার সকল সিটই ফাঁকা। ইচ্ছেমতো ধার পরিবর্তন করার সুযোগ রয়েছে, আমরা কখনো ডানে কখনো বাঁয়ে স্থান পরিবর্তন করছিলাম যাত্রাপথের দু’ধারের বিপুল আয়োজন উপলব্ধি করার জন্য। নরওয়েকে যেন প্রকৃতি তার সবটা দিয়ে সাজিয়ে তুলেছে। আমাদের সমতলের মানুষের কাছে পাহাড় আর পাহাড়ি ঝরনা এক বিশেষ কাক্সিক্ষত, দর্শনীয় আর উপভোগ্য ; প্রাকৃতিক দৃশ্য অনেকটা রূপকথা বা উপন্যাসে পড়া ফল্গুধারা, যার পরশ পেতে আমরা বহুদূর পর্যন্ত যেতে রাজি আছি আর এখানে এসে মনে হলো ঝরনা যেন যেচে পড়ে বন্ধুত্ব করতে উদগ্রীব। এমনটা মনে হওয়ার কারণ আছে বৈ কি, আমরা আমাদের যাত্রাপথে যে কত অসংখ্য ঝরনাকে বয়ে যেতে দেখলাম তার কোনো ইয়ত্তা নেই। সেইসঙ্গে পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে বয়ে চলা জলাধার, না এগুলো নদী তো নয়ই বরং বলা যায় বড়ো বা মাঝারি আকারের লেক, হয়ত পাহাড়ের গভীর খাদ বা উপত্যকগুলো কালের বিবর্তনে এই রূপ ধারণ করেছে। 

ইউরোপীয়ানরা ব্যবসা খুব ভালো বোঝে অন্যান্য ক্ষেত্রের মতো পর্যটন তাদের আয়ের একটি বড়ো উৎস। অশ্যই প্রকৃতির অপার দান পর্যটকদের আকর্ষণ করার পশরা সাজিয়ে রেখেছে কিন্তু সেইসঙ্গে রয়েছে এ শিল্প সংশ্লিষ্টদের ব্যতিক্রমী ভাবনা ও যত্ন। কেন বললাম, এতক্ষণ তো শুধু দু’চোখ ভরে প্রকৃতিকেই দেখছিলাম আরো আয়োজন যে ছিল তা হঠাৎ-ই জানলাম। বারগেন থেকে যে ট্রেনে চড়ে আমরা যাত্রা শুরু করেছিলাম মধ্য পথে আমাদের সে ট্রেন বদল করতে হলো। প্রথমে একটু বিরক্তই হয়েছিলাম বোধকরি, মাঝপথে কেন এই ঝক্কি। পরের ট্রেনটি বেশ পুরোনো, একটু অবাকই হলাম। নরওয়ের জীবন-যাত্রার সঙ্গে যেন বেমানান, যেন হঠাৎ করেই আমরা একশত বছর পেছন ফিরে গেলাম, পুরোনো ইংলিশ মুভিতে যে ধরনের ট্রেন দেখা যায় ঠিক তেমন। আরেকটি লক্ষণীয় বিষয় ছিল যে, এ ট্রেনে ওঠার পর যাত্রীদের আচরণ যেন আমূল পাল্টে গেল, যে নরওয়েবাসী সাত চড়ে রা করে না তারা সব গলা ছেড়ে গান গাইতে শুরু করল। আমরা ক’জন ভিনদেশি অনেক বিস্ময় নিয়ে তাদের দেখছি আর ভাবছি, হলোটা কী ? আসলেই ট্রেনটি প্রায় দেড়শ’ বছরের পুরোনো, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধেরও আগের, সম্ভবত এ অঞ্চলে চলাচলকারী প্রথম ট্রেন যা কি না বাষ্পীয় এঞ্জিনে চলত, এখন অবশ্য এঞ্জিন বদলেছে কিন্তু আদলের কোনো পরিবর্তন হয়নি। ট্রেন চলতে শুরু করল, সময় যেন এ ট্রেনের যাত্রী হয়ে উল্টো পথে বয়ে চলছে সঙ্গে আমরা, প্রকৃতির পাশাপাশি ট্রেনের যাত্রীদের কোলাহল, ভিনদেশি গান, উচ্ছ্বাস সবই উপভোগ করছি। ভাবছেন, বুঝি এ আর এমন কী, না যারা নরোজিয়ানদের স্বভাব সম্পর্কে খুব একটা ওয়াকিবহাল না, তারা এমন ভাবতেই পারেন। সে যাক, বিস্ময়ের এ ঘোর কাটতে না কাটতেই ট্রেন আবার থামল আর অভ্যস্ত যাত্রীরা সব হুড়মুড় করে ট্রেন থেকে নেমে পড়ল, আমরা আর বসে রই কেন, নেমে পড়লাম, অবশ্য ইতোমধ্যে টের পেয়ে গেলাম এই তাড়াহুড়ার কারণ, কেননা পাহাড়ি ঝরনার চঞ্চল ছুটে চলার শব্দ আমাদের কান এড়ায়নি, সঙ্গে ইউরোপীয়ান সঙ্গীতের মূর্ছনা একাকার হয়ে পরিবেশটাকে ময়াময় রূপে সাজিয়ে নিয়েছে। আমরা মন্ত্রমুগ্ধের মতো দাঁড়িয়ে থেকে দেখছি সেই অপার সৌন্দর্য। যাত্রা বিরতির নির্ধারিত সময় শেষ হয়ে এলে ট্রেনের হুইসেল বেজে উঠল আমরা ধীরে ধীরে আমাদের কামরায় উঠলাম। আমাদের কথা যেন হারিয়ে গেছে অথবা কোনো কথাই যেন এই সময়টাকে বর্ণনা করাতে সক্ষম নয়, তাই নীরবতাই উত্তম। অভাবনীয় কোনো প্রাপ্তিকে উপভোগ করতে সময়ের প্র্রয়োজন হয়। আমরা তাই নীরবতার মাধ্যমে নিজেদের সেই সময়টা দিয়েছিলাম।

আগেই বলেছিলাম, বারগেন থেকে ফ্লম যাওয়ার পথে অসংখ্য ঝরনার দেখা মেলে সেই অসংখ্য নামহীনা ঝরনার মধ্যে বিশেষ এবং বিপুলা রূপে সেজেগুজে বসে আছে সেই Rjoandefossen নামের ঝরনাটি। এপর্যন্ত আমার দেখা সবচেয়ে বড়ো এই ঝরনাটিকে পর্যটকদের জন্য বিশেষরূপে উপস্থাপন করার ক্ষেত্রে নরওয়ের পর্যটন বিভাগ বেশ সৃজনশীলতার পরিচয় দিয়েছে। কেন বললাম ? না, এখানে একটু বিস্তারিত না বললেই নয়, একে তো দুর্গম পাহাড়ি পথ শুধু চলতি পথের রেলযাত্রীদের পক্ষেই তা এক ঝলক দেখার সৌভাগ্য ছিল। কিন্তু এতে কি প্রকৃতির রূপপিয়াসী পযর্টকদের মন ভরে ! নিশ্চয় না, আর এ বিষয়টিকে বেশ গুরুত্ব দিয়েই ভেবেছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। আগেই বলেছি, এখানে এসে ট্রেন থামে, যাত্রীরা যেন কাছ থেকে তা দেখতে পারে, শুধু তাই নয়, রেললাইনের ধার ঘেঁষে তৈরি করা হয়েছে বিশাল ঝুলন্ত পাটাতন, তিনপাশে রেলিং দেওয়া এই পাটাতনে দাঁড়িয়ে পর্যটকগণ পরশ নিতে পারে চঞ্চলা ঝরনার মিষ্টি ছোঁয়ার। এখানইে শেষ না, রয়েছে ভায়োলিনের অর্পূব সুরমূর্ছনা আর লালবসনা রহস্যময়ী সুকন্যার অসাধারণ নৃত্যের তাল, সব মিলিয়ে পর্যটকদের যেন এক অপার্থিব আয়োজন, যা ভাষায় প্রকাশ দুঃসাধ্যই নয়, প্রায় অসম্ভব। আমরা কেবল ভাষাহীন আবেশে আনেকটা সময় সেই ক্ষণটিকে সঙ্গে বয়ে নিয়ে চলেছি। এই কি শেষ ছিল ? না, এর পর শুরু হলো দূর পাহাড়ে ঝরনাগুলোর ছন্দময় বয়ে চলার প্রতিযোগিতা প্রায় গা ঘেঁষে ঘেঁষে সাত সখি তাদের রূপের ঝলক ছড়িয়ে ছন্দের তালে বয়ে যাচ্ছে- না, এ শুধু সখিগণের মধ্যে চলার প্রতিযোগিতা নয়, এ যেন মৌনীপর্বতমালার মৌন চ্যালেঞ্জ আর অন্য দিকে বাড়িয়ে তুলছে পর্যটকদের নীরবতাকে।

ঝরনার বাড়াবাড়ি রকমের সৌন্দর্যের কথা বলতে গিয়ে পথের আরো যে বৈচিত্র্য তা যেন ভুলতে বসেছি, ঠিক তাই- আঁকাবাঁকা বন্ধুর পাহাড়ি পথের মধ্যদিয়ে আমাদের ছুটে চলা কখনও দূর পাহাড়ে সাদা পাথরের ঝিকিমিকি যেন ঝলসে ওঠা আলো, আবার কখনও পাহাড় চেরা পথে আঁধার সঙ্গী করে এগিয়ে যাওয়া। ছুটে চলা পথে নজর কাড়ে ছোটো ছোটো একলা বাড়ি, পাহাড়ের মৌনের মাঝে যেন একটু প্রাণের স্পন্দন। সকালের আলো বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে একটু একটু করে বাড়ে নিঃসঙ্গ লোকালয়ের কলরব। মাঝে মাঝে চোখে পড়ে দু-একটা বাথান, ঘোড়াগুলো যেন ধ্যানমগ্ন পাহাড়ের শিষ্য। সময় এগোয় আমরাও এগিয়ে প্রায় গন্তব্যে, তিন ঘণ্টা সময় যেন চোখের নিমিষে শেষ হয়ে গেল, গতি কমে এল দুরন্ত ছুটে চলা রেল গাড়ির। ধীরে ধীরে আমরা প্রবেশ করলাম আমাদের নির্দিষ্ট স্টেশনে, কিছু দূরে খাড়ি ছেড়ে যাওয়া জাহাজের হুইসেল আমাদের স্বাগত জানালো... [চলবে]

ছবি : লেখক