ইউরোপের ১৫০ দিন -সৈয়দা তাসলিমা আক্তার

06 Jun 2021, 03:17 PM ভ্রমন শেয়ার:
ইউরোপের ১৫০ দিন -সৈয়দা তাসলিমা আক্তার

আমরা যখন ফ্লমে পৌঁছালাম তখন প্রায় মধ্যদুপুর। ট্রেন থেকে নামতেই চোখে পড়ল বিশাল আকৃতির নোঙ্গর করা জাহাজ, যেহেতু পুরো নরওয়ে দেশটি সমুদ্রের খাঁজে অবস্থিত তাই এখানে যত্রতত্র ফেরিঘাট বা জাহাজঘাট থাকা খুবই স্বাভাবিক। জানালাম পর্যটকদের মনোরঞ্জনের পশরা নিয়ে এই জাহাজগুলো অপেক্ষায় আছে। আমরা আর সেদিকে গেলাম না, আমাদের এখানকার প্রধান কাজ আমাদের বসতি খুঁজে বের করা, যেখানে আমরা অবস্থান করব। খুব বেশি খোঁজাখুঁজি করতে হলো না। কেননা, এখানে থাকার মতো তেমন একটা হোটেল বা রেস্ট হাউজ নেই, এখানকার ভাষায় এগুলো হলিডে হোমস। যাই হোক, আমরা আমাদের পূর্ব নির্ধারিত হলিডে হোমসে পৌঁছালাম অফিসিয়াল ফর্মালিটি শেষে চাবি বুঝে নিয়ে নিজেদের জন্য বরাদ্দকৃত হোমের পথে এগুলাম চলার পথে উপভোগ করছিলাম প্রকৃতির গুছানো সৌন্দর্য । এটা আসলে একটা বিশাল ফার্ম হাউজ যেখানে রয়েছে বিভিন্ন আকৃতির কটেজ, রয়েছে ক্যরাভ্যান আর তাঁবুর ব্যবস্থাও। ক্যারাভ্যান দেখে খুব ইচ্ছে হচ্ছিল কোনো এক ক্যারাভ্যানে নিবাস গড়তে, তবে তার জন্য অবশ্য দেরি হয়ে গেছে। কেননা, আমরা ইতোমধ্যে কটেজ বুক করে নিয়েছি। আর এই পিক সিজনে চাইলেই মনমতো হলিডে হোমস পাওয়া যায় না। সুতরাং যা পেয়েছি তাই অনেক। নিজেদের গন্তব্যে যেতে যেতে যতটুকু দৃষ্টি গোচর হলো তার পুরোটাই প্রকৃতির প্রাণ জুড়ানো আতিথেয়তা, পুরো এলাকাজুড়ে অসংখ্য চেনা অচেনা ফুলের সমারোহ আর রয়েছে আপেল বাগান।

গৃহ প্রবেশের পর আমাদের প্রথম করণীয় পেট পূজার আয়োজন, ইউরোপে আমাদের জন্য এটা একটা বিড়ম্বনাই বলতে হয়, আমাদের খাবার উপযোগী খাদ্য (হালাল খাবার) পাওয়াটা বেশ দুষ্কর। সে কারণে কোথাও গেলে বক্স্্ের করে খাবারও সাথে নিতে হয়। যাই হোক, দুপুরের আহার হিসেবে সাথে আনা নুডুলস আর পরোটা ভাগজোগে খেয়ে রসনা প্রয়োজন মেটালাম তারপর তৈরি হয়ে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম ফ্লমের সৌন্দর্য দেখব বলে। আবারও সেই ফার্ম হাউজের রূপের ডালি আমাদের আমন্ত্রণ জানালো। আমরা আস্তে ধীরে এটা সেটা দেখতে দেখতে এগুচ্ছি। ফার্ম হাউজটা বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত, সেখানে রয়েছে গোরুর বাথান, ভেড়ার ফার্ম আর একটু এগুলেই দিগন্তবিস্তৃত শস্যক্ষেত আর গবাদিপশুর চারণ ভূমি। আমরা হাঁটতে হাঁটতে খাঁড়িতে চলে এলাম, দূরে বেশ কিছু জাহাজের আনাগোনা, ঢেউয়ের শব্দ আর বিকেলের রাঙা রোদ সবকিছু কেমন যেন জীবন্ত মনে হয়। এখানে এসে আমরা দলছুট হয়ে নিজের মতো করে প্রকৃতিকে উপভোগ করতে চাইলাম ।

খাঁড়ির এ দিকটাতে লোকের আনাগোনা নেহাত কম নয়। কেননা ছুটি কাটাতে এসে কে-ই-বা ঘরে বসে থাকতে চায়। খাঁড়ির পাশে একটি কাঠের বেঞ্চে বসে জলের ছি-বুড়ি খেলা দেখার পাশাপাশি এক জোড়া দুরন্ত কিশোর কিশোরীর জলকেলি দেখছিলাম মুগ্ধ হয়ে। যেন তারা নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগীতায় ছিল কে বেশি জল পোষ মানাতে পারে। এরই মাঝে খানিকটা দূরে একদল স্কু-ড্রাইভারদের কসরত চলছিল, তাদের পোশাক আর স্কুবার সরঞ্জামাদি নজর কাড়ছিল দূর থেকেই তাই ভালোভাবে দেখার বাসনায় অনেকটা এগিয়ে গেলাম। এ যেন রীতিমতো যুদ্ধে যাওয়ার প্রস্তুতি। দলটি সমুদ্রে যাবে সম্ভবত : বেশ কয়েক দিনের জন্য তারই প্রস্তুতি চলছে, দলনেতা তাদের যাত্রকালীন প্রস্তুতি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে যাচাই করে নিচ্ছে সাথে চলছে বিভিন্ন রকম কৌশল জানানো ও প্রয়োজনীয় সতর্কবার্তা মনে করিয়ে দেওয়ার বিষয়টি। পুরো বিষয়টি ছিলো বেশ কৌত‚হল উদ্দীপক, তবে সবচেয়ে আকষর্ণীয় ছিল তাদের যাত্রা-পূর্বে এক মনোনরম দলীয় নৃত্য।

ফারজানা অনেকক্ষণ হলো ফোন করে জানিয়েছিল তারা ঝরনার খোঁজে যাচ্ছে আমি যাব কি না ; আমি তাদের রওনা হতে বলে দিয়েছিলাম, সাথে এও জানিয়ে ছিলাম, আমি পরে তাদের সাথে যোগ দেব। স্কু ড্রাইভারদের কসরত দেখতে দেখতে আমি তা ভুলেই গিয়েছিলাম, মনে পড়তেই রওনা হলাম। আমরা ট্রেন থেকে নামতেই এক চঞ্চলা ঝরনা তার খিলখিল হাসি দিয়ে আমাদের স্বাগত জানিয়েছিল এখন আমি তারই সন্ধানে যাচ্ছি, ইচ্ছে পাশে বসে কিছু গল্প-গাছা আর হাসি-ঠাট্টা হবে। কিন্তু কে জানত এ যে মায়াবী ঝরনা যতই কাছে যাওয়ার চেষ্টা ততই সে দূরে সরে যায়Ñ এই করে মাঝখান থেকে আমি পথ হারিয়ে ফেললাম আর ফারজানাদের তো খুঁজেই পেলাম না। যে পাহাড়ে উঠে ঝরনার দেখা পাবো বলে ভেবে ছিলাম সেটার শেষ মাথায় এসে দেখলাম এরপর লোকালয় আর তারও পর আরও খান-দুয়েক টিলা এরপর রহস্যময়ীর আবাস। সুতরাং রণেভঙ্গ দিয়ে ফিরতি পথ ধরলাম এর মধ্যে হানা দিল বেরসিক বৃষ্টি, ভাগ্যিস সাথে ছাতা ছিল। ইতোমধ্যে ফোনে ফারজানাদের অবস্থান জেনে লোকালয়ে ফেরত এলাম। স্টেশন ঘিরে জমজমাট এ জায়গাটাতে রয়েছে পর্যটকদের জন্য নানা আয়োজন। রয়েছে ক্যাফে, সুভ্যিনির শপ, জাদুঘর এছাড়াও ছোটদের জন্য রয়েছে বিভিন্ন্ রাইডের ব্যবস্থা । আমরা সকলেই এমনি একটি রাইডে উঠে বসলাম, দেখতে শিশুমেলার রেলগাড়ির মতো, কিন্তু শিশু-বুড়ো সবাই উঠতে পারে অবশ্য এজন্য গাঁটের কড়ি খরচ করতে হবে। রাইডটির একটি নির্দিষ্ট গন্তব্য রয়েছে, সে অবধি গিয়ে মিনিট বিশেকের যাত্রাবিরতি তারপর আবার ফিরে আসা, যাত্রাপথের বর্ণনায় আর না গেলাম, কেননা প্রকৃতির এই রূপবন্দনা যেন শেষ হওয়ার নয়। যাত্রাবিরতিতে কিছু ঐতিহাসিক ঘটনার সাথে পরিচয়ের সুযোগ পাওয়া গেল। ফ্লমের এখানটায় রয়েছে একটি সিমেন্ট্রি যা কিনা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়কার, আর রয়েছে প্রচীন গির্জা, যার প্রতিটি প্রতিকৃতি মোম দিয়ে তৈরি। প্রায় তিনশত শতাব্দী পাড়ি দিয়ে এখনো ঠায় দাঁড়িয়ে। একটি ঐতিহাসিক স্থাপনা হিসেবে পরিব্রাজকদের কাছে এর বেশ কদর রয়েছে, পাশাপাশি ভক্তদের কাছে এটি একটি শান্তির আশ্রয়স্থল। যিনি রেল রাইডটির নিয়ন্ত্রক ছিলেন তিনিই এখানে এসে গাইডের ভ‚মিকায় অবতীর্ণ হলেন। জানাচ্ছিলেন ফ্লমের উত্থান-পতনের আদি-অন্ত সেই সাথে সিমেন্ট্রি আর গির্জার ইতিহাস। এরই একফাঁকে নিজমনে প্রার্থনাও করে নিলেন। ফিরতি পথটুকু কেবল পথের দু’ধারের প্রকৃতি দেখেই কেটে গেল। মিনিট চল্লিশেকের মতো এই যাত্রা কিছুটা হলেও ফ্লমের ইতিহাসের স্বাক্ষর দেখার সুযোগ করে দিলো।

এখনো নরওয়েতে শরৎ চলছে, গত কয়েকদিন আকাশ বেশ স্বচ্ছ থাকলেও আজ আকাশের মন অথবা মেজাজ বেজায় খারাপ, থেকে থেকে কেঁদে চলেছে। অথবা পাহাড়ি উপত্যকার প্রকৃতির ধরনই বোধ হয় এই। আগে বলেছিলাম কি না মনে নেই, ফ্লম মূলত পশ্চিম নরওয়ের একটি গ্রাম, যার অবস্থান একটি উপত্যকায়। না আর ইতিহাস বা ভ‚গোল ঘেটে কাজ নেই, এই সময়টার কথা বলি। বৃষ্টি তো আপনমনে ঝরেই যাচ্ছে তাই বলে কি আর বসে থাকা যায় ! এদিকে সন্ধ্যাও ঘনিয়ে এলো, সময় কাটাতে একটি স্যুভিনির দোকানে ঢুকে পড়লাম। বেশ বড়ো দোকানটি নানান ভাগে ভাগ করা, ছোটো ছোটো স্মারক স্যুভিনির থেকে শীতের পোশাক সবই বিক্রি হচ্ছে। তবে, দাম নিয়ে আর কথা নাই বলি। আমরা শুধু দর্শক হয়ে দোকানটা চক্কর দিয়ে বেরিয়ে এলাম। এর পাশেই জাদুঘরটির অবস্থান, যা মূলত রেল জাদুঘর নামেই পরিচিত। আমরা মূলত বৃষ্টিকে এড়ানোর জন্যই এ দোকান, সে দোকান ঘুরে অবশেষে জাদুঘর দর্শনে ব্রতী হলাম, তবে এখানে এসে মনে হলো, না এলে বোধহয় ভুলই হতো। সত্যি চমৎকার আয়োজন, মনে হলো যেন আমরা টাইম মেশিনে চড়ে কয়েক শতাব্দী পেছেনে চলে গেছি। যখন এ অঞ্চলে রেল যোগাযোগ স্থাপন হয় ঠিক সে সময়কার রেল ব্যবস্থা তো বটেই জীবনযাত্রার একটি চালচিত্র এখনো ঠায় বর্তমান।

এর মাঝে বৃষ্টি কিছুটা ধরে এলে আমরা খাঁড়ির ধার ঘেঁষে এগিয়ে গেলাম। খাঁড়ির এদিকটা বেশ ফাঁকা, দূরে হয়ত দু’-একটা জাহাজ পাহাড়ের বাঁকে অন্য কোনো ঘাটে নোঙর ফেলেছে, এছাড়া বাকি জলাধার বেশ শান্ত। তীর ঘেঁষে কিছু বিলাসী নৌকা বিলাস নিয়ে অবস্থান করছে, আপাত তা শূন্য মনে হলেও হয়ত কোনো বিলাস পিয়াসী এর কোনো এক কোণে আবস্থান করছে । আসলে নিস্তব্ধ শান্ত প্রকৃতি আমাদের মনে অনেক ভাবনার অবকাশ করে দিয়েছে। হাঁটতে হাঁটতে এক সময় আমাদের থামতেই হলো। কেননা, পায়ে চলা পথের এখানেই সমাপ্তি, এরপর নো-এন্ট্রি জোন... হ [চলবে]